মুজিবনগর সরকার

         
মোহাম্মদ নাসিম

আজ থেকে ৪৮ বছর আগের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করেছিল। মেহেরপুরের ভবেরপাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথতলায় সাদামাটা পরিবেশে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। এই শপথ শুধু একটি সরকার গঠনের শপথ ছিল না। এই শপথ ছিল অন্যায়ের বিরদ্ধে, অবিচারের বিরুদ্ধে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার শপথ। 

সেদিনের সেই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি কেমন ছিল? স্বাধীনতা-পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে ইতিহাস বারবার ক্ষত-বিক্ষত হওয়ার কারণে প্রকৃত সত্য সম্পর্কে অনেকে হয়তো ওয়াকিবহল নয়। মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য এম মনসুর আলীর সন্তান হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘটনাগুলো কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ অন্য অনেকের তুলনায় হয়তো আমার একটু বেশিই হয়েছিল। মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় আমবাগানের চারদিকে রাইফেল হাতে কড়া প্রহরায় ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আম্রকানন লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। খোলা আকাশের নিচে চৌকি পেতে শপথ মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। বেলা ১১টায় শুরু হয়েছিল সেই কাঙ্ক্ষিত শপথ অনুষ্ঠান। একে একে মঞ্চে উঠলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামানসহ অন্যরা। অনুষ্ঠানের শুরুতেই বাংলাদেশকে 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ'রূপে ঘোষণা করা হয়েছিল। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম একে একে তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী, কামারুজ্জামানসহ মন্ত্রিসভার সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। সেই মন্ত্রিসভার একজন সদস্যের নাম এই লেখার মধ্যে আনার অভিপ্রায় ছিল না। তবে ইতিহাস বলতে গেলে অনেক সময় অনেক কিছু না চাইলেও লিখতে হয়। সে জন্যই ওই বেইমান, বিশ্বাসঘাতক- যাকে সেদিন মন্ত্রিসভার সদস্য করা হয়েছিল সেই মোশতাকের নামটি উচ্চারণ করতে হলো। মোশতাক মনে করত, জ্যেষ্ঠতার কারণে তাকেই মুজিবনগর সরকারের প্রধান করা হবে। কিন্তু জাতীয় চার নেতা মোশতাকের পরিকল্পনা সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন। হয়তো সে কারণেই তাকে মন্ত্রিসভায় নামেমাত্র রাখা হয়েছিল। বেইমান মোশতাক সুযোগ বুঝে পাকিস্তান ও সিআইএর হয়ে কনফেডারেশন গঠন করতে চেয়েছিল। খন্দকার মোশতাক কত বড় মীরজাফর- সপরিবারে জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়েই তা আমরা বুঝতে পারি।

মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠান বাঙালি জাতিকে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছিল, সাহস জুগিয়েছিল। পাকিস্তানি শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়াইয়ে আমাদের বীর সৈনিকরা উজ্জীবিত হয়েছিলেন। মুজিবনগর সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, কূটনৈতিক প্রচারণা চালিয়ে বিশ্ব জনমত গঠন করেছিল। একই সঙ্গে এক কোটিরও বেশি উদ্বাস্তু মানুষের পুনর্বাসন কার্যক্রম অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করেছিল। মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও তার সরকার এবং সে দেশের জনগণ যেভাবে আমাদের সহায়তা করেছিলেন, তা কোনোদিন ভুলব না। ইন্দিরা গান্ধী শরণার্থীদের আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থা করেন। মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠন করতে ইন্দিরা গান্ধী বিভিন্ন দেশে ছুটে বেড়িয়েছেন। 

সীমিত সামর্থ্য নিয়ে মুজিবনগর সরকার যে দক্ষতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ ও প্রশাসন পরিচালনা করেছিল, তা যে কোনো সরকারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। লাখ লাখ মুক্তিপাগল ছাত্র-জনতা-যুবককে প্রশিক্ষণ দিয়ে গেরিলা বাহিনী গঠন করা হয়েছিল স্বল্পতম সময়ের মধ্যে। একই সঙ্গে স্বাধীন বাংলা বেতারের মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ রাখা, বিশ্ব জনমত গঠনসহ বিভিন্ন অবিস্মরণীয় কীর্তি সম্পন্ন করে। 

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চের পর থেকেই বিশ্ববাসীকে দেখাতে চেয়েছিলেন, বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধ ভারতের মাটিতে বসে সংগঠিত হচ্ছে। সেই প্রচারণা মিথ্যা প্রমাণ করতেই বাংলাদেশের মাটিতে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়। প্রথমে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ১৪ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার শপথ নেবে। যে কোনোভাবেই হোক খবরটি পৌঁছে যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে। সে জন্য ১৩ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় বিমান থেকে বৃষ্টির মতো বোমাবর্ষণ করে ওরা। ফলে শপথ অনুষ্ঠান পিছিয়ে যায় ১৭ এপ্রিল। শহীদ এম মনসুর আলীসহ জাতীয় চার নেতা খাওয়া, ঘুম বন্ধ রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করাসহ মুক্তিসংগ্রামকে বেগবান করতে বিভিন্ন এলাকায় ছুটে গেছেন। স্বাধীনতার লক্ষ্যে ছিলেন অবিচল। তারা নিজেদের মধ্যে যে আলাপ-আলোচনা করতেন, তাতে স্বাধীন জাতি হিসেবে বাঙালির আত্মপ্রকাশ নিয়ে কোনো সংশয় ছিল না। তারা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন- বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই হবে। কারণ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তাদের সেই মন্ত্রেই দীক্ষা দিয়েছিলেন। তারা বিশ্বাস করতেন- বঙ্গবন্ধু তাদের সঙ্গেই আছেন। নেতার নির্দেশিত পথেই তারা বিজয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। জাতীয় চার নেতা জীবনেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন, মরণেও তার সঙ্গে ছিলেন। নূ্যনতম বেইমানি করলে কারা-অভ্যন্তরে তাদের মৃত্যুবরণ করতে হতো না। জীবন দিয়ে তারা নেতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্বাসের প্রমাণ দিয়ে গেছেন। শহীদ এম মনসুর আলীর রক্তের উত্তরসূরি হিসেবে বলতে পারি- আমাদের রক্ত কোনোদিন বেইমানি ও বিশ্বাসঘাতকতা করবে না।

স্বাধীনতার পর জাতির পিতা যখন দেশ গঠনের কাজে হাত দিয়েছিলেন, ঠিক সে সময়েই একদল বেইমান, বিশ্বাসঘাতক তাকে সপরিবারে হত্যা করে। এর পর আরেক মোনাফেক জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে বাংলাদেশকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেন। স্বাধীনতাবিরোধীদের দেশে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। ৩০ লাখ বাঙালির রক্তের বিনিময়ে অর্জিত লাল-সবুজের পতাকা তাদের গাড়িতে তুলে দেন। তাদের মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া হয়। শুরু হয় ইতিহাস বিকৃতি। দীর্ঘ ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে রাখে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দানকারী আওয়ামী লীগকে। হত্যা করে হাজার হাজার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে। অর্ধশতাধিকবার শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে তিনি বেঁচে গেছেন। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়তে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তিনি। বাংলাদেশকে বিশ্বের মানচিত্রে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। আজকের এই দিনের দৃপ্ত শপথ হোক- শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই গড়ে তুলব বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা।

সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

SUMMARY

359-1.jpg