পাকিস্তানের জেলে বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রসঙ্গে বিশ্ব প্রতিক্রিয়া


এ কে এম আতিকুর রহমান

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আনুমানিক দেড়টার দিকে (২৬ তারিখ, শুক্রবার) তাঁর ধানমণ্ডির বাসভবন থেকে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী গ্রেপ্তার করে এবং পরে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায় ও আটক করে (ডিটেনশন) রাখে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার পর তাঁকে কোথায় রাখা হয়েছিল ও তিনি কেমন আছেন তা কেউ জানত না। এমনকি তিনি জীবিত আছেন কি না সে খবরটিও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেনি। যদিও স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে বলা হতো যে তিনি ভালো আছেন এবং আমাদের সঙ্গেই আছেন; স্বাধীনতাযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ বাঙালি জাতি কোনোক্রমেই যাতে মনোবল না হারায় সে কারণেই ঘোষণাটি বারবার দেওয়া হতো। যাহোক পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু যে জীবিত আছেন এ তথ্য মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া যায় যখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার জন্য গোপনে পাকিস্তানের কোনো এক সামরিক আদালতে বিচারের ঘোষণা দেন।

বঙ্গবন্ধু ভালো করেই জানতেন যে পাকিস্তান মিলিটারি তাঁকে গ্রেপ্তার করবে। অনেকে তাঁকে টেলিফোনে পরিস্থিতির কথা বলে বাসা ছেড়ে চলে যেতে অনুরোধ করেছেন। তিনি বাসা থেকে পালিয়েও যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। বলেছিলেন যে তিনি যদি পালিয়ে থাকেন, তবে তাঁকে খুঁজে বের করার জন্য পাকিস্তানি মিলিটারি পুরো ঢাকা শহরকেই জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেবে। এসব তথ্য ওয়াশিংটন পোস্টে একই বছরের ৩০ মার্চ লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফের সাংবাদিক সাইমন ড্রিংয়ের একটি প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যা ও ধ্বংসলীলার বর্ণনার এক অংশে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের ঘটনাটিও উল্লেখ করা হয়েছে। 

১৯৭১ সালের ২০ মে নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে হোমার এ জাক বলেছেন, ২৫ মার্চ সামরিক শাসন জারি করা হয়েছে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং পাকিস্তানি মিলিটারি ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠেছে। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের এ পরিস্থিতিতে আমেরিকা ও জাতিসংঘসহ সারা বিশ্ব কেন উদ্বিগ্ন নয়!

২৭ মে হেলসিংকিতে অনুষ্ঠিত The Socialist International Council-এর সভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।

১৭ জুন ১৯৭১ তারিখে ওয়াশিংটনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন।

৫ জুলাই ১৯৭১ তারিখে গার্ডিয়ান পত্রিকায় পূর্ব পাকিস্তান ও ভারত সফর করে আসা চার সদস্যের ব্রিটিশ কমনস মিশনের একটি প্রতিবেদনের আলোকে প্রকাশিত তথ্য মতে লেবার পার্টির সংসদ সদস্য আর প্রেন্টিস বলেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের উচিত শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেওয়া এবং আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতাসহ তাঁর সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করা।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং ২০ জুলাই ভারতের লোকসভায় একটি বিবৃতি দেন। ওই বিবৃতির এক অংশে তিনি বলেন, ২৮ জুন দেওয়া প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ভাষ্য অনুযায়ী শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে পাকিস্তান কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করলে তা হবে বাংলাদেশ সৃষ্টির পথই রচনা করা।  

৩ আগস্ট পাকিস্তান টেলিভিশনে এক সাক্ষাত্কারে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতার জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং দেশের আইন অনুসরণ করেই তাঁর বিচার করা হবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আরো বলেন, শেখ মুজিব দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহই করেননি, তিনি সশস্ত্র সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করেছেন। তবে যে সত্যটি জেনারেল ইয়াহিয়া উচ্চারণ করেছেন তা হলো, শেখ মুজিব নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতা এবং ওই দলটি নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। এরপর ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের সদর দপ্তর একটি প্রেসনোট জারি করে, যেখানে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার জন্য নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে বিশেষ সামরিক আদালতে বিচার করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়। ওই নোটে আরো বলা হয়, অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে ১১ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারকার্য শুরু হবে। 

আগস্টের প্রথম সপ্তাহে আমেরিকার হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে বক্তব্য প্রদানকালে কংগ্রেসম্যান কর্নেলিয়াস গালাঘর বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের সামরিক সরকারকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে এবং বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের জন্য তাঁর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে।

আগস্ট মাসের ৯ তারিখে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে শেখ মুজিবের জীবন নিয়ে যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, এতে পাকিস্তানই ধ্বংস হয়ে যাবে। তিনি বিশ্বের সব গণতন্ত্রমনা, স্বাধীনতাকামী ও ন্যায়বিচারপ্রত্যাশী দেশের ও জনগণের প্রতি শেখ মুজিবকে বিচারের নামে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ওই প্রহসন বন্ধ করার জন্য আকুল আবেদন জানান।

আগস্ট মাসে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ১৩০ জন সদস্য শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য সংসদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। লেবার পার্টির এমপি জন স্টোনহাউস প্রস্তাবটি উত্থাপনকালে বলেন, পূর্ব বাংলায় যে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটছে তা বন্ধ করতে হলে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। এ ছাড়া লেবার পার্টির এমপি রেজিনাল্ড প্রেন্টিস ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার এলিস ডগলাসকে অনুরোধ করেন শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তার বিষয়টি তদন্ত করে দেখার জন্য।

৯ আগস্ট ভারতের লোকসভায় দেওয়া বিবৃতিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতির বর্ণনা দেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে পাকিস্তানের বিচার প্রহসনকে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন, যা বিশ্ববাসীর নিন্দাই প্রাপ্য বলে উল্লেখ করেন। শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে তাঁদের উদ্বেগের বিষয়টি বারবার বিশ্ববাসীকে জানানো হয়েছে। বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও সহকর্মীদের কোনো ক্ষতি করা হলে বাংলাদেশে যে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে সেসবের দায়দায়িত্ব পাকিস্তানের শাসকদেরই নিতে হবে। এ ব্যাপারে লোকসভার ৫০০ সদস্য একই মত পোষণ করেন।

বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের গোপন সামরিক আদালতে বিচার শুরু করার বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিবৃতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১০ আগস্ট বিশ্বের সব দেশের সরকারপ্রধানের কাছে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির ব্যাপারে একটি বার্তা পাঠান। ওই বার্তায় তিনি কথিত বিচারের আড়ালে শেখ মুজিবুর রহমানকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে সবাইকে এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে তাঁদের প্রভাব খাটাতে অনুরোধ করেন।    

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং আগস্টের ১০ তারিখে জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্টকে একটি বার্তা পাঠান। তাতে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরুর ব্যাপারে পাকিস্তানের ঘোষণায় সবার মর্মাহত হওয়ার কথা বলেন। ওই দিনই জাতিসংঘ মহাসচিবের পক্ষে দেওয়া বিবৃতিতে শেখ মুজিবের বিচার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। জাতিসংঘ মহাসচিবের ওই বিবৃতির প্রতিবাদে পাকিস্তান জাতিসংঘের এ বিষয়ে কিছু বলার এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

১৩ আগস্ট বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ পাকিস্তানকে হুঁশিয়ারি প্রদান করে বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কিছু হলে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় বিপর্যয় নেমে আসবে।

১৪ আগস্ট ১৯৭১ সালে জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিকের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক আদালতের নেওয়া পদক্ষেপে তাঁর দেশের উদ্বেগের কথা জানিয়ে বলেন, জিডিআরের জনগণ পাকিস্তান সরকারের কাছে জনগণের নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি ন্যায়বিচার, মানবিকতা ও শ্রদ্ধা জানানোর আবেদন জানাচ্ছে। জিডিআরের জনগণ পাকিস্তানের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে সামরিক আদালতের বিচারকার্য বন্ধ করার মাধ্যমে পাকিস্তানে বিদ্যমান সংঘাতের একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান বের করার জন্য পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানায়।

১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট বুয়েনস এইরেস থেকে প্রকাশিত La Nacion পত্রিকায় একটি সংবাদ ছিল এ রকম, ‘জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্ট সতর্ক করেছেন যে পূর্ব পাকিস্তানের একচ্ছত্র নেতা মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার নামে গোপন বিচার গত নভেম্বরে বয়ে যাওয়া হারিকেন ও পরে কলেরার আক্রমণ পূর্ব বাংলাকে যতটা না ধ্বংস করেছে তার চেয়ে বেশি ভয়াবহ হবে।’ এর দুই দিন পর (১৭ আগস্ট) জেনেভাস্থ আন্তর্জাতিক জুরিস্ট কমিশন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য একটি টেলিগ্রাম প্রেরণ করে।

হেলসিংকিতে অবস্থিত বিশ্ব শান্তি কাউন্সিলের সচিবালয় ২০ আগস্ট পাকিস্তান সরকারের কাছে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য অনুরোধ করে। মানবিকতার সব পথ বন্ধ করে ও বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ইয়াহিয়া সরকার বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। এর মাধ্যমে ইয়াহিয়া খান নিজেকেই বিশ্বের কাছে একজন সাম্রাজ্যবাদী ও স্বৈরশাসক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। শেখ মুজিবকে যদি গোপন বিচারের নামে কোনো শাস্তি দেওয়া হয়, তাহলে এক ভয়াবহ দুর্যোগের সৃষ্টি হবে, যার গভীরতা নির্ণয় করা অসম্ভব। বিশ্ব শান্তি কাউন্সিল অবিলম্বে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে ইয়াহিয়া খানের সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছে।

৭ সেপ্টেম্বর রাতে কাঠমাণ্ডুতে নেপালের East Bengal Refugees Assistance Committee একটি সভার আয়োজন করে। কমিটির চেয়ারম্যান ও নেপালের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হৃষিকেশ সাহার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।

মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে ১৩ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের কনফারেন্সে সাবেক কমনওয়েলথবিষয়ক ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বটমলি শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সব সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি শেখ মুজিবকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য কথা বলার একমাত্র ব্যক্তি বলে উল্লেখ করেন।

কিনশাশা থেকে প্রকাশিত আফ্রিকান ট্রিবিউন পত্রিকার ১৩ সেপ্টেম্বরের সংখ্যায় বলা হয়, এখন যদি শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হয়, তবেই সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানে সহায়ক পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

বোস্টন থেকে প্রকাশিত ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটরে ১৫ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুর বিচারের ব্যাপারে আমেরিকান সিনেটর চার্লস এইচ পারসির একটি বক্তব্য ছাপা হয়। তিনি পাকিস্তানি নেতাদের বলেন, তাঁদের দেশ বিশ্ববাসীর নিন্দার শিকার হবে যদি শেখ মুজিবকে মৃত্যুদণ্ড বা আজীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

১৭ সেপ্টেম্বর ‘ক্যানবেরা টাইমস’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তাঁর কর্মকাণ্ডের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধ। যে আদালত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করছেন, তাঁরা যদি তাঁকে শাস্তি দেন, তবে শান্তিপূর্ণ সমাধানের সুযোগ চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাবে।

১৮ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক কনফারেন্স পাকিস্তানের সামরিক ট্রাইব্যুনালে শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচারকে নিন্দা জানায় এবং শেখ মুজিবুর রহমান ও বাংলাদেশের নির্বাচিত অন্য প্রতিনিধিদের দ্রুত ও নিঃশর্ত মুক্তির জন্য অনুরোধ করে।

২৬ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) কাউন্সিল সভায় শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দাবি করা হয়।

প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ২৮ সেপ্টেম্বর একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানান যে ১১ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু হয়েছে। পাকিস্তানের নামকরা আইনজীবী এ কে ব্রোহির নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি দল শেখ মুজিবের পক্ষে লড়ছে। ওই বিজ্ঞপ্তিতে জনগণকে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করার জন্য সতর্ক করে দেওয়া হয়, যা আদালত অবমাননা হিসেবে গণ্য হতে পারে।

অক্টোবরে সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি বাংলাদেশের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে যে পত্র লেখেন তাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেপ্তার ও বিচার করার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।

করাচির ‘দ্য ডন’ পত্রিকায় ২০ অক্টোবর প্রকাশিত একটি সংবাদে জানা যায় যে প্যারিস থেকে প্রকাশিত ‘Le Monde’ পত্রিকাকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান একটি সাক্ষাত্কার দেন। পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর আলোচনার যে গুজব শোনা যায় তার সত্যতা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেন, বিচারে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হলে ও তিনি জাতীয় স্বার্থবিরোধী কোনো কাজ না করার আশ্বাস দিলেই সংলাপ হতে পারে। 

২৭ অক্টোবর অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর ড. বরুনো ক্রেইস্কি পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কর্তৃক শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক রাখার তীব্র নিন্দা জানান এবং বলেন, ইউরোপের কোনো গণতান্ত্রিক দল ওই সব কর্মকাণ্ড কোনোক্রমেই সহ্য করবে না।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ৮ নভেম্বর ‘নিউজ উইক ম্যাগাজিন’কে দেওয়া সাক্ষাত্কারে বলেন, তিনি ইচ্ছা করলেই শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে পারেন না। তবে যদি জাতি শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করে, তিনি তা-ই করবেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ওই সাক্ষাত্কারের পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের ৪২ জন রাজনৈতিক নেতা, শ্রমিক সংগঠক, আইনজীবী, সাংবাদিক, লেখক, ছাত্রনেতা, সমাজকর্মী ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার জন্য একটি আবেদনপত্র প্রেসিডেন্টের কাছে প্রেরণ করেন।

১৮ নভেম্বর ইতালির রোম থেকে প্রকাশিত L’Unita-এর সম্পাদকীয়তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে বিশ্বের সব মানুষ ও দেশ, যারা শান্তি ভালোবাসে ও চায়, তাদের শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করে আনার জন্য আবেদন জানায়।

১৫ ডিসেম্বর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে লিখিত পত্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে উল্লেখ করে তাঁর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সন ওই পত্রের জবাব দেন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার দুই দিন পর অর্থাৎ ১৮ ডিসেম্বর। তিনি তাঁর পত্রে বলেন, সমস্যা নিরসনে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আলোচনা শুরু করতে পারে। এখানে বিস্ময়ের ব্যাপার যে আমেরিকা তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান না করলেও তিনি তাঁর পত্রে বাংলাদেশ নামটি ব্যবহার করেছিলেন। 

১৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানের এক সরকারি মুখপাত্র জানান যে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারকার্য শেষ হয়ে গেছে, তবে রায় লেখা হয়নি। অতি শিগগির, হয়তো ওই মাসের শেষ নাগাদ রায় জানা যাবে; যদিও এর দুই দিন আগেই অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর পরাজিত পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করায় বাংলাদেশ সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয়ে যায়। আর শেখ মুজিব তখন স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির পিতা। সেনানায়ক ইয়াহিয়া খানের কি শক্তি আছে তাঁকে বেঁধে রাখবেন?

অবশেষে বাঙালির প্রাণ, বাঙালির ভালোবাসায় সিক্ত শেখ মুজিবকে ইয়াহিয়া সরকার ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন যান। সেখান থেকে দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁছেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি সামরিক সরকার কেন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করেছিল? ২৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পাকিস্তানের সব রেডিও ও টেলিভিশনে প্রচারিত তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘Sheikh Mujibur Rahman’s action of starting his non-cooperation movement is an act of treason...’। কেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন বলে সামরিক আদালতে তাঁর বিচার করা হবে? ১৯৭১ সালের ৩ আগস্ট  পাকিস্তান টেলিভিশনে এক সাক্ষাত্কারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করার কারণ হিসেবে বলেছিলেন, acts of treason, acts of open rebellion and incited armed rebellion against the state| এর কয়েক দিন পর ৯ আগস্ট পাকিস্তান সরকারের দেওয়া প্রেসনোটে বলা হয়, Sheikh Mujibur Rahman, President of the defunct Awami League, will be tried by a Special Military Court for waging war against Pakistan…| বঙ্গবন্ধু কি জেনারেল ইয়াহিয়ার ব্যক্তিগত শত্রু ছিলেন যে এই কথাগুলো বলেছিলেন? তাহলে তো ৩ আগস্টের টেলিভিশন সাক্ষাত্কারে ইয়াহিয়া বলতেন না, Sheikh Mujibur Rahman is not his opponent at all. I am only a caretaker and has nothing to oppose Sheikh Mujibur Rahman as a politician| ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশের আর কারো সম্পর্কে ওই ধরনের মন্তব্য করেননি বা ধরে নিয়ে পাকিস্তানের জেলে রেখে সামরিক আদালতে গোপন বিচারের আয়োজন করেননি? বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্দেশনা প্রত্যেক বাঙালির কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই।

লেখক : সাবেক সচিব ও রাষ্ট্রদূত

SUMMARY

352-1.jpg