আবদুল বাসেত মজুমদার
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন লড়েছেন বাংলার স্বাধীনতা ও বাঙালির জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য। স্কুলজীবন থেকেই বঙ্গবন্ধুর মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলির বিকাশ ঘটে। নিজেই নিজেকে রাজনৈতিকভাবে এবং গণমানুষের অধিকার আদায়ের প্রস্তুতের আদর্শে গড়ে তোলেন। তাঁর জাতির পিতা বা বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার পেছনে টুঙ্গিপাড়ার মানুষের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। এই ছোট্ট অনুন্নত গ্রাম ও মানুষের মধ্যে তিনি লক্ষাধিক গ্রাম ও কয়েক কোটি মানুষকেও দেখেছেন। আর সে জন্যই বাঙালি জাতির ভাগ্যকে তিনি জয় করতে গিয়ে নিজের জীবনের প্রতি তাকিয়ে দেখার সুযোগ পাননি। জেল-জুলুম, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার—সব কিছু সহ্য করেছেন; কিন্তু বাংলার মানুষের সঙ্গে কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। তাঁর লক্ষ্য ছিল বাংলার মানুষের মুক্তি। বাঙালি উন্নত জীবনের অধিকারী হোক। বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। বাঙালি জাতিসত্তাকে প্রতিষ্ঠা করুক। একজন মহান নেতা হওয়ার সব গুণই আমরা তাঁর মধ্যে খুঁজে পাই। কিউবার বিপ্লবী প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট (১৯৭২ সালের এক সাক্ষাত্কারে) বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনার শক্তি কোথায়?’ বঙ্গবন্ধু সে প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘আমি আমার জনগণকে ভালোবাসি।’ ‘আর আপনার দুর্বল দিকটা কী?’ বঙ্গবন্ধুর উত্তর, ‘আমি আমার জনগণকে খুব বেশি ভালোবাসি।’ এই হলেন বঙ্গবন্ধু। জনগণের অন্তর্নিহিত শক্তির ওপর অপার আস্থা-বিশ্বাস, অসাম্প্রদায়িক, মানুষের প্রতি নিঃশর্ত ভালোবাসা, মমত্ববোধ, ত্যাগ স্বীকার এবং সহমর্মিতার বিরল দৃষ্টান্তসমৃদ্ধ মানুষ বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে প্রথম সরকারের মাত্র সাড়ে তিন বছরের সংক্ষিপ্ত সময়টুকু নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। শূন্য থেকে শুরু করে তাঁর সরকারকে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের অগণিত সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ সব ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এবং জাতিগঠন কার্যক্রম শুরু হয়। আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন, যোগাযোগব্যবস্থা পুনর্নির্মাণ, মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের জনরোষ থেকে রক্ষা করা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, লাখ লাখ ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য খাদ্য সংগ্রহ করা এবং আরো অনেক সমস্যার সমাধান তাঁর সরকারের সামনে সুবিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এরপর জনমোহিনী ভাবমূর্তিকে আশ্রয় করে তিনি বাকশাল বা বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ফলে দেশে স্থিতিশীলতা আসতে শুরু করে। পুরো দেশ যখন ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল, ঠিক তখনই আসে আরেকটি আঘাত। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট মধ্যরাতে একদল বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা হত্যা করে শেখ মুজিব এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের। শুধু তাঁর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সেই সময় দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যান। সদ্য স্বাধীন জাতির জীবনে এক অপূরণীয় ক্ষতি নিয়ে আসে এই জঘন্য হত্যাকাণ্ড, তৈরি করে রাজনৈতিক শূন্যতা, ব্যাহত হয় গণতান্ত্রিক উন্নয়নের ধারা।
বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু আর মুক্তিযুদ্ধ—এই শব্দ তিনটি মূলত সমার্থক? এই তিনটির যেকোনো একটিকে আলাদা করে বিশ্লেষণ করার কোনো সুযোগ নেই। দেশ ও মানুষকে তিনি তাঁর হূদয়ের আধেয় করে একজন আত্মত্যাগী দেশপ্রেমিক নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন। ছাত্রজীবন থেকে যে শিক্ষা ও দীক্ষা তাঁর জীবনকে আলোকিত করে তোলে, তার শিখা চিরন্তন করে রেখে গেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধু সব সময় সাধারণ মানুষের বিজয় চেয়েছেন। মুক্তিকামী বাঙালি জাতিকে মুক্তির বাণী শুনিয়েছিলেন। তিনি বাঙালির ম্যাগনাকার্টা বলে পরিচিত যে ছয় দফা কর্মসূচি দিয়েছিলেন, সেখানেও রয়েছে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির কথা। সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধনই ছিল তাঁর ধ্যান।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দুই দশকে নানাভাবে ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। হত্যার পর যারা ক্ষমতায় এসেছিল, তারা স্বভাবতই বুঝতে পেরেছিল তীব্র প্রতিবাদ না হলেও স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু শব্দগুলো ঠিকই রয়ে যাবে ইতিহাসের পাতায়। ফলে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে বঙ্গবন্ধু এবং ইতিহাস বিকৃত করা ছাড়া উপায় ছিল না?
বঙ্গবন্ধু এমন এক ব্যক্তি, যিনি রাষ্ট্রীয় ও গণমানুষের স্বার্থে নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোকে ব্যয় করেছিলেন। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তিনি ছুটে গেছেন দেশের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে। গণতন্ত্রের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে অনাহারে, অর্ধাহারে তৃণমূল নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ছিলেন। নেতাকর্মীদের মধ্যকার সুসম্পর্ক স্থাপন এবং তথ্যের নিবিড় প্রচারণায় নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তারুণ্যের দীপ্তি ছড়িয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বে এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু মানে এক আপসহীন নেতার নেতৃত্ব। তাঁর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অন্যতম গুণ ছিল জ্ঞান অনুরাগী, তুখোড় বক্তা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানসিকতা, কেন্দ্রীয় বিষয়ের প্রতি ঝোঁক, পরোপকারিতা, ন্যায়ের প্রতি অবিচল, আদর্শে অটল। তিনি কখনোই পিছু হটার মতো ব্যক্তি ছিলেন না। বীরদর্পে শুধু সামনের দিকেই ছুটেছেন। এনে দিয়েছেন একটি সার্বভৌম সোনার বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর বর্তমান অবস্থান তাঁকে কেউ উপহার দেয়নি, বরং তিনি তাঁর ব্যক্তিক যোগ্যতায় বাঙালি জাতির পিতার আসনটি অর্জন করে নিয়েছেন।
বর্তমানে রাজনীতিবিদদের এক বিশাল অংশ ক্ষণিক বা স্বাভাবিক ভালোলাগা থেকে রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িত করলেও জাতির জনক ও তাঁর রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণাই রাখে না। তাদের বেশির ভাগের কাছে জাতীয় দিবস ও শোক দিবসের প্রেক্ষাপট এখনো বেশ অস্পষ্ট। তারা শুধু কথিত ফায়দা লোটার কাজে ব্যস্ত থাকে। বর্তমানে রাজনীতির মাঠে আদর্শের সংকট চলছে। তাই একজন সচেতন ব্যক্তি হিসেবে রাজনীতিতে ভালোমানের অবস্থান তৈরি করতে হলে তাকে প্রথমেই বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা, আপসহীন রাজনীতিবিদ ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঠিক জীবনবৃত্তান্ত জানা ও তাঁর আদর্শ ধারণ করার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে, তা অনুধাবন করতে হবে। আজকাল ছাত্ররাজনীতির ক্ষেত্রটি খুবই দূষিত। তা ছাড়া আদর্শিক সংগঠনগুলোর নামে-বেনামে শাখা সৃষ্টি করায় গণমানুষ অতিষ্ঠ; অধিকার ভাগ-বাটোয়ারা করতে এসব ভুয়া রাজনৈতিক সংগঠন উঠেপড়ে লেগেছে। তাই বঙ্গবন্ধুর মতো নেতৃত্বের আজ বড় দরকার। বঙ্গবন্ধু ফিরে আসুক আমাদের জাতীয় নেতৃত্বের কথা ও কাজের মাঝে। গণমানুষ যেন ফিরে পায় স্বাধীনতার অমৃত স্বাদ।
জাতির জনকের স্বপ্নের পূর্ণ বাস্তবায়ন করছেন তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজে আওয়ামী লীগের তৃণমূল থেকে সমকল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের দায়িত্ব। অনেকেই রয়েছে জাতির জনক ও তাঁর রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে তাদের তেমন কোনো ধারণা নেই। বঙ্গবন্ধুকে জানতে হবে। তাঁর আদর্শ পুরো ধারণ করতে হবে। সেই আদর্শ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতকে আরো মজবুত করতে হবে। তাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ পুরো ধারণ ছাড়া আমাদের জন্য বিকল্প কোনো পথ নেই।
জাতির জনকের ঝাণ্ডা হাতে নিয়ে এগিয়ে চলছে জননেত্রী শেখ হাসিনা। সেই ঝাণ্ডাকে অনেকেই ধ্বংস করতে চায়। এ জন্য তাদের ষড়যন্ত্রও গভীর। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র কিন্তু থেমে নেই। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ যখন উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন তাঁকে হত্যা করা হয়। এখনো ষড়যন্ত্র চলছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশে যে উন্নয়ন হচ্ছে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে সেই উন্নয়ন-অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে ষড়যন্ত্র চলছে। ষড়যন্ত্র চলছে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করার, নির্বাচন বানচাল করার এবং গণতন্ত্রকে হত্যা করার। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আগুন সন্ত্রাস করার সুযোগ দেওয়া হবে না। ষড়যন্ত্রকারীরা যতই চেষ্টা করুক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আবারও সরকার গঠিত হবে ইনশাআল্লাহ। আগামী জাতীয় নির্বাচন সংবিধান মেনেই হবে। সংবিধানসম্মতভাবেই সংসদ বহাল থাকবে, নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশবিরোধীরা যদি আবার বিশৃঙ্খলা, আগুন সন্ত্রাসের পথ বেছে নেয় তাহলে আমরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তাদের দাঁতভাঙা জবাব দেব।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ আজ বিশ্বের মধ্যে উন্নয়নের এক রোল মডেল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে কেউ থামাতে পারবে না। সব ষড়যন্ত্র আর নানা প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে—ভবিষ্যতে আরো এগিয়ে যাবে। সে জন্য আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই নির্বাচনে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখে এগিয়ে যাওয়ার মানসে আবারও নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসাতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে তৃণমূল পর্যায় থেকে সব পর্যায়ে আওয়ামী লীগের বিজয় নিশ্চিত করা।
শেষে বলতে চাই, বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু আর মুক্তিযুদ্ধ—এই শব্দ তিনটি মূলত সমার্থক। এই তিনটির যেকোনো একটিকে আলাদা করে বিশ্লেষণ করার কোনো সুযোগ নেই। দেশ ও মানুষকে তিনি তাঁর হূদয়ের আধেয় করে একজন আত্মত্যাগী দেশপ্রেমিক নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন। ছাত্রজীবন থেকে যে শিক্ষা ও দীক্ষা তাঁর জীবনকে আলোকিত করে তোলে, তার শিখা চিরন্তন করে রেখে গেছেন তিনি। আসুন, সবাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করি। সেই আদর্শে নিজেদের বলীয়ান করে দেশকে এগিয়ে নিই। আর জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে চলমান উন্নয়নের ধারা আরো জোরালো করতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত হই সবাই। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও চরিত্র আমাদের কাজকর্মে ও জীবনে প্রতিফলিত হোক।
লেখক : আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি