আজিজুল হাকিম সম্রাট
১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। ১৯৭৫ সালের এই কালরাত্রিতে শাহাদাত বরণকারী সবার প্রতি আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করছি। হৃদয়ের গভীরে সযত্নে সঞ্চিত আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য অশ্রুজলে নিবেদন করছি এই কালো রাত্রিতে শাহাদত বরণকারী সকলের আত্মার মাগফেরাত কামনায়। এই কালরাত্রিতে জাতির জনককে তাঁর পরিবারের ১৭ জন সদস্যসহ নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। ঘাতক খুনিচক্র সংবিধান লঙ্ঘন করে, ক্ষমতার লালসায় উন্মাদ হয়ে সভ্যতার বর্বরতম এই হত্যাকাণ্ড সংঘটনের মাধ্যমে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল দেশের অগ্রগতিকে। ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সব অর্জনকে, সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে।
বেদনাবিধুর ও কলঙ্কের কালিমায় কলুষিত বিভীষিকাময় সেই ১৫ আগস্টে নরপিশাচ-ঘাতক দল ছিলো অদম্য রক্তপিপাসু। বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ সন্তান ১০ বছরের শিশু রাসেল, শিশু আরিফ সেরনিয়াবাত, সুকান্ত আবদুল্লাহ রিন্টু কেউই তাদের বীভৎস ছোবল থেকে রেহাই পাননি। রেহাই পাননি বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, সুলতানা কামাল, রোজী জামাল, আরজু মণি, বেবি সেরনিয়াবাতের মতো ঋজু, দৃঢ়, সাহসী, ক্রীড়ামোদী, সংস্কৃতবান নারী।
বঙ্গবন্ধুর শিশুতোষ সারল্য, বাংলার মানুষের প্রতি অগাধ আস্থা-বিশ্বাস, তার সব সুকৃতি, তার অসামান্য জনপ্রিয়তা, তার আদর্শের ধ্রুবতা, তার প্রশ্নাতীত সততা সত্বেও বিংশ শতাব্দীর কৌটিল্য কূটবুদ্ধি তাকে বাসন্তীর জালে জড়িয়ে রক্তাক্ত ক্ষত-বিক্ষত করে সিঁড়িতে গড়িয়ে দেয়। আর তিনি নদী, মাঠ-ক্ষেত ভালোবেসে আবার ফিরে আসেন, রয়ে যান সব ধানসিঁড়ি নদীর তীরে। বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রানুরাগী ছিলেন। নজরুল ছিলেন তার নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্রোহের মডেল।
জেল জীবনে তিনি প্রায়ই রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়তেন। গাইতেন, ‘নাই নাই ভয়/হবে হবে জয়’, ‘আমার সোনার বাংলা...’, আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি’, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ এই জাতীয় গান। নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’, ‘দুর্গমগিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে' তাকে ব্যাপক আলোড়িত করত। তার রাষ্ট্রচিন্তা ও রাষ্ট্রবিনির্মাণের সাধনা শুধু যে এসব কাব্যসঙ্গীত প্রেরণানির্ভর ছিল তা নয়; বাঙালির সেক্যুলার সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্রসাধনা সম্পর্কে তিনি ছাত্রজীবনেই আলোড়িত হন। আকৃষ্ট হন বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি।
বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকে নেতাজী সুভাষচন্দ্র যখন কুখ্যাত হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের আন্দোলন করেন, সেই আন্দোলনের অন্যতম সাহসী সৈনিক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তিতুমীর, ক্ষুদিরাম, ফকির মজুন শাহ, প্রফুল্ল চাকী, বাঘা যতীন, নূরল দিন, সূর্যসেন, চারণকবি মুকুন্দ দাশ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা ফজলুল হক, আবুল হাশিম, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুও তার প্রেরণা ছিল।
বংশ, বিদ্যা, বুদ্ধি ও বিত্তের ওপর রাজনৈতিক প্রতিপত্তি অনেকটা নির্ভর করে। বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে এসবের বিশেষ ভূমিকা ছিল না। বংশ এবং বিত্তে তিনি টুঙ্গিপাড়ার উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান নয়। সে সময়ের হিসেবে মধ্যবিত্ত। বুদ্ধির চেয়েও তার প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ছিল বিস্ময়কর। একবার নাইজেরিয়ার জেনারেল ইয়াকুবু গাওয়ান বঙ্গবন্ধুকে বলেন, ‘অবিভক্ত পাকিস্তান একটি শক্তিশালী দেশ, কেন আপনি দেশটাকে ভেঙে দিলেন’। উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘শুনুন মহামান্য রাষ্ট্রপতি, আপনার কথাই হয়তো ঠিক। অবিভক্ত পাকিস্তান হয়তো শক্তিশালী ছিল, তার চেয়েও শক্তিশালী হয়তো হতো অবিভক্ত ভারত। কিন্তু সেসবের চেয়ে শক্তিশালী হতো সংঘবদ্ধ এশিয়া। আর মহাশক্তিশালী হতো একজোট এ বিশ্বটি। কিন্তু মহামান্য রাষ্ট্রপতি, সবকিছু চাইলেই কি পাওয়া যায়’?
বিদ্যার্জনে বঙ্গবন্ধু বারবার বাধা পান। অসুস্থতায় পাঠ বিরতির ফলে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন বিলম্বে। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে রাজনীতিতে জড়িয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর শিষ্য ও আবুল হাশিমের ভাবশিষ্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৪৭-এ ইংরেজ উপনিবেশ বিমুক্তি তথা দেশভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু ভাষার অধিকারের সংগ্রামে সভা-সমিতি এবং শোভাযাত্রা-হরতাল সংগঠনের অভিযোগে ১৯৪৮-এর মার্চ ও সেপ্টেম্বরে দু’বার তাকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধস্তন কর্মচারীদের স্বার্থরক্ষার সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধে ১৯৪৯ সালে মার্চ মাসে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। সে সময় কয়েকজন আন্দোলনকারী ভবিষ্যৎ সৎ আচরণের মুচলেকা দিয়ে তাদের বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করলেও বঙ্গবন্ধু কোনো মুচলেকা না দেওয়ায় তার বহিষ্কারাদেশ বহাল থাকে।
১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনৈতিক তৎপরতার কোনো বিরতি ছিল না। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে, ৫৬-এর শাসনতন্ত্রের জন্য আন্দোলন, ৬২-এর ১৭ সেপ্টেম্বরের শিক্ষা আন্দোলন, ৬৪-এর সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলন এবং ৬৬’র ৭ জুনের ছয় দফা আন্দোলন ৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন, ৭১ মুক্তিযুদ্ধ প্রতিটি সংগ্রামেই ছিল বঙ্গবন্ধু মুজিবের একচ্ছত্র নেতৃত্ব। পাকিস্তান সরকারের ২৪ বছর শাসনকালে তাকে ১৮ বার কারাগারে বন্দি রাখা হয়। তার এ বন্দিত্বের সময়সীমা ১২ বছরেরও বেশি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে তার প্রাণদণ্ড হওয়ার কথা ছিল। তবে আইয়ুব-ইয়াহিয়া যা পারেনি স্বাধীন বাংলাদেশে ঘাতক বাঙালিরাই তা সাধন করেছে, স্ব-পরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে।
কিছু ঘটনা শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারছি না-
*৭০ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু একটি গ্রামে নির্বাচনী প্রচারণায় গিয়েছেন। সেখানে এক বুড়ি জাতির পিতাকে ১০ টাকা দেওয়ার জন্য আর এক কাপ চা খাওয়াবে বলে বসে আছে তার বাড়ির সামনে। বঙ্গবন্ধু আসতেই বুড়ি তাকে টাকা দশটি দিয়ে অঝর ধারায় কাঁদতে লাগলেন। পিতা মুজিব যখন বুড়ি মাকে টাকা টা ফেরত দিয়ে সাহায্যের কথা বললেন তখন বুড়ি মা বললেন, না বাবা এটা তুমি নিয়ে যাও, তোমার জন্য দোয়া রইল। বাঙালি এভাবেই অকুণ্ঠ চিত্তে ভালবাসতো জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
*মৃত্যুর মাত্র ৯ দিন আগে ৯ আগষ্ট তিনি বাংলাদেশের যে জ্বালানী নিরাপত্তা সেটি নিশ্চিত করেছিলেন।এই যে আমাদের যে পাঁচটি গ্যাস ক্ষেত্র। যেমনঃকৈলাস টিলা,বাখরাবাদ সহ অন্যান্য গ্যাসক্ষেত্র গুলো, সেগুলো তিনি সেই সময়ই শেল কম্পানির কাছ থেকে মাত্র ৪.৫ মিলিয়ন পাউন্ড স্ট্যালিন দিয়ে কিনে নিয়েছিলেন।
*সেই ১৯৭৪ সালেই তিনি সীটমহল আইন করেন।তার মৃত্যুর পর যেটার বাস্তবায়ন হতে সময় লাগলো ৪০ বছর। সেসময় তিনিই প্রথম রাষ্ট্র প্রধান যিনি সমুদ্র আইন প্রণয়ন করেন। এই তো ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান!
ভিক্টর হুগো বলেছেন, নতুন সময় নতুন চিন্তাকে অনিবার্য করে তোলে। তাই সবকিছুর পরও সব অবিশ্বাস-সংশয়ের দেয়াল সরিয়ে আমাদের সমঝোতার পথে, ঐক্যবুদ্ধির পথে চলতে হবে। কেননা অপার ক্ষমাশীল বঙ্গবন্ধু সবকিছুর পরও এ পথেই চলতে চেয়েছেন। আলিঙ্গন করেছেন মৃত্যুকে। তার অস্বাভাবিক মহাপ্রয়াণ দিবসে আমরা আর শোক না করে সৌজন্য তোরণের অসৌজন্যতা বাদ দিয়ে আসুন স্মরণ করি তার আজন্ম সাধনার মহামূল্যবান কীর্তিকে। এখনও তিনি বাংলার দুর্জয় তারুণ্যের হিমালয়, দুর্যোগের অমানিশায় উজ্জ্বল বাতিঘর। যতদিন এ বাংলার চন্দ্র-সূর্য উদয় হবে ততদিন ভোরের শুকতারার মতোই বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবেন কোটি কোটি বাঙালির হৃদয়ে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বঙ্গবন্ধু আমাদের রোল মডেল।
শেষ করবো কবি অন্নদা শংকর রায়ের লেখা একটি কবিতা দিয়ে। যিনি সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লেখেন।
“যতকাল রবে পদ্মা মেঘনা গৌরি যমুনা বহমান, ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান। দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা - রক্তগঙ্গা বহমান, নাই নাই ভয় হবে হবে জয়- জয় মুজিবুর রহমান।”
জয় বাংলা
জয় বঙ্গবন্ধু।।