বঙ্গবন্ধু ও বাহাত্তর পরবর্তী পররাষ্ট্রনীতি

মোহাম্মদ জমির  

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের নির্মম গুপ্তহত্যার ৪০ বছর পার হলো। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে উত্তাল সমুদ্রে শুধু নিরাপদ সঠিক পথের দিশাই দেননি, বরং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাতেও তিনি ছিলেন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান ফেরতের পর সৌভাগ্যবশত আমার সঙ্গে তাঁর লন্ডনের ক্লারিজ হোটেলে দেখা হয়। আমার সাবেক কর্মস্থল ছিল মিসরের কায়রোতে পাকিস্তান দূতাবাস। সেখান থেকে এসে লন্ডন শহরে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলাম। এর আগেও তাঁর সঙ্গে আমার অনেকবার দেখা হয়েছিল। কিন্তু এবারের ব্যাপার ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সরাসরি তাঁর থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কে পরিকল্পনা শুনছি মন্ত্রমুগ্ধের মতো। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন আমি কি লন্ডন থেকে বাংলাদেশের হয়ে কাজ করতে চাই, নাকি দেশে সরাসরি তাঁর তত্ত্বাবধানে থেকে নবগঠিত বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠনে অংশীদার হতে চাই? আমি বললাম, আমি বাংলাদেশেই ফিরে যেতে চাই। তিনি তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলেন এবং আমার দ্রুত দেশে ফিরে আসার সব প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে যান। ১৯৭২ সালের জানুয়ারির শেষের দিকে আমাদের নবগঠিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দিলাম। বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারিতেই নয়াদিল্লির পালাম বিমানবন্দরে এই অবিসংবাদিত নেতা নতুন দেশটিকে নিয়ে তাঁর পরিকল্পনা জানান। স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর এই যাত্রাকে তিনি দাসত্বমুক্তি ও নতুন আশা নিয়ে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাত্রা নামে অভিহিত করেন। তিনি আরো বলেন, 'কারো প্রতি ঘৃণা নিয়ে নয়, বরং মিথ্যাকে হটিয়ে সত্যের জয়, মানসিক সুস্থতা, কাপুরুষতার বিরুদ্ধে বীরোচিত জয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় ও মন্দের বিরুদ্ধে ভালো কিছু করার তৃপ্তি নিয়ে দেশে ফিরছি।

১০ জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁছার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সুবক্তা ও রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষণ দিলেন। স্বভাবসিদ্ধ কর্মতৎপর ভঙ্গিতে জয়ী বাংলাদেশিদের করণীয় নিয়ে পরিকল্পনা জানালেন সেই ভাষণে। এত আনন্দোৎসবের মধ্যেও সবাইকে অবাঙালিদের ওপর কোনো রকম হামলা না করার ব্যাপারে সাবধান করে দিতে ভুললেন না। একই সঙ্গে পাকিস্তানে অবস্থানরত চার লাখ বাঙালির নিরাপত্তার ব্যাপারেও তিনি ছিলেন সচেষ্ট। নতুন করে গঠনের এই প্রাক্কালে তিনি স্পষ্ট করেই ইঙ্গিত দেন- পাকিস্তানিদের প্রতি কোনো শত্রুতা নেই; কিন্তু যারা নিরীহ বাঙালিদের হত্যা করেছে তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনা হবে। 'বাংলাদেশে ইসলাম বিলুপ্ত হচ্ছে' পাকিস্তানিদের ক্রমাগত এই মিথ্যা প্রচারণার বিরুদ্ধে তিনি সচেতন ছিলেন। একই বক্তব্যে মুসলিম দেশগুলোর উদ্দেশে বলেন, 'ইন্দোনেশিয়ার পরে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ। তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি আরো বলেন, 'ইসলামের নামে পাকিস্তানি সেনারা এ দেশে মুসলিমদের হত্যা করেছে। মা-বোনদের সম্ভ্রমহানি করেছে। আমি এ দেশে ইসলামকে অসম্মানিত হতে দেব না।' তাঁর এ বক্তব্যে পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ ও সৌহার্দ্যজনক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হয়েছে; যেখানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতি তাঁর দৃঢ় অবস্থানের পাশাপাশি ইসলামের নামে রিপাবলিক অব পাকিস্তানের অনাচারের প্রতিও ইঙ্গিত করেছেন।


ওআইসির সেক্রেটারি জেনারেল বাংলাদেশে অবস্থিত বিহারি ও অবাঙালি মুসলিমদের জন্য তাঁর উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেন। তার জবাবে ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ওআইসির সেক্রেটারি জেনারেল টেংকু আব্দুর রহমানকে একটি তিরস্কারসূচক বার্তা পাঠান তিনি। বার্তায় বলা হয়, '১৯৭১ সালের ৯ মাসে পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যরা ৩০ লাখ বাঙালিকে নির্বিচারে হত্যা করেছে। নিরীহ মুসলিমদের হত্যায় অন্যান্য মুসলিম সংগঠন ও আপনারা চুপ ছিলেন।'

পরে ১৯৭৩ সালের ১৭ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ অনুসন্ধানের পর ১৯৫ জনকে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, জেনেভা কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ৩ ভঙ্গ, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রমাণের ভিত্তিতে তাদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৭৫ সালে তাঁর মৃত্যুতে গোটা বিচারপ্রক্রিয়া স্তিমিত হয়ে যায়।

বঙ্গবন্ধুর অনেক নিন্দুক ছিল। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে তারা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে ভারতের স্বার্থ রক্ষার্থে নিয়োজিত দল হিসেবে আখ্যা দেয়। এমনকি ভারতের জন্য নিজের দেশের স্বার্থও জলাঞ্জলি দিচ্ছে এমন কথাও রটায়। অথচ এসবই ছিল সত্য থেকে অনেক দূরে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ভারতের সেনাবাহিনীর মুক্তিযুদ্ধকালীন অবদানের জন্য বঙ্গবন্ধু তাদের ধন্যবাদ জানান। একই সঙ্গে বাংলাদেশের জরুরি পরিস্থিতি অবসানের সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশের সীমানা থেকে তাদের চলে যাওয়ার অনুরোধও জানান। তৎকালীন পাকিস্তানি নেতারা প্রচার করেন, বাংলাদেশ ভারতের উপনিবেশ হয়ে যাচ্ছে। আর সাধারণ মানুষের অনেকে তা বিশ্বাস করে কিছুটা ভীতও হয়।

বঙ্গবন্ধুর আরেকটি উল্লেখযোগ্য অবদান হচ্ছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষ ও শরণার্থী বাংলাদেশিদের মানসিকভাবে সাহসী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তোলা। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিশ্চিত করেন কলকাতা থেকে সাত মিলিয়ন শরণার্থীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। বাকিরা নতুন করে সব কিছু শুরু করার স্বপ্ন নিয়ে আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই ফিরে আসে। এত বিপুলসংখ্যক মানুষকে যুদ্ধ-পরবর্তী ত্রাণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা খুবই কষ্টকর কাজ ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দল জাতিসংঘের সাহায্যে এই কাজ করেছে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে।

বঙ্গবন্ধু দৃঢ়ভাবে প্রতিটি জাতির সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভারতীয় ডেস্কের পরিচালক থাকার সুবাদে ভারত ও বাংলাদেশের সমান বাণিজ্যিক সুবিধা ও সহযোগিতার নিশ্চয়তার জন্য তাঁকে কতটা চাপের মুখে থাকতে হয়েছিল তা দেখেছি। তিনি সহযোগী মনোভাবাপন্ন মানুষ ছিলেন। প্রায় চার দশক পরে আজকে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য আমরা আঞ্চলিক শক্তি গ্রিড ও আঞ্চলিক পানি ব্যবস্থাপনার কথা প্রস্তাব করছি। অথচ বঙ্গবন্ধুর এমন চিন্তাধারা ছিল বহু আগেই।

বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গভীর আগ্রহ ছিল। তাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে শুধু ভিন্ন দেশের সঙ্গে পরিচিতি এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনেই নয়, বরং আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলোর সদস্য পদ লাভের জন্যও যোগ্য হয়ে উঠতে বলেন। তাঁর প্রতিটি বৈদেশিক ভ্রমণে অন্তর্নিহিত থাকত সেই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও প্রতিবেশীসুলভ মনোভাব গড়ে তোলা। তিনি বিশ্বাস করতেন, এতে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অপরাপর দেশের অহেতুক হস্তক্ষেপ বন্ধসহ পারস্পরিক শান্তি ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং সমান অধিকার নিয়ে নিজস্ব সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা সম্ভব।

তাঁর এই দৃঢ়চিত্ত মনোভাব আমাদের খুব দ্রুত আন্তর্জাতিক সুসম্পর্ক নির্মাণে সাহায্য করেছিল। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রথম স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপনের সময় বিশ্বের ৫৪টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। বাহাত্তরের শেষের দিকে এসে এই সংখ্যা হয়ে যায় অনেক। তার পরের খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ কমনওয়েলথ, নন-অ্যালায়িং গ্রুপ, আইএলও, ডাব্লিউএইচওর সদস্য হয়ে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমরা জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণে থাকলেও চীনের ভেটো ক্ষমতার কারণে সদস্য পদ লাভ করতে পারিনি। এটা বঙ্গবন্ধুকে খুব হতাশ করে। তিনি ১৯৫৬ সাল থেকে বেশ কয়েকবার চীনে ভ্রমণ করেন এবং যেকোনো ঘটনায় চীনকে অত্যন্ত গুরুত্ব ও সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করতেন।

১৯৭২ সালে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন ড. কার্ট ওয়েলধাইম। সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও ২৭ নভেম্বর জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের কাছে পাকিস্তানের বিভিন্ন ক্যাম্পে আটক বাংলাদেশিদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য মানবিক সাহায্য চেয়েছিলেন। তিনি এটা করেছিলেন কারণ, পাকিস্তান এই ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতি করতে চেয়েছিল। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের ফেরত চাচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এই আচরণ থেকে বোঝা যায় তিনি দেশের মানুষকে কতটুকু ভালোবাসতেন।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে তাঁর সরাসরি অংশগ্রহণ বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর নন-অ্যালায়িং দেশ ও অন্যান্য কমনওয়েলথভুক্ত দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নতি ঘটিয়েছিল। তাঁর এই কর্মকাণ্ডের ফলে ১৯৭৩ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে সিরিয়া ও মিসর যুদ্ধে বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। অল্প সময়ের মধ্যে সিনাইয়ে অবস্থানরত মিসরীয় সৈন্যদের সাহায্যের জন্য বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর একটি মেডিক্যাল টিম ও চা উপহার পাঠান তিনি। দূরদৃষ্টি ও বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবের জন্য সৌদি আরব, কুয়েত, মিসর, আলজেরিয়া ও সিরিয়া বাংলাদেশকে ওআইসির সদস্য পদ লাভের জন্য সুপারিশ করেছিল। ১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসির সামিটে বাংলাদেশকে আলাদা স্বাধীন দেশ হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য তারা জোর দিয়েছিল। আমার আরবি ভাষায় দক্ষতা থাকা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালক হওয়ার সুবাদে উল্লেখযোগ্য এই দুটি পদক্ষেপেই সরাসরি যুক্ত হতে পেরেছিলাম। এটা আমার জন্য পরম গৌরবের বিষয়।

তিনি একজন আত্মত্যাগী মানুষ ছিলেন। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, তাঁর সব উদ্যোগ অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে ফেলা হয়। তাঁর অকালে চলে যাওয়া আমাদের শাসনব্যবস্থায় অনেক অপতৎপরতার উন্মেষ ঘটায়, যার মধ্যে প্রধানতম হচ্ছে জবাবদিহির অভাব। তাঁর স্মৃতির প্রতি ঋণী থেকে সব নাগরিকের সম-অধিকার ও সুশাসন নিশ্চিতের মাধ্যমে উন্নত বাংলাদেশ গঠনে প্রত্যয়ী হতে হবে।

লেখক : সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার ও রাষ্ট্রদূত

SUMMARY

335-1.jpg