এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান
বাংলাদেশের যা কিছু অর্জন, তা এসেছে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে; বাকিটা আসছে তাঁর সুযোগ্যা কন্যার হাত ধরে। বঙ্গবন্ধু এনে দিয়েছিলেন রাজনৈতিক মুক্তি; তাঁর কন্যা এনে দিচ্ছেন ক্ষুধা থেকে, দারিদ্র্য থেকে, চিকিৎসা সংকট থেকে, মৌলিক চাহিদার অভাব থেকে মুুক্তি। সুতরাং মার্চ-বঙ্গবন্ধু-বাংলাদেশ যেন একাকার
মার্চ এক অদ্ভুত মাস। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জগৎ আলো করে ভূমিষ্ঠ হন এক ‘খোকা’। যেন একটি মানবশিশু নন; নিপীড়িত মানুষের মুক্তির স্ফুলিঙ্গ নিয়ে আবিভূর্ত হন তিনি! বাংলাদেশের জল-হাওয়ায়ই দিনে দিনে তাঁর সেই ‘স্ফুলিঙ্গের’ প্রাবল্য বৃদ্ধি পেয়েছিল। তাঁর আদুরে নাম খোকা—পুরো নাম শেখ মুজিবুর রহমান! কালক্রমে তিনি হয়ে ওঠেন স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রধান নেতা, বঙ্গবন্ধু, বাঙালি জাতির জনক, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গেও ছিল তাঁর সক্রিয় সম্পৃক্ততা। এ মাসের ১৭ তারিখ তাঁর জন্মদিন (বর্তমানে এর সঙ্গে উদ্্যাপিত হয় জাতীয় শিশু দিবস)। আর ২৬ মার্চ জন্ম নেয় স্বাধীন দেশ। গাণিতিক হিসাবে ২৬ আর ১৭-এর ব্যবধান ‘৯’। এই সংখ্যার সঙ্গেও রয়েছে স্বাধীন দেশের গৌরবের ইতিহাসের এক আশ্চর্য যোগসূত্র! সেটা ৯ মাস! কেননা ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বিজয়ী হয় বাঙালি। বাস্তবায়িত হয় হাজার বছরের বাঙালির স্বপ্ন। একাত্তরের ৭ মার্চ বাঙালির স্বপ্ননির্ধারণী যে ভাষণ তিনি দেন, তা আজ বিশ্বঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেছে।
ফেব্রুয়ারির পরই মার্চ মাসের নাম। বাঙালির দামাল ছেলেদের কীর্তিময় আন্দোলনের কারণে বায়ান্ন থেকে একাত্তর—মাত্র ১৯ বছরের ব্যবধানে ফেব্রুয়ারি আর মার্চ একাকার হয়ে যায়। বাঙালি জাতির ইতিহাসে এর রয়েছে গভীর যোগসূত্র। কেননা ভাষা আন্দোলনের পর বাঙালির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বড় আন্দোলনের নাম স্বাধীনতা আন্দোলন। স্বাধীনতাই বাঙালির সবচেয়ে গৌরবের অর্জন। ভাষা আন্দোলনকে যদি তখন পর্যন্ত আমাদের জাতীয় দাবি আদায়ের প্রধান প্রেরণা বা প্রথম অর্জন হিসেবে গণ্য করা হয়, তাহলে দীর্ঘ ১৯ বছর পর, ঠিক তার পরের মাস, অর্থাৎ ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে সূচিত হয় বাঙালির সবচেয়ে বড় অর্জনের আন্দোলন।
১৯৭১ সালের মার্চের শুরুতেই উত্তাল হয়ে ওঠে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরও বাঙালির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় ১ মার্চ পালিত হয় অর্ধদিবস হরতাল। ২ মার্চ প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন ডাকসুর নেতারা। ৩ মার্চ ঢাকার পুরানা পল্টনে আয়োজিত সভায় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের ভাষণে দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারিত হয় স্বাধীনতার প্রতিজ্ঞা। সেদিন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। নইলে বাংলার মানুষ কোনো রকম সহযোগিতা করবে না। কর-খাজনা বন্ধ করে দেবে। এই সমাবেশের ভাষণের মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ছাত্র-জনতার পক্ষে স্বাধীনতার প্রথম ইশতেহার পাঠ করেন তৎকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। সেদিনই এই ভূখণ্ডের নাম ‘বাংলাদেশ’ এবং দেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ নির্ধারিত হয়ে যায়। ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যম দল-মত-নির্বিশেষে সব বাঙালি স্বাধীনতাসংগ্রামের চূড়ান্ত রূপরেখা পেয়ে যায়। আর ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধু যখন উপলব্ধি করেন, পাকিস্তানিদের আর সুযোগ দেওয়ার কোনো কারণ নেই, তখনই, অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বাংলাদেশের যা কিছু অর্জন, তা এসেছে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে; বাকিটা আসছে তাঁর সুযোগ্যা কন্যার হাত ধরে। বঙ্গবন্ধু এনে দিয়েছিলেন রাজনৈতিক মুক্তি; তাঁর কন্যা এনে দিচ্ছেন ক্ষুধা থেকে, দারিদ্র্য থেকে, চিকিৎসা সংকট থেকে, মৌলিক চাহিদার অভাব থেকে মুুক্তি।
সুতরাং মার্চ-বঙ্গবন্ধু-বাংলাদেশ যেন একাকার। কেন যেন ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাস এ জাতির জন্য গভীর অর্থবহ হয়ে উঠেছে দিন দিন। নইলে ৩ মার্চ, ১১ মার্চ, ৭ মার্চ, ১৭ মার্চ, ২৬ মার্চ—এমন একেকটা তারিখ কেন বাঙালির ইতিহাসের একেকটা মাইলফলক স্পর্শ করবে?
দুই.
আর মাত্র এক বছর পর আমরা মহাসমারোহে উদ্যাপন করব জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ। আর দুই বছর পর আমরা উদ্্যাপন করব মহান স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। যেসব আদর্শ ও চেতনার ভিত্তিতে জাতি মুক্তির আন্দোলনে শামিল হয়েছিল, সেই সব আদর্শ ও চেতনা সমুন্নত রাখতে প্রয়োজন ইতিহাসের পাতায় ফিরে তাকানো। এ জন্য আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে, কোন স্বপ্নের পেছনে ছুটেছিলেন বঙ্গবন্ধু? কোন কঠিন স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিলেন তিনিসহ তাঁর স্বপ্নসারথিরা? কোন অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল বাংলাদেশের স্বপ্ন তাঁরা দেখেছিলেন? তার কতটা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি আমরা? কিংবা নতুন প্রজন্মের জন্য কী সম্ভাবনাই বা রেখে যাচ্ছি আমরা? এখন ভাবার সময় এসেছে, আমাদের ১৯৫২ থেকে ১৯৭১—দুই দশকের আন্দোলনের দাবিগুলোর মধ্যে, যুদ্ধদিনে আত্মোৎসর্গের পেছনের সেই সব স্বপ্নের মধ্যে নিহিত রয়েছে সেসব আদর্শ, মূল্যবোধ আর স্বপ্ন। আমাদের দেশ এখন দারিদ্র্য বিমোচনে, নারীর ক্ষমতায়নে, অর্থনৈতিক উন্নয়নে সারা বিশ্বের কাছে ‘রোল মডেল’। তাই এখন সময় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র মধ্যে যেসব আদর্শ, মূল্যবোধ আর স্বপ্ন মিলেমিশে একাকার ছিল, সেসবও পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নে মনোনিবেশ করা। বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি আমাদের সে আস্থা আছে। নতুন প্রজন্মকে সেই নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। নতুন প্রজন্ম বরাবরের মতোই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি সজাগ দৃষ্টি দিয়ে দেশকে এগিয়ে নেবে—সেটাই আমাদের কাম্য।