ফারদিন ফেরদৌস
পরাভব না মানা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, লাখো শহীদের জীবনদান এবং অগণিত মায়ের সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তানি অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠে বন্দি মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেশে ফিরতে পারাটা মুক্তপ্রাণ বাঙালির ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা। মহান একাত্তরের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সরকার বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে মিয়ানওয়ালি কারাগারের নির্জনে বন্দি করে। ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির বিজয়ের পূর্বাপর পর্যন্ত পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খান রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে বিচারের নামে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানোর পাঁয়তারা করতে থাকে। কিন্তু বীরবাঙালি যুদ্ধে জিতে গিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার পর ইয়াহিয়া নিজেই সামরিক চক্রে বৃত্তবন্দি হয়ে পড়েন। বিশ্বনেতৃবৃন্দের চাপে মুক্তিকামী বঙ্গবন্ধুকে জেলমুক্ত করতে বাধ্য হন ইয়াহিয়া পরবর্তী নতুন সামরিক আইন প্রশাসক জুলফিকার আলি ভুট্টো।
নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে ছাড়া পান ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি। সেখান থেকে তিনি যান যুক্তরাজ্যে। লন্ডনে রাষ্ট্রনায়কের মর্যাদায় অভিষিক্ত হওয়ার পর ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ ৯ জানুয়ারি রয়াল বিমানবাহিনীর প্লেনে বঙ্গবন্ধুকে দিল্লিতে পাঠিয়ে দেন। এর আগে ৩ জানুয়ারি করাচিতে লাখো মানুষের এক উন্মুক্ত জনসভায় পাকিস্তানের জনগণের কাছে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে সম্মতি চান প্রেসিডেন্ট ভুট্টো। ভুট্টোর প্রশ্নের জবাবে জনতা চিৎকার করে জবাব দেয়, হ্যাঁ আমরা মুজিবের মুক্তি চাই। ভুট্টো স্বস্তির সঙ্গে উচ্চারণ করেন, ‘শুকরিয়া।’ ইয়াহিয়ার দুর্মর ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন বলেই সদ্য স্বাধীন দেশ বাংলাদেশে আটক ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যের দুর্ভাগ্য এড়ানো গেল—এটা ভেবেই ভুট্টো ও তার সভাসদরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পেরেছিলেন।
১০ তারিখ সকালে দিল্লিতে নেমে বীরোচিত সংবর্ধনা পান বঙ্গবন্ধু। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মিত্র দেশ ভারতের সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি দক্ষিণ এশিয়ার নতুন নেতাকে বরণ করেন উষ্ণ অভ্যর্থনায়। সেখানকার আপামর জনগণও দৃঢ়চেতা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কারিশমাকে সাধুবাদ জানান। বঙ্গবন্ধুও ভারতের নেতৃবৃন্দ এবং জনগণের কাছে তাঁদের অকৃপণ সাহায্যের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান।
বিধ্বস্ত একটা দেশ। চারপাশে স্বজন হারানো গৃহহীন মানুষের করুণ আহাজারি। এরই মধ্যে নিজের দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করে আপন করে পাওয়ার সান্ত্বনা। আর অধীর অপেক্ষা কখন নেতা দেশের মাটিতে পা রাখবেন। যাকে কেন্দ্র করে বিবর্ণতার অন্ধকার পেছনে ফেলে স্বাধীনতার সুবর্ণ সূর্য উদিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশ বাংলার পবিত্রভূমিতে পা রাখলেন ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি। আনন্দে উদ্বেলিত বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে নিজেদের আত্মার আত্মীয় জ্ঞানে বরণ করলেন। যে বঙ্গবন্ধু একাত্তরের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সহায়তার আবেদন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণায় বলেন, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ, তোমরা যে যেখানে আছো এবং যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্য বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’
বাংলাদেশের সেই মহানায়ক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন বিকেল ৫টায় রেসকোর্স ময়দানে অন্তত ১০ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে ভাষণ দেন। যেখানে তিনি ৭ মার্চ দৃপ্তকণ্ঠে বলেছিলেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না, রক্ত যখন দিয়েছি আরো দেব, এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ; এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু সশ্রদ্ধ চিত্তে সবার ত্যাগের কথা স্মরণ করে শহীদ ছাত্র, শ্রমিক, সেপাই আর সাধারণ মানুষদের আত্মার শান্তি কামনা করেন। আকুল কণ্ঠে তিনি বলেন, আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার মনের আশা পূর্ণ হয়েছে। আমার বাঙালি আজ মুক্তি পেয়েছে। আর বঙ্গবন্ধু কবিগুরুর উদ্দেশে চিৎকার করে বলে ওঠেন, হে কবি, আপনি বলেছিলেন, সাত কোটি সন্তানেরে হে বঙ্গ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি। আপনি এসে দেখে যান আমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে। আত্মপ্রত্যয়ী বঙ্গবন্ধু দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন, বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম। বাংলাদেশকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।
পাকিস্তানি জান্তা সরকার ভ্রাতৃত্বের দোহাই দিয়ে দুই পাকিস্তানকে এক রাখার চেষ্টায় বঙ্গবন্ধুকে ভুট্টো সরকারের রাষ্ট্রপতি পদ দেওয়ার প্রলোভন, এমনকি কনফেডারেশনের মাধ্যমে হলেও বাংলাদেশকে দাবিয়ে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু আত্মবিশ্বাসী বঙ্গবন্ধু জীবন-মৃত্যুর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেই বাঙালির স্বাধীনতার প্রশ্নে ন্যূনতম আপস করেননি। বাংলার মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসাই তাঁর আত্মা, মন ও মগজকে পরিপুষ্ট করেছিল। যে প্রাণের মানুষকে তিনি নিজের বিশ্বাসের চেয়েও বেশি আপনার জন ভেবে সবসময় ‘আমার মানুষ’ বলে সম্বোধন করতেন।
বাঙালির আরাধ্য স্বাধীনতা প্রাণপ্রাচুর্যে পূর্ণতা পেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে। দেশে ফিরে সেই প্রিয় বাঙালিকে তিনি কথা দিয়েছিলেন, রক্ত দিয়ে হলেও বাঙালির এই ভালোবাসার ঋণ তিনি শোধ করে যাবেন। চরম অকৃতজ্ঞ ও স্বার্থপর আমরা আমাদের প্রেমময় পিতৃঋণ ভুলতে পেরেছিলাম। নেতার ভালোবাসাকে পায়ে দলতে পেরেছিলাম। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঠিকই তাঁর অমৃত জীবন দিয়ে বাঙালির অবিমৃষ্য ভালোবাসার ঋণ শোধ করে গেছেন।
বঙ্গবন্ধু একাত্তরের ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে জনসমুদ্রে ঘোষণা দিয়েছিলেন, এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-অবাঙালি যারা আছে, তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সবার ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়। বদনামকে এড়িয়ে গিয়ে মানুষের ভালোবাসায় আপ্লুত হতে চাইতেন তিনি। তাই তো ভাষণে, কথায় বা বৈঠকে বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রিয় শিষ্যদের সর্বদা আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম আর আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আদর্শ রাজনীতির শিক্ষাটাই দিতে চাইতেন। তাঁর লক্ষ্যই ছিল ন্যায়নিষ্ঠা ও আদর্শবাদিতা প্রতিষ্ঠা। সেই আদর্শবাদিতা চর্চাটাই হলো বঙ্গবন্ধুকে স্মরণের সত্যিকারের উপযোগ্যতা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা, সমাজতন্ত্র ও সুযোগের সমতাসহ এ জাতীয় মানবতাবাদী নানা নীতিতে সহমত হয়ে এ দেশের মানুষ এক ও অভিন্ন আত্মায় রূপ নিয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় এই অঞ্চলের হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসী, বৈধার্মিক নির্বিশেষে সবার সমান মর্যাদা ও সমঅধিকারের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলাদেশ এনে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার বীর সন্তানরা। আর স্বাধীনতা-সংগ্রামের নেতৃত্ব, ঐক্যের প্রতীক ও দিকনির্দেশনার প্রবাদপুরুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই এখনো বঙ্গবন্ধু বাঙালির আদর্শিক অনুপ্রেরণা। রাজনীতির এমন মহান কবিকে নিয়ে আরেক প্রথিতযশা কবি অন্নদাশঙ্কর রায় যথার্থই লিখেছিলেন :
যতদিন রবে পদ্মা যমুনা
গৌরি মেঘনা বহমান,
ততকাল রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান
দিকে দিকে আজ রক্তগঙ্গা
অশ্রুগঙ্গা বহমান
তবু নাহি ভয় হবে হবে জয়
জয় মুজিবুর রহমান।