- মো. সাখাওয়াত হোসেন
বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ এবং বাঙালি একে অপরের পরিপূরক। কারণ, বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমেই বাংলাদেশের সৃষ্টি। আর আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কাজেই, শেখ মুজিবকে ছাড়া আমাদের স্বাধীনতার প্রাপ্তি অর্থবহ হবে না। আর তাইতো, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর সমগ্র বাঙালি জাতি অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকে, কখন তাদের প্রিয় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের অন্ধকার কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বাঙালির আজীবন লালিত স্বপ্ন স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করবেন। ইত্যবসরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিজয়ের বিষয়টি বিশ্ব গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর নি:শর্ত মুক্তির দাবিটিও প্রত্যক্ষভাবে আলোড়িত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর থেকে বিশ্ব গণমাধ্যম, এমনকি পাকিস্তানের গণমাধ্যমও বঙ্গবন্ধুর বিনাশর্তে মুক্তির বিষয়ে সম্পাদকীয় কলাম লেখে। কারণ, ততদিনে বিশ্ব বুঝতে পেরেছে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ার নানাবিধ যৌক্তিক কারণ ছিল এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু যিনি পাকিস্তানের কারাগারে কারান্তরীন। ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি কুয়ালালামপুরের স্ট্রেইট টাইমস পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বাস্তবতার মুখোমুখি ভুট্টো শিরোনামে লিখে; প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি জনগণকে পাকিস্তানের একটি প্রদেশ হারানোর দিকে ইঙ্গিত করে শেখ মুজিবকে বিনা শর্তে মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের বাস্তবতার দিকে হাঁটা শুরু করেছেন। কারণ শেখ মুজিবকে বন্দী রেখে বহির্বিশ্বে আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং বাঙালিদের মেজাজে কোন পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে না এবং পাকিস্তানের ভাবমূর্তিও নষ্ট হবার উপক্রম। পাশাপাশি অফিসারসহ বন্দী ৯০ হাজার পাকিস্তানি সেনা সদস্যদের মুক্তির পথও বঙ্গবন্ধুর বিনাশর্তে মুক্তির সাথে সম্পর্কিত। অধিকিন্তু শেখ মুজিবকে মুক্তির মধ্য দিয়ে ভারতীয়দের সাথেও আলোচনার দ্বার উন্মুক্ত হবে। কাজেই, ভুট্টোও শেখ মুজিবকে বিনা শর্তে মুক্তি দিতে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
১৯৭২ সালের ৫ জানুয়ারি বিশ্বখ্যাত ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটার বোস্টন পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বিজ্ঞ পদক্ষেপ শিরোনামে লেখা হয়; পাকিস্তানের নেতা ভুট্টো জানিয়েছেন তিনি পূর্ব বাংলার সাথে ফেডারেশনের মতো একটি সম্পর্ক রাখতে চান। বাস্তবে এ ধরনের প্রত্যাশা করা বাঙালিদের সাথে প্রতারণার শামিল। তাছাড়া পূর্ব বাংলা বিশ্বের বুকে এখন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। বরঞ্চ যুদ্ধকালীন সময়ে এবং যুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টিকরণের ক্ষেত্রে গৃহীত সামরিক বিপর্যয়ের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে যে ক্ষতিসাধন হয়েছে তার থেকে সামাল দেবার জন্য উপমহাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে পাকিস্তানের সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করাই একমাত্র পথ হতে পারে। আর এর জন্য শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়ার মধ্য দিয়ে অবিলম্বে ভারতের সাথে আলোচনায় বসা প্রয়োজন। সুতরাং বলা চলে, বঙ্গবন্ধুর নি:শর্ত মুক্তির স্বপক্ষে গণমাধ্যম জোরালো ভূমিকা পালন করে।
অবশেষে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি রাওয়ালপিন্ডি থেকে রয়টার্স বার্তা সংস্থার সংবাদের মাধ্যমে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে লন্ডনে পৌঁছেছেন এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো বিমানবন্দরে শেখ মুজিবকে বিদায় জানান। বঙ্গবন্ধুর লন্ডনে পৌঁছার খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী এবং বাঙালিদের মধ্যে খুশির বন্যা বয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুকে একটিবার দেখার জন্য হোটেল লবিতে ছুটে এসেছিলেন হাজার হাজার জনতা এবং বঙ্গবন্ধু হোটেল থেকে হাত নেড়ে সকলকে অভিবাদন জানান। শুধু কি বাঙালিরাই ছুটে এসেছিলেন, ছুটে এসেছিলেন বৃটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ। বঙ্গবন্ধুকে সম্মান জানাতে তৎকালীন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী সরকারি সফর সংক্ষিপ্ত করে ছিলেন। ঐ দিন বিকেলে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর সাথে চা চক্রে মিলিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধুকে বহন করা গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়েছিলেন যতক্ষণ না বঙ্গবন্ধু গাড়িতে উঠেন। শেষত: ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বিশেষ বিমানে হিথ্রো বিমানবন্দর ছাড়ার পর বিবিসির মাধ্যমে সমগ্র বিশ্ববাসী বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে যাত্রার বিষয়টি সম্বন্ধে অবগত হয়।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ফারুক চৌধুরীর আত্নজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘জীবনের বালুকাবেলায়’ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে সবিস্তারে নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ বর্ণনা প্রদান করেছেন। তিনি লিখেছেন; ১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এর সেই অবিশ্বাস্য সকাল। পালাম বিমানবন্দর। আটটা বেজে দশ মিনিট। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর রুপালি কমেট বিমান। ধীরে ধীরে এসে সশব্দে সুস্থির। তারপর শব্দহীন কর্ণভেদী নীরবতা। সিঁড়ি লাগল। খুলে গেল দ্বার। দাঁড়িয়ে সহাস্যে, সুদর্শন, দীর্ঘকায়, ঋজু, নবীন দেশের রাষ্ট্রপতি। অকস্মাৎ এক নির্বাক জনতার ভাষাহীন জোয়ারের মুখোমুখি। সুউচ্চ কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন তিনি আবেগের বাঁধভাঙা দুটি শব্দ। জয় বাংলা। করতালি, উল্লাস, আলিঙ্গন, তারপর আবেগের অশ্রুতে ঝাপসা স্মৃতি। রাষ্ট্রপতি গিরি, ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের মন্ত্রিসভার সদস্য, কূটনীতিবিদ, শত শত সাংবাদিক। ক্যামেরা, মাইক্রোফোন, টেলিভিশন। অদূরে ক্যান্টনমেন্টের জনবহুল জনসভা। আন্তরিক অভ্যর্থনায় রাস্তার দুপাশের জনতা। রাষ্ট্রপতি ভবন। ঝাপসা স্মৃতিতে আবার ভেসে আসে পালাম বিমানবন্দর। সেই দিন বিমানবন্দরের হাজারো গণ্যমান্য মানুষের ভিড়েও স্মৃতিপটে শুধু ভেসে আসে গাঢ় ধূসর বর্ণের গলাবন্ধ স্যুট আর কালো ওভারকোট পরা নবীন দেশের এই রাষ্ট্রপ্রধানের ছবি। শীতের হিমেল হাওয়ায় অসংখ্য সম্ভাষণ আর আলিঙ্গনে তার ঘন কালো চুলও কিছুটা অবিন্যস্ত। স্বাধীনতা-উত্তর অভিজ্ঞতায় এই প্রথমবারের মতো দিল্লির আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনিত হলো আমাদের রাষ্ট্রপতির সম্মানে একুশটি তোপধ্বনি। তারপর বঙ্গবন্ধুর কুচকাওয়াজ পরিদর্শন। তারপর ব্রাসব্যান্ডে ‘আমার সোনার বাংলা’ আর ‘জনগণ মন’ দুটি দেশকে উপহার দেওয়া বাংলার এক অমর কবির দুটি গানের রেশ সুমধুর। বিমানবন্দরে তার আনুষ্ঠানিক ভাষণে তিনি ভারত এবং ভারতবাসীকে ধন্যবাদ জানালেন। আমার এই যাত্রা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টায় আপনারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, করেছেন বীরোচিত আত্মত্যাগ। তিনি স্মরণ করলেন তার দেশবাসীকে। ‘আমার মানুষের কাছ থেকে যখন আমাকে ছিনিয়ে নেওয়া হলো, তারা কেঁদেছিল, আমি যখন কারাগারে, তারা চালিয়েছিল সংগ্রাম, আর আজ আমি যখন ফিরছি, তারা বিজয়ী। ’অনতিদূরে দাঁড়িয়ে সেই মুহূর্তে দেখেছিলাম তার অশ্রুসিক্ত চোখ।
সেই অশ্রু ছিল ভালোবাসা, গর্ব আর আনন্দের। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতার পর শীতের সেই প্রত্যুষের জনসভাও ছিল এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। বিমানবন্দর থেকে মোটরমিছিলে সভাস্থলে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। প্রথম হিন্দিতে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর পকেটে রয়েছে জনসভার জন্য প্রণীত একটি ইংরেজি ভাষণ। ভাষণটি তার পকেটেই রয়ে গেল। তিনি বাংলায় করলেন তার ভাষণের শুরু। ‘শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, উপস্থিত ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ…।’ তার কথা শেষ না হতেই করতালি, তারপর তার উচ্চারিত প্রতিটি লাইনের সঙ্গে করতালি। জনসভায় বসে আমার মনে হয়েছিল, এটি যেন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আর করতালির দ্বৈত সংগীত। এককথায় যুদ্ধকালিন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া বাংলাদেশীদের আশ্রয় প্রদান ও মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয় স্থাপনে সর্বোপরী মহান মুক্তিযুদ্ধে সার্বিকভাবে (মিত্র বাহিনী গঠন) সহযোগিতা করার জন্য ভারতীয় সরকার ও জনগণকে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন জানান।
রাজনীতিবিদ অলি আহাদের আত্নজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘জাতীয় রাজনীতি: ১৯৪৫ থেকে ৭৫’তে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের উজ্জ্বলতাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন; ‘প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধীর সাথে মত-বিনিময় ও দিল্লী সংবর্ধনা সমাপনের পর অপরাহ্ন ১টা ৪২ মিনিটে বৃটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর কমেট বিমানেই শেখ মুজিব ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করেন। নেতার প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা ও শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ প্রাণঢালা সম্বর্ধনা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে ঢাকা বিমান বন্দর হইতে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পর্যন্ত দীর্ঘপথে লোকে লোকারণ্য হয়। তেজগাঁ বিমান বন্দর হইতে ঢাকা রেসকোর্স পর্যন্ত মাত্র ৪ মাইল পথ ট্রাকযোগে অতিক্রম করিতে ২ ঘন্টারও অধিক সময় লাগে। স্বচক্ষে অবলোকন না করিলে জনগণের এই স্বত:স্ফূর্ত অকৃত্রিম শ্রদ্ধা, ভক্তি ও ভালবাসার গভীরতা অনুধাবন করা অসম্ভব। এই দৃশ্য অভূতপূর্ব; ছিল আবেগপ্রসূত; এই দৃশ্য অবিস্মরণীয় এবং ঐতিহাসিক।’ কাজেই, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাঙালি জাতির নিকট কতটা পার্থিব এবং আগ্রহ ও উন্মাদনার বিষয় ছিল তা সহজেই অনুমেয়। বাঙালির স্বাধীনতা অপূর্ণ থেকে যেতো যদি না বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন না করতেন। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে বাঙালির স্বাধীনতা অর্থবহ ও তাৎপর্যময় হয়ে উঠে।
পরিবারের সদস্যদের নিকট বঙ্গবন্ধুর পরম আকাঙ্খিত স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বিবরণ পাওয়া যায় এম এ ওয়াজেদ মিয়া রচিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক বইটিতে। সমগ্র জাতির ন্যায় পরিবারের সদস্যরা ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধুর দেশে আগমনকে কেন্দ্র করে। যুদ্ধের পুরো ৯টি মাস যে মানুষটির কোন খোঁজ ছিল না সেই মানুষটির প্রতীক্ষায় বাঙালি জাতির ন্যায় বঙ্গবন্ধু পরিবারও ছিল অপেক্ষার সন্ধিক্ষণে। রেসকোর্স ময়দানের বিশাল সমাবেশের পর শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে সাড়ে ছয়টার দিকে ধানমন্ডির ১৮ নম্বর বাসায় আসেন বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক। ঐ বাসায় বঙ্গবন্ধুর আব্বা আম্মা, শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব ভাই-বোন ও তাদের ছেলে মেয়েরা এবং তার অন্যান্য আত্নীয় স্বজনও বাসায় এসে একত্রিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাতের প্রত্যাশায়। বঙ্গবন্ধু বাসায় পৌঁছামাত্র সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে সবাই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। বঙ্গবন্ধু নিজেও সারাক্ষণ কান্না করেছিলেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পরিস্থিতির ঘাত-প্রতিঘাতে বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে যুদ্ধের পুরো সময় পাকিস্তানি সরকার নানাভাবে নির্যাতন করেছিলো। সেই অবস্থায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে অন্তরীন। সেখান থেকে যুদ্ধের পরে বঙ্গবন্ধুকে পরিবারের সদস্যদের নিকট ফিরে পাওয়া পরিবারের সদস্যদের নিকট অকল্পনীয় ঘটনা ছিল। বাবা-মায়ের আদরের খোকা ফিরে এসেছে স্বাধীন দেশে বীরের বেশে, প্রিয় স্ত্রী ফজিলাতুন নেছা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিলো স্বামীর জন্য, সন্তানদের অপেক্ষা বাবার জন্য। সকলের প্রিয়জন বঙ্গবন্ধুকে কাছে পেয়ে পরিবারের সদস্যদের যে অনুভূতি এবং আবেগদীপ্ত বাসনা তা ফুটে উঠেছিল ১৯৭২ সালের ১০ ই জানুয়ারির সন্ধ্যায়।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর সমগ্র বাংলাদেশের চিত্র তুলে ধরতে ১১ জানুয়ারি দৈনিক বাংলা লিখেছিল, রূপালী ডানার মুক্ত বাংলাদেশের রোদ্দুর। জনসমুদ্রে উল্লাসের গর্জন, বিরামহীন করতালি, শ্লোগান, আর শ্লোগান, আকাশে আলোকিত হচ্ছে যেন এক ঝাঁক পাখি, উন্মুক্ত আগ্রহের মুহূর্তগুলো দুরন্ত আবেগে ছুটে চলেছে, আর তর সইছে না, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসেছেন, রক্তস্নাত বাংলার রাজধানী ঢাকা নগরীতে, দখলদার শক্তির কারাপ্রাচীর পেরিয়ে..আমার সোনার বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের নয়নমণি, হৃদয়ের রক্তগোলাপ শেখ মুজিব এসে দাঁড়ালেন। আমাদের প্রত্যয়, আমাদের সংগ্রাম, আমাদের শৌর্য, বিজয় আর শপথের প্রতীক, বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন তাঁর স্বজনের মাঝে, চারধারে উল্লাস করতালি, আকাশে নিক্ষিপ্ত বদ্ধমুষ্টি, আনন্দে পাগল হয়ে যাওয়া পরিবেশ-যা অভূতপূর্ব, শুধু অভূতপূর্ব, এই প্রাণাবেগ অবর্ণনীয়।’এককথায় বাংলাদেশের জনগণের বঙ্গবন্ধুর প্রতি যে অসীম ভালবাসা ও সীমাহীন প্রীতি ছিল তার পরিপূর্ণ সম্মিলন ঘটে ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সীমাহীন আলোকবর্তিকা রয়েছে বাঙালির জীবনে। তিনি প্রত্যাবর্তনের দিনে ১৭ মিনিটের যে আবেগময় ও গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা প্রদান করেছিলেন তার প্রতি পরতে পরতে দেশ গঠনের সঠিক দিক নির্দেশনা ছিল এবং অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন উপস্থিত বিশাল জনতার সামনে। তিনি বলেছিলেন; ‘এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়। এই স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না যদি আমার বাংলার মা-বোনেরা ইজ্জত ও কাপড় না পায়। এই স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না যদি এ দেশের মানুষ, যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে তারা চাকুরি না পায়, কাজ না পায়।’ যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশ গঠনে কোন বিষয়গুলির উপর গুরুত্বারোপ করা হবে সে বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। কাজেই, বাঙালির জীবনে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তন অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে।