- নাদীম কাদির
জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত আসে যখন আপনাকে থমকে দাঁড়াতে হয়। আমার জীবনে যতোটা না ভালোবাসার উষ্ণ অভ্যর্থনা, হাসি-আনন্দ পেয়েছি তার চেয়েও বেশি দেখেছি দুঃখ এবং গ্লানি।ভালোবাসার অভাবটা বুঝতে শুরু করেছিলাম ১৯৭১ এ স্বাধীনতা যুদ্ধে বাবাকে হারানোর পর। সেই ভালোবাসাই যেনো আরও দুর্লভ হয়ে ওঠে ১৯৯৯ সালে মায়ের মৃত্যুর পর। গোটা পৃথিবী যেনো ভেঙে পড়েছিলো আমার ওপর। নিষ্ঠুর পৃথিবীতে টিকে থাকার সংগ্রামে নামলাম। অর্থ-সম্পত্তির মোহে ছিন্ন হলো রক্তের সম্পর্ক। একা হয়ে গেলাম আমি, বেদনার্ত এক ভালোবাসার কাঙালে পরিণত হলাম যেনো।
এক নবীন প্রতিবেদক হিসেবে যেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হলো সেদিন থেকেই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার এক স্নেহডোরে বাঁধা পড়েছিলাম আবার। এরপর বহুবার তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে বঙ্গবন্ধু ভবন, সুধা সদনে এবং সাবেক বিরোধীদলীয় নেতা থাকাকালীন সময়ে মিন্টো রোডের বাসভবনে। তিনি পাশে থাকলে তাঁর আন্তরিকতায় সব দুঃখ বেমালুম ভুলে যেতাম।
কেমন যেনো এক চৌম্বকীয় আকর্ষণ তাঁর। আপাদমস্তক মাটির মানুষটি সব সময় বড় বোনের মতো আগলে রেখেছেন কিংবা বলা ভালো মায়ের মতোই।
লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার মাত্র কয়েকদিন পর আমার জন্য যেনো আরও চমক অপেক্ষা করছিলো। দিনটি ছিলো ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর। তাঁর সঙ্গে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে সাক্ষাৎ হলো।
দেশ ও তাঁর প্রতি কর্তব্য পালনের সুযোগ দেয়ায় তাকে ধন্যবাদ জানাতেই তিনি আশীর্বাদ করে বললেন, ‘আমাকে ধন্যবাদ দেয়ার দরকার নেই। ভালোভাবে দেশের জন্য কাজ করো’। আমার কাঁধে হাত রেখে আশ্বস্ত করেন তিনি। সে মুহূর্তে ইয়াসিন কবীর জয়ের তোলা ছবিটি আমার কাছে এক মহামূল্যবান সম্পদ। ফেসবুকে লিখেছিলাম, আমি তাঁর স্নেহ-ভালোবাসা পেয়ে ধন্য এবং অনুভব করেছিলাম এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে কেউ আছেন আমার।
এমনই আরেকটি স্মরণীয় মুহূর্তের জন্ম হলো ২০১৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে। গার্ডিয়ান পত্রিকার একটি কপি তাঁর হাতে দেয়ার পর আমার প্রধানমন্ত্রী, আমার আপা পত্রিকাটিতে তাঁর সাক্ষাৎকারের জন্য সাধুবাদ জানান। সাক্ষাৎকারটি নিয়ে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখান তিনি। তাঁর সঙ্গে কয়েকটা ছবিও তোলা হলো। এরপর তাঁকে টেলিভিশনে ব্রিটিশ-বাংলাদেশীদের ঈদের শুভেচ্ছা জানানোর অনুরোধ জানালাম। তিনি অনুরোধ রাখলেন এবং তাৎক্ষনিকভাবে চার মিনিটের একটি নিরেট এবং সময়োপযোগী বক্তব্য দিয়ে মুগ্ধ করে দিলেন।
আবার বিমানে ওঠার সময় তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করে বললাম, ‘এটা ঈদের জন্য, সালামী দিবেন না’। আমার আপা ব্যাগ থেকে টাকা বের করে আমাকে সালামী দিলেন। ১৯৭৪ সালে মায়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে ৫’শ টাকা সালামী দিয়েছিলেন সেদিন। বঙ্গবন্ধু আমার মাকে সরকারি চাকরি দিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার কয়েক মাস আগে মাকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসার ব্যবস্থা করেছিলেন।
তিনি সবসময় আমার শহীদ বাবার ত্যাগের স্বীকৃতি হিসেবে আমাদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন, কল্যাণে সচেষ্ট থেকেছেন। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনাও।
এখন তাঁর কন্যার কাছ থেকে পেলাম। ১৯৯৯ তে আম্মাকে হারানোর পর থেকে তিনি পাশে আছেন। লন্ডন আসার আগে তাঁর আশীর্বাদ পেয়েছি, আর এবার লন্ডনে পেলাম স্নেহের সালামি। খুশিতে কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছে। ধন্যবাদ আল্লাহ। আমার এমন কেউ আছেন যিনি আমাকে ভালোবাসেন, আমার ভালোমন্দ দেখেন। আপা, আপনি আমাকে যা দিয়েছেন ‘ধন্যবাদ’ শব্দটি আপনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে লন্ডনে তিনি আমাকে এক গুরুদায়িত্বই দিয়েছেন। তাঁর সহযোগিতা এবং দোয়ায় তা পালন করে যাচ্ছি। আমার জন্য দোয়া করবেন আপা। বন্ধুরাও দোয়া করবেন। আমি আর একা নই। এক নতুন জীবনই আমি উপহার পেয়েছি লন্ডনে এই নতুন মিশনে।
আমার আপা, আমাদের প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘজীবী হন। যতদিন বেঁচে আছি ততোদিন যেনো আপনার আশীর্বাদ পাই।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় শেখ হাসিনা।
চ্যানেল আই অনলাইন