- সাবিত খান
বাঙ্গালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আগেই সদ্য স্বাধীন এই রাষ্ট্রটিকে স্বীকৃতি দেয়ার প্রশ্নে পশ্চিমা বিশ্বের তৎপরতা ছিলো উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বর্বর পাকিস্তানকে সমর্থন দেয়া যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখায় প্রয়াসী হলেও পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টোর অনুরোধ, পাকিস্তানের আরেক মিত্র চিনের ভূমিকা, সাবেক পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান ঋণদাতা হিসেবে ও এই অঞ্চলে সোভিয়েত প্রভাব বিস্তার এবং ভারতীয় সেনাদের বাংলাদেশে অবস্থান প্রভৃতি নানা বিষয় ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জোর বিবেচনার বিষয়।
২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি থেকে ২০০৯ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়কালে ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট এর আর্কাইভ থেকে অনলাইনে প্রকাশিত গোয়েন্দা তথ্য এবং নথি থেকে এই বিষয়গুলো প্রকাশ পায়। সদ্য স্বাধীন দেশটির ভবিষ্যত সম্পকে যুক্তরাষ্ট্রের পর্যালোচনা, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটসহ নানা বিষয় উঠে আসে সেসব নথিতে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর বাংলাদেশের সাথে ন্যুনতম কনফেডারেল ব্যবস্থা বজায় রাখার প্রয়াসে বাংলাদেশকে দ্রুত স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টিতে পক্ষে, বিপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্লেষণ উঠে আসে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র স্বীকার করে যে স্বাধীন বাংলাদেশই ছিলো বাস্তবতা। তবে ভুট্টোর অনুরোধ এবং পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশের সাথে সাময়িকভাবে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ রাখারা সিদ্ধান্ত নেয় যুক্তরাষ্ট্র। তবে সদ্য সাবেক পুর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে একত্রিত করার ভুট্টোর আকাঙ্খার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ছিলো নেতিবাচক। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ক্ষেত্রেও নমনীয় ছিলো তারা। ভুট্টোও পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালের এপ্রিলের শুরুর দিকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার প্রশ্নে তার আপত্তি প্রত্যাহার করে।
বাংলাদেশের সাথে সংযোগ রক্ষায় ভুট্টোর আশা পূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা কম হলেও স্বাধীন বা ‘কনফেডারেশনাল দেশটির’ সাথে জাতিসংঘের মাধ্যমে মানবিক সহায়তা প্রদানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয় যুক্তরাষ্ট্র। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব বিস্তার করার দুশ্চিন্তাও ছিলো যু্ক্তরাষ্ট্রের। সোভিয়েত পন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নেতা মোজাফ্ফর আহমেদ, বর্ষিয়ান নেতা মাওলানা ভাসানী, হিন্দু ধর্মীয় বাম নেতা মনোরঞ্জন ধর, কমিউনিস্ট মনি সিং যথেষ্ট যৌক্তিক উদ্বেগের কারণ ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য।
স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে উদ্দেশ্য করে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক পত্রে বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ এবং সমতাবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। এরকমই একটি পত্র যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনও জানুয়ারির ৪ তারিখ গ্রহণ করেছিলো।
চিত্র: (বাম থেকে) রিচার্ড নিক্সন, হেনরি কিসিঞ্জার
যুক্তরাষ্ট্রের কাউন্সেল জেনারেল স্পিভাক এর সাথে আলোচনা কালে বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি করেন। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বিভিন্ন বিষয় সমাধানের জন্য ‘সাবেক পশ্চিম পাকিস্তানে’র সাথে সম্পর্ক রাখার প্রয়োজনীয়তাও স্বীকার করেন তিনি। তবে এর জন্য আলোচনা এবং ভবিষ্যতে পাকিস্তানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য বঙ্গবন্ধুর মুক্তি গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন তিনি।
জানুয়ারির ১০ তারিখ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনটিতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার প্রশ্নে প্রেসিডেন্ট নিক্সন জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপ-সহকারি আলেক্সান্ডার হেইগের আসে আলোচনাকালে পাকিস্তান এবং চীন কখন নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দিতে পারে বলে প্রশ্ন করেন। এবং তাদের স্বীকৃতি দেয়ার আগে পর্যন্ত অপেক্ষা করার কথাও বলেন। বিষয়টিতে যুক্তরাষ্ট্রের সতর্ক অবস্থানের বিষয়ে দু্জনই একমত হন। বাংলাদেশের সাথে ন্যুনতম ‘ওয়ার্কিং রিলেশন’ বজায় রাখার চেষ্টা ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের।
যুক্তরাষ্ট্রের বিবেচনায় আরও ছিলো বাংলাদেশে ভারত এবং সোভিয়েত নির্ভরতা সীমিত রাখা। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পূর্ব থেকেই বন্ধুত্বপুর্ণ আওয়ামী লীগ কার্যকরি একটি সম্পর্ক গড়ে তুলতে সচেষ্ট থাকায় দ্রুতই দেশটিকে স্বীকৃতি দেয়াটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অনুকূল ছিলো। সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য মাঠ খালি রাখাটাও দেশটির জন্য ছিলো ঝুকিপূর্ণ। দ্রুত স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রতি আরও উদার দৃষ্টিভঙ্গির বাংলাদেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে পারার একটি সুযোগও ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের।
সদ্য বিভক্ত পুর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সম্পত্তি ও দায় নিয়ে সৃষ্ট জটিল আর্থিক সমস্যা বিবেচনাতেও দ্রুত স্বীকৃতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিবেচনায় ছিলো লাভজনক। যেহেতু ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত পাকিস্তানের প্রধান ঋণদাতা দেশ যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়াও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস এবং গণমাধ্যমের পক্ষ থেকেও চাপ ছিলো।
বঙ্গবন্ধুর ‘অঙ্গুলি হেলনে চলা বাংলাদেশ’এ বিশাল ব্যক্তিত্বের এই নেতার নেতৃত্বের বিষয়টিতে সন্দেহের অবকাশ ছিলা না যুক্তরাষ্ট্রেরও। বঙ্গবন্ধুর ‘ব্রিটিশ আদলে সমাজতান্ত্রিক’ ভাবমূর্তির এবং তর্কাতীত নেতৃত্বগুণের বিষয়টি তুলে ধরে তার বর্তমানে অথবা অবর্তমানে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যত সরকারের রূপরেখা বিষয়ক একটি বিশ্লেষণ উঠে আসে তাদের গোয়েন্দা নথিতে। সেখানে এদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘গৃহযুদ্ধ’ হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর আগমনে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের প্রাধান্যে সরকার গঠিত হবে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে গঠিত সরকারটি হবে আওয়ামী লীগ, চার মাস আগে গঠিত বাংলাদেশ উপদেষ্টা কমিটির কিছু মধ্যবামপন্থী, এবং সম্ভবত মুক্তি বাহিনীর কমান্ডারদের নিয়ে।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরেও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য পশ্চিমা তৎপরতা অব্যাহত ছিলো। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর এডওয়ার্ড হেথ এর একটি বার্তা দেশটির দূতাবাস থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে দেয়া হয়। সেখানে লন্ডনে পাকিস্তানের কারাগার থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া বঙ্গবন্ধুর সাথে বৈঠকে সাবেক পুর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক সংযোগ না থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে পশ্চিমা দেশগুলোকে দ্রুতই স্বীকৃতির পথে যাওয়া উচিত বলে অভিমত ব্যক্ত করা হয়। পাকিস্তানকেও অবশ্যম্ভাবীভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য প্ররোচিত করার বিষয়টি বলা হয়।
১৩ জানুয়ারি নিক্সনকে পাঠানো অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ম্যাকমোহন এর বার্তায় দক্ষিণ এশিয়ায় সোভিয়েত প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এবং ভারতের সম্পর্ক স্বাভাবিক করা এবং নতুন জন্ম নেয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে সহায়তা প্রদানের জন্যও বলা হয়।
নানা আলোচনা, বিশ্লেষণ, তর্কবিতর্কের পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব হেনরি কিসিঞ্জার চিনের সাথে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের বৈঠকের পর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানান। বিষয়টি নিষ্পত্তি প্রশ্নে বেশ কয়েকটি তারিখ ঘোষণা করা হলেও অবশেষে ১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে হোয়াইট হাউজ থেকে পাঠানো একটি বার্তায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টি জানানো হয়।