স্মৃতি শ্রদ্ধায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব

- ফজলে রাব�?বি  

ক.
আগরতলা মামলাকে কেন্দ্র করে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র পাকিস্তানে। সেই মামলার একজন বিচারক বর্ধমান হাউসে (বর্তমান বাংলা একাডেমি)’র পাশের ভবনে থাকতেন। সেটি তখন ছিল সরকারি গেস্ট হাউস। একদিন ক্রুদ্ধ জনতা সেই বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলো। জজ সাহেব পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করলেন। আন্দোলনের তোড়ে অবশেষে বঙ্গবন্ধু ছাড়া পেলেন। মনে আছে সেদিন আমি ও সরদার ফজলুল করীম সাহেব কোনো একটা কাজে ড. দীন মোহাম্মদ সাহেবের নির্দেশে মতিঝিলে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস অফিসে গিয়েছিলাম। তাঁর ম্যানেজার রিয়াজুল ইসলাম সাহেবের বাড়ি ছিল ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের বিপরীতে লেকের ধারে, ঠিক বঙ্গবন্ধুর বাড়ির উল্টো দিকে। সেখান থেকে ফোনে খবর এলো- বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়েছেন এবং তাঁকে দেখার জন্য সেখানে জনতার ঢল নেমেছে। সরদার সাহেবকে বললাম ‘চলেন সেখানে যাই’। রিয়াজুল ইসলাম সাহেব বললেন তাঁর সঙ্গে তাঁর বাড়িতে যেতে। কারণ সেখান থেকেই বঙ্গবন্ধুকে সহজে দেখা যাবে। সেদিন বঙ্গবন্ধুকে একনজর দেখার জন্য সমস্ত ঢাকা শহরের মানুষ পাগল হয়ে গিয়েছিল। আমরা ইসলাম সাহেবের সঙ্গে তাঁর বাড়িতে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম যে কখন বঙ্গবন্ধুকে দেখা যায়। তিনি বোধহয় এক ঝলকের জন্য বারান্দায় এসেছিলেন, কিন্তু আমরা দেখতে পাইনি। শুনলাম তিনি শহীদ মিনারে গিয়ে বক্তৃতা করবেন। ছুটলাম শহীদ মিনারে। সেখানে গিয়ে শুনলাম তিনি পল্টন ময়দানে যাবেন। আমরা পল্টনে গেলাম। সেখানে তাঁকে দেখলাম। তখন প্রায় সন্ধ্যা নেমেছে শহরজুড়ে।

খ.
আমার জীবনে প্রথমবার জাপান ভ্রমণ নানাকারণে বিশেষভাবে স্মরণীয়। আমি যখন জাপানে তখন বঙ্গবন্ধু জাপানে গিয়েছিলেন। তাঁর ইমেজ তখন আকাশছোঁয়া। টোকিওতে অবস্থিত সকল বাঙালিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য। আয়োজনটা হয়েছিল খুব বড় একটা হোটেলে, হোটেলের নামটা মনে করতে পারছি না। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে তাঁকে একনজর দেখার জন্য কী দৌড়াদৌড়ি করেছি, সে কথা আগে বলেছি। তাঁরপর মুক্তিযুদ্ধকালে বঙ্গবন্ধুর জন্য সে কী দোয়া দুরুদ প্লানচেট! সেই বঙ্গবন্ধুকে অতি নিকট থেকে দেখার সুযোগ পেলাম ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসের কোনো একদিন, বিদেশের মাটিতে। সেদিনের বঙ্গবন্ধু কী বিশাল! এখন ভাবতে অবাক লাগে। প্রচন্ড উত্তেজনা নিয়ে যথাসময়ে হোটেলে পৌঁছলাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই তিনি উপস্থিত হলেন আমাদের মাঝে। আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। ধীরে ধীরে তাঁর একেবারে সামনে গিয়ে উপস্থিত হলাম। অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন বঙ্গবন্ধু আমার দিকে চোখ ফেলতেই আমি তাঁর পায়ে হাত দিয়ে সালাম না করে পারলাম না। তিনি বললেন,‘থাক থাক। তোর বাবা মা কেমন আছেন? তুই দেশে ফিরবি কবে?” প্রশ্নদুটো এমনভাবে করলেন যেন আমাকে তিনি কতকাল ধরে চেনেন! আভিভুত হয়ে তাঁকে কী বলেছিলাম মনে নেই। তবে সে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর আর একটা কথা মনে দাগ কেটেছিল। তিনি বলেছিলেন দেশের জন্য জাপান থেকে কিছু শিখে যেতে।

জাপান থেকে ফিরে এসে দেখি প্রচন্ড উৎসাহে বাংলা একাডেমি প্রেসে এবং গ্রাফিক আর্ট ইনসটিটিউট প্রেসে বঙ্গবন্ধুর জীবনী মুদ্রিত হচ্ছে। আমি জাপান যাবার পূর্বেই আমাদের নিজেদের ছাপাখানা আংশিক চালু হয়ে গিয়েছিল। ছাপাখানার কিছু যন্ত্র স্থাপিত হয়েছিল; কিন্তু পরিচালনার জন্য কোনো ওয়ার্কিং মুলধন ছিল না। শ্রমিকদের বেতনের জন্য বাজেটে কোনো বরাদ্দ ছিল না। অথচ প্রেস চালাতে হবে। তাই সঠিক ও উপযুক্ত পরামর্শ লাভের জন্য কয়েকজন প্রেস বিশেষজ্ঞ নিয়ে একটি সাবকমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেখানে সদস্য করে নিয়ে এসেছিলাম গ্রাফিক আর্ট ইনসটিটিউট-এর প্রিন্সিপাল রশিদ সাহেবকে। প্রেস পরিচালনার জন্য কোনো অর্থ বরাদ্দ ছিল না। আমরা স্থির করলাম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রেস পরিচালনা করবো। অর্থাৎ বাইরের প্রেসে যে হারে বই ছাপা হয় একাডেমি প্রেস সেই হারে একাডেমির বই ছাপবে। তবে মুদ্রণ-খরচ অগ্রিম গ্রহণ করবে। তখনই বঙ্গবন্ধুর জীবনী মুদ্রণের আংশিক দায়িত্ব গ্রাফিক আর্ট ইনসটিটিউট-এর ওপর দেওয়া হয়। কেবল তাই নয় দেখলাম একাডেমির আরও কয়েকজন অফিসারও বঙ্গবন্ধুর জীবনী লিখছেন। অবিলম্বে সেগুলো লেখা শেষ হবে এবং ছাপাখানায় যাবে। এগুলোর কোনোটি হবে ছোটদের, কোনোটি হবে ষষ্ঠ শ্রেণীর ও কোনোটি হবে একাদশ শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য। টার্গেট ছিল ১৬ ডিসেম্বরে প্রধান বইটি বঙ্গবন্ধুর হাতে দেওয়া হবে। কিন্তু কলেবর বৃদ্ধি রোধ করা যাচ্ছিল না, সেই সঙ্গে ছিল সংশোধন। তারিখ  কেবলই পিছিয়ে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ৭৪ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে আমরা মহাপরিচালকের সঙ্গে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে গেলাম বইটি বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেয়ার জন্য। আমিও গিয়েছিলাম আর লেখকবৃন্দও গিয়েছিলেন। আমরা নিচের ঘরে অপেক্ষা করতে লাগলাম। সেখানে দেখলাম অনেকগুলো আলমারি বইতে ঠাসা। আলমারিগুলোতে কোনো তালা লাগানো নেই। ভাবলাম খুলে দেখি। কিন্তু না, স্ক্রু মেরে কপাট বন্ধ করে রাখা হয়েছে। ঠিকই আছে। যে হারে লোকজন আবদার নিয়ে আসে- কে কোন বই নিয়ে চলে যাবে ঠিক নেই। অনেকখানি সময় অপেক্ষা করার পর একজন এসে জানালো বঙ্গবন্ধু সকলকে উপরে যেতে নিষেধ করেছেন। মহাপরিচালক সাহেব একাই গেলেন দোতালায়। অল্প সময় পরই তিনি ফিরে আসলেন। তার চেহারা একটু মলিন মনে হলো। তবু তিনি বললেন ,‘বঙ্গবন্ধু খুশি হয়েছেন’।

গ.
ড. নীলিমা ইব্রাহিম বাংলা একাডেমি থেকে চলে যাবার পর ড. মযহারুল ইসলাম বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক নিযুক্ত হলেন। তাঁর এই নিযুক্তি আমাদের জন্য স্বস্তি ও আনন্দ বয়ে আনলো। তবে এই আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হলো না। তিনি একাডেমিতে যোগদানের আগে ও পরে চলছিল বাকশালে কে যোগদান করবে আর কে করবে না তা নিয়ে তথাবার্তা, অঘোষিত এক প্রতিযোগিতা। নবীনদের অনেকের মত তিনি নিজেকে এ ক্ষেত্রে একটু দূরেই রেখেছিলেন। তিনি একাডেমিতে যোগদান করার কিছুদিন পর ঘটল সেই সাংঘাতিক ঘটনা। ১৫ আগস্টের ঘটনা। এর আগেরদিন আমার ছেলে শাফকাত রাব্বি স্কুল থেকে ফিরে বললো যে আগামী দিন বিশেষ পোষাকে স্কুলে যেতে হবে। তাকে ভর্তি করেছিলাম ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে।  ১৯৭৫ সালে সে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। ১৪ আগস্ট স্কুল থেকে ফিরে বললো যে আগামীকাল বঙ্গবন্ধু ইউনিভার্সিটিতে আসবেন এবং তাঁকে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের কিছু ছেলে-মেয়ে মালা দিয়ে অভ্যর্থনা জানাবে। এই ছেলেদের মধ্যে থাকার জন্য তাকে নির্বাচিত করা হয়েছে। সেজন্য বিশেষ পোশাক ও জুতো পরতে হবে। সেই জুতো তার নেই। বাধ্য হয়ে সন্ধ্যায় তাকে নিয়ে জুতা কিনতে হয়েছিল। পরদিন বঙ্গবন্ধুকে তথা রাষ্ট্রপতিকে সে অভ্যার্থনা জানাবার জন্য যাবে এই উত্তেজনা নিয়ে শুতে গিয়েছিল। কিন্তু খুব ভোরে টেলিফোন করে আমার ভগ্নিপতি মাসুদ আমাকে কিছু বললো না, শুধু রেডিও শুনতে বললো। সেখানে শুনলাম ভয়াবহ সংবাদ ‘বঙ্গবন্ধু আর নেই’, বঙ্গবন্ধু খুন হয়েছেন। মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। ভেবেছিলাম সুসংগঠিত আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতা ও কর্মী রয়েছে, রয়েছে শক্তিশালী রক্ষী বাহিনী, তারা নিশ্চয়ই পথে নেমে আসবে। না, কিছুই হলো না। আমরা দু’একদিন অপেক্ষা করলাম। এরপর যথারীতি জীবনের নিয়মে জীবন চলতে লাগলো, রাজনীতি চলতে থাকলো রাজনীতির নিয়মে।

SUMMARY

308-1.jpeg