বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়

- ড. রেহমান সোবহান  

একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় অবদান এই যে, তিনি ১৯৭১-এর মার্চে বাংলাদেশের সব মানুষের মনে সার্বভৌমত্বের বা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা বা ধারণা গেঁথে দিতে পেরেছিলেন। তিনি যখন স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তখন তার প্রতি জনগণের অকুন্ঠ ও অবাধ সমর্থন আর নিরঙ্কুশ নির্বাচনী ম্যান্ডেট রয়েছে। ফলে জনগণের ওপর তখণ তার প্রশ্নাতীত ও অবিসংবাদিত কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত। স্বাধীনতা ঘোষণার বিভিন্ন প্রেক্ষাপট ও বাস্তবিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান-এর ইংরেজি লেখাতে যার ভাষান্তর করেছেন শাহীন রেজা নূর।

বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক সংগ্রামে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক ও মওলানা ভাসানীর মতো গুটিকং ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। তবে বাঙালিদের মনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনার স্ফূরণ ঘটানোর জন্য যে রাজনৈতিক উদ্যম প্রয়োজন ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাই সেক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজটি করেছিলেন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দাবি পেশ করার পর ১৯৬৯-এর মার্চ থেকে ১৯৭১-এর মার্চ অবধি দুটি বছরের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত হন। এর মাঝে আবার ঐতিহাসিকভাবে গভীর তাৎপর্যবাহী একটি নির্বাচনী অভিযান পরিচালনার মধ্য দিয়ে তার নেতৃত্বের অন্য সাধারণ রূপটি ফুটে ওঠে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের ভেতরকার বা এর বাইরের কোন সংগঠনের কারও নাম উল্লেখ না করেই বলা যায়, তিনি তার দলের উর্ধ্বতন ও ত্যাগী সহকর্মী এবং তরুণ রাজনৈতিক কর্মীদের কাছ থেকে তো বটেই, এমনকি দেশের সব, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসীদরে কাছ থেকে নিরঙ্কুশ সহযোগিতা ও সমর্থন লাভ করেছিলেন। মোদ্দাকথা, তিনি তার নিজ দল ও বিভিন্ন সংগঠনে বা বিভিন্ন স্তরে অবস্থানরত সবাইকে এক পতাকার নিচে সমবেত করে তাদের মাঝে ইস্পাত-দৃঢ় ঐক্যের চেতনা সঞ্চার করেছিলেন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বিস্তুত রাজনৈতিক সংগ্রামকালে এসব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ রাখাটা তার এক অন্যন্য কীর্তি, বাঙালিদের মধ্যকার সামান্য অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে পাকিস্তানি শাসকরা যাতে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবি থেকে বিচ্যুত করতে না পারে সে জন্য বঙ্গবন্ধু অতন্ত্র প্রহরীর মতো সদা-সজাগ থেকেছেন। এই আলোচ্য দুটি বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জনগণের অবিসংবাদিত নেতা এবং তাদের জাতীয় আশা-আকাঙ্খার মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠেন। এ সময়কালেই একটি রাজনৈতিক দলের প্রধানের পরিচয় ছাপিয়ে তিনি এই বাংলায় ও বাংলাদেশের মানুষের কাছে যেন কিংবদন্তি হয়ে উঠলেন। দেশের আনাচে-কানাচে যেখানেই তিনি যান সেখানেই এই মহানায়ককে এক নজর দেখার জন্য সেখানকার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার সে কি উচ্ছাস আর হৃদয়-উদ্বেল করা সে কি প্রাণান্তকর প্রয়াস। তিনি ব্যক্তিগতভাবে যদি ওইসব এলাকা সফর না করতেন তবুও সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের বিজয় ছিল অবধারিত; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের মহিমা দলকে অতিক্রম করে বাঙালিদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীকী রূপ ধারণ করেছে তখন।ফলে তার উপস্থিতি জনগণের নিরঙ্কুশ সমর্থন লাভের ব্যাপারে সবচেয়ে মোক্ষম ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বাঙালিদের মনে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা তিনিই সৃষ্টি করেছিলেন।অন্যান্য বাঙালি নেতা অবশ্য এর ক্ষেত্র প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। তবে বঙ্গবন্ধুর এই আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার বিষয়ক বার্তাটি ক্রমান্বয়ে জনগণের মনে প্রোথিত হয়। আরেএকে কাঠো করে দেখার কোনো অবকাশই নেই। বঙ্গবন্ধুর প্রতি বাংলাদেশের মানুষের নিরঙ্কুশ সমর্থন জ্ঞাপনের বিষয়টি ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। ওই নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ একাই লঅভ করে ১৬৭টি আর মোট প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৭৫টিই পড়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের বাক্সে।

এ নির্বাচনী রায় নিয়ে ইয়াহিয়া ও বুট্টো উভয়েই এক প্রকার আত্মপ্রবঞ্চনার আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারা ধরেই নেন যে, এই রায় বাঙিালিদের সহজাত ভাবাবেগতাড়িত বিষয় আর ১৯৭০-এর নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাপারে সরকারের প্রতি নেতিবাচক মনোভাবে বহিঃপ্রকাশ, যা প্রধানত শহরাঞ্চলের মানুষদের বা মধ্যবিত্তদের অস্বাভাবিক আচরণের প্রতিফলন ছাড়া কিছু নয়। ১৯৭১-এর গোঁড়ার দিকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠকে বসার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ভুট্টো ও ইয়াহিয়ার বিশ্বাস ছিল যে, ঠিক মোক্ষম সময়ে বঙ্গবন্ধুকে তার পূর্ববর্তী বাঙালি নেতাদের মতোই ৬-দফার ব্যাপারে আপসরফায় রাজি করানো সম্ভব হবে। কেন্দ্রে ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারা বিষয়ে বঙ্গবন্ধুকে প্রেলুবদ্ধ করে কার্যসিদ্ধি সম্ভব বলে ভেবেছিলেন তারা। কিন্তু ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১-এর মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের মনে যে প্রচান্ড ও ব্যাপক আত্মসচেতনতাবোধ জেগে উঠেছিল পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা তা অনুধাবন করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হন। ১৯৭১-এ ইয়াহিয়ার বাংলাদেশ সফর ও ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠকের আগে ফেব্রুয়ারিতে লারকানায় ভুট্টোর সঙ্গে তার বৈঠকের মধ্য দিয়ে যে চক্রান্তের সূত্রপাত ঘটে তা বিপরীতক্রমে একটি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে অবধারিত করে তোলার সব ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়। ইয়াহিয়া ’৭১-এর ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ১ মার্চ অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলে বাংলার মানুষ বুঝে যায় যে এটি ’৭০-এর নির্বাচনের গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেটের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র।

১৯৭১-এর মার্চ: বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় সচেতনতা সৃষ্টি
বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণকে সাধারণভাবে আমাদের জাতিসত্তার অস্তিত্ব ঘোষণার ভাষণ হিসেবে মনে করা হয়ে থাকে। অবিশ্যি, বটে, কোনো এক ঘোষণায় একটি জাতিসত্তার উন্মেষ বা আবির্ভাব ঘটে না। রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের মধ্যেই নিহিত থাকে জাতিসত্তা বিকাশের বীজ। একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় অবদান এই যে, তিনি ১৯৭১-এর মার্চে বাংলাদেশের সব মানুষের মনে সার্বভোমত্বের বা স্বাধীনসত্তার আকাঙ্খা বা ধারণা গেঁথে দিতে পেরেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু, ইয়াহিয়া খান কর্তৃক জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার সিদ্ধান্তের জবাব দিয়েছিলেন অসহযোগ কর্মসূচি ঘোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীকে একাট্টা করে। তার এই অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ যেভাবে সমর্থন দিয়েছিল তা বিশ্বের গণতান্ত্রিক ও মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর ওই অসহযোগ আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে শুধা বাংলাদেশের সাধারণ জনগণই যোগদান করেনি; এতে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষী বাহিনীর সদস্যবর্গ এবং ব্যসায়ী  সম্প্রদায়ও সানন্দে যোগ দিয়েছে ওই অসহযোগ আন্দোলনে। ক্রমান্বয়ে এমনই এক বিরল রূপ পরিগ্রহ করল যে জে. ইয়াহিয়া খানের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি অনুগত বেসামরিক প্রশাসন তাদের আনুগত্য আনুষ্ঠানিকভাবে পরিত্যাগ করে বাংলাদেশের ওপর প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধুর কৃর্তৃত্বের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করল। ১৯৭১-এর মার্চে বাংলাদেশের গোটা প্রশাসনযন্ত্র বঙ্গবন্ধুর পেছানে কাতারবন্দি হলে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের অপ্রতিদ্বন্দ্বী শাসক বা একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে ওঠেন। পৃথিবীর আর কোনো দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনেই সংশ্লিষ্ট দেশটির জাতীয় স্বাধীনতা স্বীকৃতি না পাওয়া পর্যন্ত প্রশাসনকে এভাবে তাদের আনগত্য পরিবর্তন করতে দেখা যায়নি।কার্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতা একটি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল; যে প্রক্রিয়ায় ১ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত সব উপাদানই বাংলাদেশের কর্তৃত্বাধীনে ছিল। বঙ্গবন্ধু আহূত অসহযোগ আন্দোলন এমনই ক্যাপক ও সর্বজনগ্রাহ্য ব্যাপার হয়ে দাড়ায় যে, এতে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও অবকাঠামো সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়ার উপক্রম হয় আর এর ফলে এতদঞ্চৎেরর জনগোষ্ঠীর জীবন বিপন্নের আশঙ্কাও তৈরি হয় বৈকি! এমন এক পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখতে অর্থাৎ, এই প্রয়োজনের তাগিদে বঙ্গবন্ধুকে অসহযোগ আন্দোলনকালেই এতদঞ্চলের শাসনভার পরিচালনতার দায়িত্ব নিতে হয়।
সুনির্দিষ্ট কিছু অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চালু রাখা এবং প্রশাসনিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাকল্পে বঙ্গবন্ধু একটি প্রাথমিক নীতি-নির্ধারণী ব্যবস্থা হাতে নেন। তিনি বেশ কয়েকজন বাঙালি পেশাজীবীকে নিয়ে একটি ছোট্ট সেল তৈরি করেন, যে সেলটির কাজ ছিল প্রতিদিন বিভিন্ন ইস্যুতে সিদ্ধান্ত বা ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ব্যঅংকার ও আমলাদের সঙ্গে বৈঠক করা।

ব্যাংকগুলোর কাজকর্ম, রফতানি, সরকারি কর্মচারীদের বেতন, রাজস্ব আয়, সরকারি সার বিতরণ, টিউবওয়েল এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পরিবহন ব্যবস্থা চালু রাখার ব্যপারে প্রয়োজনীয় যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারেই তারা দৈনিক আলোচনা করতেন সেসব বৈঠকে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীনে এভাবে এক প্রকার শাসন ব্যবস্থা কায়েক হয় এবং এক্ষেত্রে প্রস্তাবিত প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত বা ব্যবস্থার কথা বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে দৈনিক তাজউদ্দীন আহমদ এবং ড. কামাল হোসেন বাঙালি আমলাদের একটি টিমকে অবহিত করতে থাকেন।আমলাদের ওই টিমটিকে তাদের সহকর্মীরাই নির্বাচন করে দিয়েছিলেন এবং তাদের দায়িত্বিই ছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখে প্রশাসনের জন্য বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত নির্দেশাবলী সংশ্লিষ্ট মহলগুলোর কাছে পৌঁছে দেয়া।

জরুরিভিত্তিতে সমাধান প্রয়োজন এমন কিছু প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সমস্যার বিষয় আবার বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়িতে গিয়ে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর কাছেই উপস্থাপন করা হতো।সত্যি বলতে বঙ্গবন্ধুর ওই বাড়িটি  ১৯৭১-এর মার্চে বাংলাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল। ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদল তাদের করণীয় কর্তব্য নির্ধারণের জন্য বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মিলিত হয়ে তাদেরই নির্বাচিত সহকর্মীদের মারফত এক্ষেত্রে জরুরি সব সিদ্ধান্ত প্রাপ্তির ব্যবস্থা নেয়। বাংলার মানুষের মনে নিরাপত্তাবোধ বজায় রাখার জন্য আওয়ামী লীগের কর্মীদের সহযোগিতায় ও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পালনের মাধ্যমে পুলিশ বাহিনী সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং এভাবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান পুনরায় সচল করা হয়। যদিও অবাঙালি নির্যানতনের দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা তখন ঘটেছে কিন্তু তথাপিও, গোটা মার্চজুড়ে দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিস্ময়কর রকমের স্থিতিশীল ছিল। সে সময় বাঙালিরা অবাঙালিদের আশ্রয় দিতেও কার্পণ্য করেনি।

সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়
১৫ মার্চের মধ্যেই বাস্তবে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ নির্দেশে ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের পরিচালনাধীনে কারর্যত একটি সচল প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পায়। বঙ্গবন্ধুর ওই প্রশাসন ও রাজনৈতিক কর্তৃত্বের ছিল বৈধ ভিত্তি। এই কর্তৃত্বের পেছনে যে শক্তি এবং আইনসিদ্ধ ভিত্তি ছিল তা হলো ৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর প্রতি দেশবাসীর নিরঙ্কুশ রাজনৈতিক সমর্থন ও আস্থা। এই সময়পর্বে বাংলাদেশের গোটা ভৌগলিক সীমানার ওপর বঙ্গবন্ধুর যে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় তা কিন্তু একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে ওই ভূখণ্ডকে কোনো বিদেশি সরকারের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য যথেষ্ট ছিল।

যা হোক, বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের ওপর বঙ্গবন্ধু সেদিন যে নিরঙ্কুশ কৃর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিশ্ববাসী তখন একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম বৃত্তান্তের খবরাখবর সংগ্রহের কাজে বাংলাদেশে অবস্থানরত বিপুল সংখ্যক বিদেশি সাংবাদিকদের মাধ্যমে জানতে পারছিল। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু নিজেও তখন পাকিস্তানি সামরিক শাসকেদের সঙ্গে সদ্ভাব আছে-এমন বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সরকার প্রধানদের সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালুর যৌক্তিকতা বোঝানোর ব্যাপারে ইয়াহিয়া খানের ওপর প্রভাব বিস্তারের অনুরোধ নিয়ে। অবিশ্যি, বিদেশি সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুর কার্যক্রম বা কথা সেসব দেশের জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্বটি পালন করেছেন সেদিন নির্দ্বিধায়। আর এ কারণেই ১৯৭১-এর মার্চেই শেখ মুজিবুর রহমান তৃতীয় বিশ্বের অন্যতম প্রধান এক ব্যক্তিত্বরূপে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

মার্চে মাঝামাঝি ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের রাজনৈতিক সঙ্কটের নিয়মতান্ত্রিক সমাধানের উদ্দেশ্যে আলোচনা পুনরায় শুরু করার জন্য ঢাকায় আসেন। এবার কিন্তু দেশের একজন সাধারণ নাগরিক বা কোনো একজন প্রজার সঙ্গে নয় বরং রাজনৈতিকভাবে তার সমকক্ষ এক ব্যক্তির সঙ্গেই বৈঠক করতে হলো তাকে। এ পর্যায়ে এই র্বক্তিটি অর্থাৎ, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের কেবল মহাপরিক্রমশালী ব্যক্তিই নন, বরং নিজ ভূখণ্ডে তার কর্তৃত্ব তখন পশ্চিম পাকিস্তানি জনগণের ওপর ইয়াহিয়া খানের কর্তৃত্বের চেয়েও বহুগুণ বেশি। ওই সময় বাংলাদেশের উদ্ভূত বাস্তবতার নিরিখে সঙ্কটের সমাধানের জন্য ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনায় প্রবৃত্ত হলে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করা সম্ভব হলেও হতে পারত! কিন্তু এর পরিবর্তে ইয়াহিয়া খান তখন ভুট্টো এবং সেনাবাহিনীর কিছু উগ্রপন্থী জেনারেলের প্ররোচনয় ধরেই নিলেন যে, শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে এই মধ্যবিত্ত বাঙালি নেতাদের আবেগ দমন করা আদৌ কঠিন হবে না। ইয়াহিয়া ও তার দোসররা ভেবেছিল, মধ্যবিত্ত আবেগে ভাসমান নেতাদের মধ্যে কয়েকজনের লাশ রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখলেই মনে হয় ন্যরা সুড়সুড় করে সামরিক জান্তার সঙ্গে আপসরফার জন্য ছুটে আসবে। কিন্তু হিসাবে তারা এবার ভুল করেছিল। তারা বিশ্বাসই করতে পারেনি যে, বাঙালিরা এরই মধ্যে স্বাধীনতার জন্য এবার একটি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো শক্তি, সামর্থ্য, সাহস, ঐতিহ্য ও সামরিক সক্ষমতা অর্জন করেছে।শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ওই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ধারণাই করতে পারেনি যে, ১৯৭১-এর মার্চেই বাংলাদেশ ভূখণ্ডে একটি জাতিরাষষ্ট্রে অভ্যুদয় ঘটার আয়োজন ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছৈ এবং ওই ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠী তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুদ্ধ করতে এখন স্থির-সংকল্পবদ্ধ। ভু্ট্টো ও ইয়াহিয়া উভয়েরই মনের মধ্যে এ্ক্ষেত্রে যে চিন্তাটি বাসা বেঁধেছিল তা এই যে, শক্তি প্রয়োগের নতিজা খুব বেশি খারাপ দেখলে অর্থাৎ, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার উপক্রম দেখলে তার আগেই পোড়ামাটি নীতি অবলম্বনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাক করে দেয়া হবে যাতে বাঙালিদের সার্বভৌমত্ব লাভের খায়েশ চিরতরে মিটে যাবে। অন্যদিকে ভুট্টো ভেবেই নিয়েছিল, বাংলাদেশ আলাদা হয়ে গেলে ইয়াহিয়ারও পতন ঘটবে আর তখন অবশিষ্ট পাকিস্তানের নতুন শাহেনশাহ হিসেবে রাজত্ব চালিয়ে যেতে তার কোন অসুবিধাই হবে না।

এসব কারণেই তাই বাস্তবে দেখা গেল ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নাটক মঞ্চস্থ করার নেপথ্যে বাংলাদেশের মাটিতে বিপুল সংখ্যক সৈন্যের সমাবেশ ঘটাতে শুরু করেছে। এই সৈন্য সমাবেশের উদ্দেশ্য বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তিসমূহকে নিশ্চিহ্ন করা। তিনি এই সেনা সমাবেশ ঘটিয়ে পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের সম্ভবত এ কথাটিই স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন যে, পূর্ব পাকিস্তান নামক প্রদেশটির ওপর শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক কর্তৃত্বের আওতাধীন ব্যাপার।

কিন্তু ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে বাঙালি নিধনযজ্ঞ চালানোর জন্য টিক্কা খানকে চূড়ান্ত নির্দেশ দিয়ে প্রকারান্তরে পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষই গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির ক্ষমতা দখল করে নেয়। সুতরাং, বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী পরিচালিত সামরিক অভিযান প্রকৃত প্রস্তাবে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের ওপর এক সার্বভৌম রাষ্ট্রের সামরিক আগ্রাসন হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছিল। বাঙালিরা বিষয়টিকে এভাবেই মূল্যায়ন করেছে আর বাস্তবিক পক্ষে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ওই বাঙালি নিধনযজ্ঞকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তাদের সামরিক আগ্রাসন হিসেবেই দেখেছে।

১৯৭১-এর মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু বাঙ্গালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবি প্রত্যয় দৃড়কন্ঠে পুনঃ পুনঃ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে এতদঞ্চলের বাঙ্গালিদের জাতীয় সচেতনতার বিষয়টিকে তাদের চেতনায় একটি সার্বভৌম মর্যাদা লাভের দাবিতে রূপান্তরিত করেছিলেন। আর এভাবেই বাঙ্গালিদের জাতীয় সচেতনতার বিমূর্ত রূপটি একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সুসংহত হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটিয়েছে। ফলে তখন পলাশী যুদ্ধের পর এই প্রথমবার বাঙ্গালিরা তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা শাসিত হওয়ার সুযোগ লাভ করতে চলেছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা
১৯৭১-এর ২৫ মার্চের মধ্যেই বাংলাদেশ অধিকাংশ বাঙ্গালির মনে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করেছে। বাঙ্গালিদের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়ার সামরিক অভিযানের প্রেক্ষাপটে ছাব্বিশ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা ছিল বাংলাদেশের বৈধ কর্তৃত্ব ও তার কার্যকর রূপকে আনুষ্ঠানিকভাবে বৈধতা বা স্বীকৃতি দান। সুতরাং স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে আসলে অহেতুক এক বিতর্ক সৃষ্টি করতে দেখা গেছে। কান্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ মাত্রেই বিষয়টি অত্যন্ত পরিষ্কার যে, কে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন সেটি এক্ষেত্রে কোনো বড় ব্যাপারই নয়; বড় বিষয়টি হচ্ছে বাঙ্গালিরা কখন কীভাবে নিজেদের স্বাধীনসত্তা লাভের জন্য প্রত্যয়ী হয়ে উঠেছিল সেটি। আর কে না জানে যে, ১৯৭১-এর মার্চ জুড়েই বাঙ্গালিরা স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে উজ্জীবিত হচ্ছিল। সে যাই হোক। এ কথা তো মানতে হবে যে, স্বাধীনতার ঘোষণা কোনো বৈধ কর্তৃত্বের বা বৈধ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আসতে হবে। তা না হলে বিশ্বের যেকোন নাগরিকই যে কোনো প্রকার বৈধ কর্তৃত্ব ছাড়াই সাড়ে ৭ কোটি মানুষের জন্য স্বাধীনতা ঘোষণা করলেই বা জনগণ তা গ্রাহ্য করবে কেন; আর ১৯৭১-এর বাংলায় এ-তো ছিল কল্পনার অতীত। বাস্তবের নিরিখে বিচার করলে দেখা যাবে একজন অজানা-অচেনা লোকের ঘোষণা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই আশঙ্কাই সৃষ্টি করত যে বাংলাদেশ নৈরাজ্যের দিকে ধাবিত হতে চলেছে। এ সময় স্বাধীনতার ডাক দেয়ার সর্ব প্রকার বৈধ ও নৈতিক অধিকার ছিল একমাত্র বঙ্গবন্ধুর। কেননা তার ছিল নির্বাচনী বৈধতা এবং বাংলাদেশের জনগণের হয়ে কথা বলার নিরঙ্কুশ রাজনৈতিক ম্যান্ডেট আর তাই জনগণের কাছে একমাত্র তার কথাই ছিল গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য অন্য কারও নয়। বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের অবিসংবাদিত ও একক নেতারূপে বিশ্বে তার পরিচিতি ততদিনে পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত, সুতরাং, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বৈধ ঘোষক যে একমাত্র তিনিই হতে পারেন বিশ্ববাসীর এ সত্যটি বুঝতে বেগ পেতে হয়নি।

বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে তাই বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বৈধ ঘোষক হিসেবে স্বীকৃত। স্থানীয়ভাবে সেদিন কেউ যদি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে থাকে তবে তা বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে প্রদত্ত কোনো ঘোষণা হিসেবে মানা যেতে পারে, অন্য কারও একক ঘোষণা হিসেবে নয়। আজকের রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত এই বাংলাদেশেই কেবল স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে অবাস্তব এক বিতর্ক জারি রাখা সম্ভব হচ্ছে। ভাবটি এই যে, মনে চাইলেই যে কেউ স্বাধীনতার ডাক দিতে পারে আর এমন এক আজগুবি ও উদ্ভট মিথ্যা দীর্ঘকাল ধরে জিইয়ে রাখা হয়েছে এখানে।

বঙ্গবন্ধু ও মুক্তি সংগ্রামের বৈধতা
অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব বঙ্গবন্ধুকে যে বৈধতা দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তা ধরে রাখা খুব সহজ বিষয় ছিল না। ১৯৭১-এর মার্চে বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তখন তার প্রতি জনগণের অকুন্ঠ ও অবাধ সমর্থন আর নিরঙ্কুশ নির্বাচনী ম্যান্ডেট রয়েছে। ফলে জনগণের উপর তখন তার প্রশ্নাতীত ও অবিসংবাদিত কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কোনো পর্যায়েই সেসব দেশের মূল নেতারা গোটা জনগোষ্ঠীর ওপর এমন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হননি বললেই চলে। গান্ধী, নেহরু, মাও, হো-চি-মিন, বেনবেল্লা, নক্রুমা নায়ারারে এমনকি নেলসন ম্যান্ডেলার পক্ষেও এত বিশাল ম্যান্ডেট ছিল না। এরা সবাই পূর্ণাঙ্গ নির্বাচনী বৈধতা অর্জন করেছিলেন স্বাধীনতা লাভের পর। সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত যে কর্তৃত্ব বঙ্গবন্ধুর ওপর ন্যস্ত হয়েছিল তা প্রকারান্তরে বাঙ্গালি বিচারক, আমলা, কূটনীতিকদের বঙ্গবন্ধুর প্রতি পূর্ণ সমর্থন প্রদানে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আবার ওই একই কারণে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর বাঙ্গালি সদস্যরা তাদের শপথ ভেঙ্গে ও আনুগত্য পরিবর্তন করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেছিল। এ ক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে, ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভিয়েতনামি সৈন্যরা ফরাসি বাহিনীর হয়ে ওই মুক্তিসংগ্রাম দমনে সচেষ্ট থেকেছে। আলজিরিয়ার মুক্তিযুদ্ধের সময়ও আলজিরীয় সৈন্যরা তাদের ফরাসি প্রভুদের হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নিধনে মেতে উঠেছিল। তাছাড়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসন চলাকালে ব্রিটেন তার বিভিন্ন উপনিবেশের মুক্তিসংগ্রাম পর্যুদস্ত করতে স্থানীয় সৈন্য, আমলা ও পুলিশদের ব্যবহার করেছে অবলীলায়। একমাত্র বাংলাদেশেই এক্ষেত্রে এই আশ্চর্য ব্যতিক্রম দেখা যায়, এখানকার ঔপনিবেশিক শাসকের প্রতি আনুগত্য পরিহার বা কর্তৃত্ব অমান্যপূর্বক সরকারি কর্মচারীরা বিদ্রোহীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল।

এসব কারণেই ১৯৭১-এর মার্চের পর বাংলাদেশের মানুষেরা যখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নিকট তাদের প্রাণের আকুতি ও আর্তি পেশ করতে থাকে তখন সেসব দেশের অনেক সরকারের দিক থেকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি সমর্থন লাভ বা প্রকৃত পরিস্থিতি অনুধাবনে খানিক বিলম্ব ঘটলেও সেসব দেশের জনগণের পক্ষ থেকে সাড়া ও সমর্থন পেতে একটুও দেরি হয়নি। সেসব দেশের জনগণ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সমর্থন প্রদান করায় ও দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী পরিচালিত গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়ায় কোন কোন দেশের সরকার ওই গণহত্যা বন্ধের ব্যাপারে পাকিস্তানি সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টিতে বাধ্য হয়েছিল। এখনকার সময়ে হলে ইয়াহিয়া এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালিয়েছে বিশ্বের বহু দেশই তার নিন্দাজ্ঞাপন করত এবং যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ইয়াহিয়া ও টিক্কা খানের বিচারের দাবিতে বিশ্বে সোচ্চার জনমত গড়ে উঠত। ১৯৭১ সালে অল্প কিছু বিরল ব্যতিক্রম বাদে বেশির ভাগ দেশের সরকারই বিশ্বাস করত যে, নিজের দেশের নাগরিক হত্যা এবং হত্যাকারীর শাস্তি না দেয়ার অধিকার প্রতিটি দেশের সরকারেরই আছে তা সে সরকার খুব জনপ্রিয় না হলেও এতে কোনো ক্ষতি নেই।

তাই ১৯৭১ সালে এসব দেশের জনগণের সমর্থন আদায় করাটাই বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। কেননা, স্বাভাবিক অবস্থায় এসব দেশের মানুষ তাদের জীবনধারার কোন পর্বেই হয়তো বাংলাদেশের নামই কোনোদিন জানতে পারত না। সুতরাং, একাত্তুরের অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করাটা সহজ হয়। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পরিচালিত নির্মম-নৃশংসতার বিষয়টি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাধারণ মানুষদের দৃষ্টিগোচর হয়েছিল ১৯৭১-এর মার্চে বাংলাদেশের সংগ্রাম এবং বাংলাদেশের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর মর্যাদা ও তার দৃশ্যমান রূপের বদৌলতে। ১৯৭১ পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের ভূমিকা নিয়ে যে যাই বলুক না কেন বাঙ্গালি মাত্রই এ সত্য স্বীকার করতেই হবে যে বঙ্গবন্ধু যদি বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বাঙ্গালীদের মাঝে জাতীয় আত্মসচেতনতা সঞ্চারপূর্বক তাদের প্রদত্ত ম্যান্ডেটের বলে তাদের হয়ে বিশ্ববাসীর সামনে কথা না বলতেন এবং তাদের মর্যাদা রক্ষাকল্পে তাদের ঐক্যবদ্ধ না করতেন তা হলে আমাদের মুক্তি-সংগ্রামের ভবিষ্যৎ সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ার বেড়াজালে আটকা পড়ে অনিশ্চিত হয়ে পড়ত।

SUMMARY

307-2.jpg