‘বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ- শোক হোক শক্তি’

ধর্মান্ধ কিংবা ধর্মে বিশ্বাসী নয়-এমন লোকজনদের কথা বাদই দিলাম। যেটি সর্বজনবিদিত বা সর্বজনস্বীকৃত তা হচ্ছে-যে কোনো ধর্মের ধর্মপ্রাণ লোকজন মাত্রই যে কোনো কাজের শুরুতে উঠতে-বসতে-খেতে-চলতে-ফিরতে সর্বক্ষেত্রে এক কথায় জীবনাচারের প্রতিটি মুহূর্তে স্ব স্ব ধর্মের কোনো না কোনো শ্লোক অথবা যার যার ধর্মমতে ধর্মবিশ্বাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু না কিছু মনে মনে একান্তভাবে আওড়ান আর দৈনন্দিন জীবনযাপন শুরু করেন। অনুরূপভাবে বাংলাদেশের নাম নিলেই সর্বপ্রথমেই যে নামটি চলে আসবে, তিনি আর কেউ নন-মুজিবুর। ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ‘শোন একটি মুজিবুরের থেকে লক্ষ মুজিবুরের’ গানটি সেদিন পুরো জাতিকে কিভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছিলো-সেটি দস্তুরমতো একটি ইতিহাস। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস, সূর্যসেন, মওলানা ভাসানী, মনিসিংহসহ আরও আগের এবং সমসাময়িক অনেকের প্রতি সর্ব্বোচ্চ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে যেটুকু বলা যায়- উনাদের অসমাপ্ত কাজকে সময় আর ঐতিহাসিক বাস্তবতার নিরিখে, ভাগ্যের বরপুত্র হিসাবে স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের একক নেতৃত্ব দেয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন কেবলমাত্র শেখ মুজিবুর রহমান।
 
আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন আর স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যা শুরু হয়েছিল অবশেষে স্বাধীনতাকামী ছাত্রছাত্রীদের, শ্রমিক জনতার আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রদান ও পতাকা উত্তোলনসহ বাঙালী জাতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামেই ব্যাপক রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের মধ্য দিয়েই বিজয় ছিনিয়ে নেয়।

একজন বন্দি মুজিবুর কত শক্তিশালী হতে পারে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ আর তখনকার সময়ের বিশ্বমিডিয়া, বিশ্বনেতৃবৃন্দের বক্তব্য আর মানবতার মুক্তি আন্দোলনের দূত হিসাবে তখনকার সময়ের বিশ্বের শোষিত ও নির্যাতিত সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া থেকে জানা যায়। ইদানিং প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী আর কিছু হাইব্রীড নামক দানবরা স্বার্থসিদ্ধির জন্য নামটিকে যেভাবে ব্যবহার করছে- তা যে কোনো বিবেকবান মানুষের কাম্য নয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামটি আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা আর মুক্তিসংগ্রামের নিরিখে কখনও কোনোক্রমেই কোনো ব্যক্তির, পরিবারের বা কোনো একটি সুনির্দিষ্ট দলের একক সম্পদ হিসাবে গ্রহণযোগ্য বা বিবেচিত হতেই পারে না। নামটি আমাদের পুরো দেশ আর জাতির সম্পদ। তাই কোনো পরিবার কিংবা দল নামটিকে যাতে এককভাবে ব্যবহার করে নামটির গুণগত ও পবিত্র মাহাত্ম্যকে বিঘ্নিত না করে, রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের হাতিয়ারে পরিণত না করতে পারে- সেজন্য সমগ্র দেশে ব্যাপক জনসচেতনতার অন্য কোনো বিকল্প নেই।
 
১৯৭১ পূর্ব সময়ে ৩২’নম্বর ধানমন্ডির বাসভবনে বেগম ফজিলতুন্নেসা মুজিব, সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনিসহ বি এল এফ নেতৃবৃন্দ, চার খলিফাখ্যাত ছাত্রনেতাদের গোপন বৈঠকে বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করা হয়- স্বাধীন দেশটি কি নামে অভিহিত হতে পারে? বঙ্গবন্ধু অনেক সময় নিয়ে যখন বলে উঠেন- ‘বাংলাদেশ’ নামটি কেমন হবে!! তখন বেগম মুজিবসহ একত্রে একযোগে বলে উঠে আমরাও তাই ভেবেছিলাম। ঠিক করেছিলাম। বঙ্গবন্ধুসহ সকলেই একযোগে হেসে উঠেছিলেন সেদিন। বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে শোনার পর সেদিন সকলের মাথা থেকে দীর্ঘদিনের এক বিরাট বোঝা নেমে গিয়েছিলো। সেই থেকে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শব্দটি সমার্থক। একটির থেকে আরেকটিকে কখনও আলাদা করা সম্ভব নয়। একটি ছাড়া অন্যটি অপূর্ণ।

বাঙালী জাতির ইতিহাসে পনেরোই আগষ্টে স্বপরিবারে ইতিহাসের বর্বরতম পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের দিনটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে শোকের দিন হিসাবে বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতি স্মরণ করবেই। তাই এমতাবস্থায় পনেরোই আগষ্টের শোকের দিনটিকে শক্তি অর্জনের অন্যতম উৎস হিসাবে পরিগণিত করতে হলে পারিবারিকীকরণ এবং দলীয়করণের বিপরীতে কেবলমাত্র কাগজে কলমে না রেখে বঙ্গবন্ধুকে পুরো জাতির সম্পদ বা একক ইনষ্টিটিউশনের আলোকে সকলকে হৃদয় থেকে বলতে দিতে হবে। পরিবার বা দলের বাইরের সাধারণ আমজনতাকে ভালোবাসা প্রকাশের অধিকার দিতে হবে। দল ও পরিবারের সদস্যদের বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ এলেই নমনীয়তা প্রদর্শন করতে হবে। অন্যদের মুখ থেকে নামটির প্রতি ভক্তিপূর্ণ আচরণকে প্রাধান্য দিতে হবে। ভুলেও দলের কোনো সদস্য ‘বাংলাদেশ বা বঙ্গবন্ধু’কে একান্তভাবে তাদের ব্যক্তিগত সম্পদের মতো সাধারণ মানুষের সামনে যেনো তুলে না ধরে এবং নামটিকে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের উদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ না করতে পারে সেদিকে কড়া দৃষ্টি দিতেই হবে।

আমাদের স্মরণ রাখতে হবে কিছুসংখ্যক পাকিপ্রেমীদের বাদ দিলে ১৯৭১ খৃষ্টাব্দে বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বে দলমত নির্বিশেষে সাতকোটি বাঙালী ঐক্যবদ্ধভাবে জনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিলো রাজনৈতিক জনযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর নামেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে।’ ২০১৪ খৃষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরের ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ নামক সংবাদপত্রে যেটি লিখেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলক আ স ম আবদুর রব। যুগের বা কালের আবর্তন বিবর্তনে আওয়ামী লীগ বিলীন হয়ে গেলেও বঙ্গবন্ধু, ১৯৭১ এর মহান জনযুদ্ধ তথা স্বাধীনতার সংগ্রাম অবশেষে স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশ যা কখনও কোনোদিন বিশ্বের মানচিত্র থেকে আর মুছে যাবেনা।
 
এসব কিছু বিবেচনায় রেখে আমাদের মনে রাখতেই হবে- বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর নামটিকে সামনে রেখে একাত্তরের ব্যাপক রক্তক্ষয়ী মহান জনযুদ্ধকে ভক্তিভরে স্বীকার করে বা মেনে নিয়ে কিংবা সম্মানচিত্তে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটকে বুকে ধারণ করে রাজনীতির আবর্তন বিবর্তন ব্যতিরেকে অন্য কোনো বিকল্প আদৌ আছে কি? যারা তা করবেনা কিংবা অবহেলা করবে তারা ক্রমশ ধারাবাহিকভাবে অস্থিত্বহীন হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত সকলের স্মরণ রাখা দরকার যে, একটি জাতির জন্ম বা অভ্যুদয়কে কেন্দ্র করে আগামী দিনগুলোতে কেবলমাত্র Pro Liberation বা Pro Independent শক্তিগুলো সরকার আর বিরোধী দলকে নিয়ন্ত্রণ করবে। বাঙালী জাতির ইতিহাস বলে ধর্মের নামে কিংবা উগ্র ধর্মান্ধতার বিষবাস্প ছড়িয়ে অথবা ধর্মের নামে তালবাহানা করে বেশ কিছুদিনের জন্য শাসনক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখলেও কোনো না কোনো সময় ব্যাপক জনরোষের মুখে শাসন ক্ষমতার পরিবর্তন আসবেই। কারণ একথা সকলেই জানে যে অর্থ ও ক্ষমতা কারো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হতে পারেনা। বিশেষ করে ধর্মের নামে প্রহসনমূলক শাসনক্ষমতার অবসান অনিবার্য। বাঙালী জাতির বারবার জেগে উঠার ইতিহাস আছে।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জিত হলেও বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ‘মুক্তির সংগ্রাম এখনও সুদূর পরাহত। বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতে হলে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে মহান জনযুদ্ধের প্রেক্ষাপটকে, মূল্যবোধকে সামনে রেখে শোককে শক্তিতে পরিণত করতে হবে।অব্যাহতভাবে জনজীবনের সকল ক্ষেত্রে ‘মুক্তির সংগ্রাম’ চালিয়ে যেতেই হবে। দেশপ্রেম রাতারাতি তৈরি করা যায়না। এটি ছোটবেলা থেকে প্রশিক্ষণের বিষয়।
 
১৯৭১ খৃষ্টাব্দ পরবর্তী প্রজন্ম ১৯৭৫ খৃষ্টাব্দ পরবর্তী সময় থেকে কনফিউজড ইতিহাস কিংবা বিকৃত ইতিহাসের সাথে যেভাবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেছে- তাতে রাতারাতি মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের প্রতিষ্টা সম্ভব নয়। অবশ্য ১৯৭১ পরবর্তী প্রজন্মদের দোষারোপ করাও যাবেনা। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, শিষ্টাচার আর মূল্যবোধের পচন বিস্তৃত হয়ে গেছে। ধর্মের নামে ভণ্ডামীর আর মিথ্যাচারের বহি:প্রকাশ সর্বত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। এসবের মূল কারণ খতিয়ে দেখলে দেখা যায় যে, কেবলমাত্র বিকৃত ও কনফিউজড ইতিহাস নিয়ে যারা প্রশিক্ষিত-তাদের মাঝে একদিকে যেমন দেশপ্রেম গড়ে উঠেনি- তেমনি এদের মধ্য দিয়ে দুর্নীতি বিস্তৃত হয়ে পুকুর চুরি থেকে সাগর চুরিতে গিয়ে ঠেকেছে। শিষ্টাচার আর মূল্যবোধের পচনতো দস্তুরমতো তলানীতে।

তাই আর দেরী না করে যত দ্রুত সম্ভব নতুন প্রজন্মকে আমাদের মহান স্বাধীনতার সত্যিকারের ইতিহাস জানাতে হবে। যার যা অবদান- শিক্ষাঙ্গন থেকে শুরু করে জনজীবনের সর্বত্র এককথায় জাতীয় পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গোপনে আর প্রকাশ্যে আমাদের দীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলন এবং ধারাবাহিকভাবে তা জনযুদ্ধে রূপান্তরের বিষয়টি তুলে ধরতে হবে, জানাতে হবে। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শুধু তাই নয়- এভারেষ্ট শৃঙ্গসম মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে সম্মানিত করতে হলে, সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর পবিত্র আত্মার শান্তির জন্য হিমালয়ের চতুর্পাশের পর্বতরাজিকেও সুশোভিত করে তুলতেই হবে। লোকালয়ের পাহাড়গুলোকেও সাজিয়ে দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠাকল্পে শোককে শক্তিতে সমৃদ্ধ করতে হলে অন্য কোনো বিকল্প নেই।

SUMMARY

305-1.jpeg