বঙ্গবন্ধু: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথিকৃৎ

১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির মদতে কতিপয় বিপথগামী সেনাসদস্য সপরিবারে হত্যা করে এই মহান নেতাকে। ইতিহাসের বর্বরোচিত এই হত্যাকাণ্ডে দেশ ও জাতির যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গতিশীল, সাহসী ও ঐন্দ্রজালিক নেতৃত্বে এই ভূখণ্ডের মানুষ হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিঁড়ে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। আমরা পেয়েছি নিজস্ব জাতিরাষ্ট্র, গর্বিত আত্মপরিচয়।

ঘাতকচক্র বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও তার স্বপ্ন ও আদর্শের মৃত্যু ঘটাতে পারেনি। ১৬ কোটি বাঙালির অন্তরে লালিত হচ্ছে তাঁর ত্যাগ ও তিতিক্ষার সংগ্রামী জীবনাদর্শ। এটাই আমাদের সব শক্তির উৎস। শেখ হাসিনা শোককে শক্তিতে পরিণত করে সংগ্রামের পথে দৃপ্ত পদক্ষেপে সবাইকে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
 
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথিকৃৎ এবং স্বাধীন সার্বভৌমত্ব বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাঙালি জাতির এক অবিসংবাদিত নেতা। বাঙালির অধিকার এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদান তার। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৮ এর সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ’৬৬ এর ৬-দফা, ’৬৯ এর গণ-অভ্যূত্থান, ’৭০ এর নির্বাচনসহ এ দেশের সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণে প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে তিনি এই জাতিকে নেতৃত্ব দেন। এজন্য তাকে বার বার কারাবরণসহ অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়। সকল প্রকার অত্যাচার, শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, সাহস, বাগিতা এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এদেশের সাধারণ মানুষকে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করে।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে তিনি পরোক্ষ ভাবে বাঙ্গালী জাতিকে স্বাধীনতার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি জানতেন, যে কোন মুর্হূতে পাকিস্তানী শাষক গোষ্ঠী তাকে গ্রেফতার করতে পারে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তিনি মহান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত হয় বহু কাঙ্খিত স্বাধীনতা। শুধুমাত্র স্বাধীনতা অর্জনই নয়, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে সমহিমায় প্রতিষ্ঠা করতে তিনি নিরলস প্রচেষ্টা চালান। বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতির জনকের অবদান তাই স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে চিরদিন…।
 
রক্তঝরা ১৫ আগষ্ট। সাবেক রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট প্রত্যুষে সেনাবাহিনীর একদল সদস্যের হাতে ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর সড়কে নিজ বাসভবনে হত্যার শিকার হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর ২ কন্যা ছাড়া তার পরিবারের সব সদস্যকেই সেদিন হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা তখন বেলজিয়ামে অবস্থান করায় ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট ভোররাতে ঘাতকের বুলেট বঙ্গবন্ধু ছাড়াও তার স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশুপুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধ‚ সুলতানা কামাল (খুকী) ও পারভীন জামাল (রোজী), বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ছোট ভাই শেখ নাসের, ভগ্নিপতি তৎকালীন মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি এবং বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা কর্নেল জামিলের প্রাণও কেড়ে নেয়।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকী ১৫ আগষ্টকে জাতীয় শোকদিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হচ্ছে। দেশের সব সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিদেশে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনে কালো পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। সরকারের নির্দেশে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শোকদিবসের কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। দিনটিকে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পরবর্তী টানা ২১ বছর তার শাহাদাতবার্ষিকী রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয়নি। ১৯৯৬ সালে তার কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ৬ বছর দিবসটি উদযাপিত হয়েছে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে। সরকারিভাবে ওই সময় ১৫ আগষ্ট ছুটিও কার্যকর করা হয়। তবে একতরফা সিদ্ধান্তের কারণে পরবর্তী সরকার তা আর কার্যকর রাখেনি। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়। ফলে আবার সেই পুরানো ধারায় ফিরে যায় বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান।

এবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন থাকায় ব্যাপক আয়োজনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ দীর্ঘদিন রহিত ছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে এই হত্যার বিচারের বাঁধা অপসারণ করে। আওয়ামী লীগ আমলেই হত্যার জন্য অভিযুক্তদের বিচার শুরু হয় এবং আদালত ১৫ জনকে মৃত্যুণ্ডাদেশ দেন। হাইকোর্ট ডেথ রেফারেন্স মামলায় প্রথমে বিভক্ত রায় দেন। পরে হাইকোর্টের তৃতীয় বিচারক ৩ জনকে খালাস দিয়ে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। এরপর সুপ্রিমকোর্টে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারপতি না থাকায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারকার্য চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। পরবর্তী সময়ে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পর মামলার নিষ্পত্তির উদ্যাগ নেয়া হলেও তখনও বিচারপতি সঙ্কটে তা হয়নি। এবার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর নতুন করে এই মামলা নিষ্পত্তির উদ্যাগ নেয়া হয়। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে গত ২৮ জানুয়ারি ২০১০ রাত ১২ টা ১ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫ খুনির ফাঁসি কার্যকর করা হয়। 
 
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার স্বজনদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের নায়কদের বিচার কার্যকর করতে জাতিকে প্রায় ৩৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। ২৮ জানুয়ারি মধ্য রাতে ৩ দফায় ৫ আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। রাত ১২টা ১ মিনিটের প্রথমে মেজর (অব.) বজলুল হুদা ও মহিউদ্দিন আহমেদ আর্টিলারির ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ২য় দফায় রাত ১২.৩০ মিনিটে সৈয়দ ফারুক রহমান ও ল্যানার একেএম মুহিউদ্দিনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। সর্বশেষ রাত ১টা ১ মিনিটে সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের সেই নৃশংসতা বাকরুদ্ধ করে দিয়েছিল দেশবাসীকে। বিশ্ব বিবেক স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলেন সেদিন। ইতিহাসের জঘন্য এই হত্যাকাণ্ড, বর্বরতা জাতিকে পিছিয়ে দিল অন্তত একশ বছর। বাঙালি জাতি সেই ধাক্কা সামাল দিতে পারছে না আজও। দুই দশকেরও অধিক সময় অতিক্রান্ত। কিন্ত জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ বিচার হয়নি। অবশেষে (আংশিক হলেও) জাতির পিতার হত্যার বিচার হয়েছে বাংলার মাটিতেই। কিন্তু খুনিচক্রের ষড়যন্ত্র চলছে আজও। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথিকৃৎ বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির এক অবিসংবাদিত নেতা। তিনি বাঙালির অধিকার এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদান রেখেছেন। শুধু স্বাধীনতা অর্জনই নয়, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা করতে তিনি নিরলস প্রচেষ্টা চালান। 
 
বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতির জনকের অবদান তাই চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ইতিহাসের বর্বরোচিত এই হত্যাকাণ্ডে দেশ ও জাতির যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়। এই ঘটনায় গোটা জাতি গভীরভাবে মর্মাহত এবং শোকে মুহ্যমান।

জাতির জনক দেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার সেই স্বপ্ন সার্থক রূপায়নে তারই যোগ্য উত্তরসূরী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ভিশন-২০২১’ ঘোষণা করেছেন। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে। জাতির জনকসহ তার পরিবারের সকল শহীদ সদস্যের আত্মার শান্তি কামনা করছি…! পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন অনুযায়ী একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সরকারকে সহযোগিতা আমাদের দায়িত্ব। বঙ্গবন্ধু দেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। আমাদের অঙ্গীকার হোক তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের, একটি সোনার বাংলার চিত্র বিশ্বের মানচিত্রে ফুটিয়ে তোলার…।

SUMMARY

304-1.jpeg