বঙ্গবন্ধু, বাঙালি ও বাংলাদেশ এক সুতোয় বাঁধা

- মাহবুব রেজা 

এক.
‘মুজিব মানে আর কিছু না

মুজিব মানে মুক্তি

পিতার সঙ্গে সন্তানের

না লেখা প্রেম চুক্তি।

মুজিব মানে আর কিছু না

মুজিব মানে রক্ত

মুজিব আমার শক্তি সাহস

আমি মুজিব ভক্ত।’

কবি নির্মলেন্দু গুণ তার একটি ছড়ায় এভাবেই প্রকাশ করেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অফুরন্ত ভালবাসা, শ্রদ্ধা আর ভক্তি। কবির হাত ধরে উঠে আসে সত্য আর বাঙালির ধারাবাহিক ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর কীর্তি গাঁথার কাব্য। বাঙালি জাতির রয়েছে হাজার বছরের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আর সেই ইতিহাসের সোপান বেয়ে, সময়ের হাত ধরে মহানায়কদের আগমন ঘটেছে। কালের বিচারে সেসব মহানায়কদের কেউ কেউ নিজ কর্মের জন্য আমাদের মধ্যে টিকে আছেন, আবার কেউ কেউ স্বীয় কর্মের জন্য ইতিহাসের পাতায় ধূসর হয়ে গেছেন।

শত শত বছরের শোষণ-বঞ্চনার অধীনে থেকে বাঙালি যখন নিজস্ব পরিমণ্ডল থেকে ক্রমে পেছনে সরে যাচ্ছিল ঠিক সেইসময় পেছনের সব মহাপুরুষদের কীর্তিগাঁথাকে ম্লান করে দিয়ে পাদ-প্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত হলেন তিনি। দীর্ঘদেহী মানুষ সিংহের মতো গর্জনে তিনি ঘুমিয়ে পড়া বাঙালিকে পুনরায় জাগিয়ে তুললেন। বাঙালি জাতিকে একত্রিত করলেন, করলেন নবধারায় উজ্জীবিত। শোষণ-বঞ্চনার ঘেরাটোপ থেকে বাঙালি জাতিকে তিনি নতুন করে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করলেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই মহাপুরুষ অন্ধকার অমানিষা থেকে এক আলোর পথ দেখালেন বাংলার মানুষকে। তার অঙুলি হেলনে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন যার যা আছে তা নিয়ে।
 
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ মহান নেতার এই বজ্রকঠিন ঘোষণায় বাংলার লাখ লাখ দামাল ছেলে, ছাত্র-ছাত্রী, কৃষক-শ্রমিক, সাংবাদিক-লেখক-বুদ্ধিজীবী-শিক্ষক-স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়লেন এবং নয় মাসের রক্তাক্ত যুদ্ধে মুক্তিকামী মানুষের দল স্বাধীনতার পতাকা ছিনিয়ে আনলেন। বিশ্ব মানচিত্রে উদিত হলো লাল-সবুজের পাতাকা। পৃথিবীর বুকে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটল। শোষণ আর বঞ্চনার অমানিশায় নিমজ্জিত মানুষ পেল নতুন দেশ।

ইতিহাসবিদরা তাদের গবেষণায় বলছেন, একথা আর নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত বিজয় সাধিত হয়েছিল যার স্রষ্টা বঙ্গবন্ধু। আরেকটু স্পষ্ট করে বললে বলা উচিত, একদিকে পাকিস্তানের শাসকচক্রের চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ও ধর্মীয় মৌলবাদীদের রাজনীতি অন্যদিকে দর্শনের অনুসারীদের মোকাবিলায় সুদীর্ঘ তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে সংগ্রাম করে একাত্তরে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে মহান স্বাধীনতা লাভের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত বিজয় সাধন করে বঙ্গবন্ধু প্রমাণ করেছেন পাকিস্তানি শাসকচক্রের বিরুদ্ধে তার গৃহীত সিদ্ধান্ত পুরোপুরি সঠিক ছিল। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ মনে করেন প্রকৃতপক্ষে ১৯৪৭-৪৮ সাল থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত অত্র ভূ-খণ্ডের রাজনৈতিক ইতিহাসকে কিছুতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী থেকে কোনোভাবেই আলাদা করা সম্ভব নয়। তারা মনে করেন, ১৯৪৭-৪৮ থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, সবই একই সুতোয় বাঁধা।
 
বিশিষ্ট গবেষক শাহজাহান বিন মোহাম্মদ ও কাজী লতিফুর রহমানের যৌথ উদ্যোগে রচিত ও প্রভিনশিয়াল বুক ডিপো থেকে প্রকাশিত ‘শেখ মুজিব ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, এ দেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্ব পুরুষদের আগমন ঘটেছিল পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। সুফি মতবাদের ওপর ভিত্তি করে এ দেশে পবিত্র ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে মধ্যপ্রাচ্য থেকে বহুসংখ্যক পীর, ফকির, আউলিয়া এবং দরবেশদের আগমন ঘটেছিল। ইংরেজী ১৪৬৩ খ্রিস্টাব্দে সুদূর বাগদাদ থেকে হযরত বায়েজিদ বোস্তামি (র.) এদেশে এসেছিলেন। তার অন্যতম শিষ্য ছিলেন দরবেশ শেখ আউয়াল। এই গ্রন্থ থেকে আরও জানা যায়, দরবেশ শেখ আউয়াল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহ্যবাহী বংশের সূত্রপাত। শেখ আউয়ালের সপ্তম বংশধর হলেন শেখ মুজিবুর রহমান।

বাঙালির মহান এই নেতা আজীবন ধর্মের প্রতি অনুরক্ত থেকেছেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েছেন। ধর্মের অন্যান্য বিধি-বিধানও মেনে চলেছেন। তিনি তার জীবনে কাউকে কোনোদিন নিজের অধীনে রাখতে চাপ প্রয়োগ করেননি। তিনি সব ধর্মের প্রতি সমান নজর দিয়েছেন। খ্রিস্টান-হিন্দু-বৌদ্ধ সবাই তার কাছে ছিলেন সমান। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু প্রায়শই বলতেন, স্বাধীনতার যুদ্ধে এদেশের সবাই যুদ্ধ করে দেশটাকে মুক্ত করেছে। স্বাধীন করেছে। এই দেশের মাটির জন্য, আলো-বাতাসের জন্য একজন মুসলমানের যতটুকু অধিকার আছে ঠিক একই পরিমাণ অধিকার অন্য ধর্মাবলম্বীদেরও। স্কুল জীবন থেকে রাজনীতির শুরু আর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি রাজনীতিতে মগ্ন ছিলেন। রাজনীতিতে পরমতসহিষ্ণুতার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

দুই.
‘ফরিদপুরের অখ্যাত এক

টুঙ্গিপাড়া গ্রাম

ইতিহাসে টুঙ্গিপাড়ার

নাম লিখে রাখলাম।

বাংলাদেশের ইতিহাসে

অনন্য সেই নাম

ইতিহাসে শেখ মুজিবের

নাম লিখে রাখলাম।’

ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন তার একটি ছড়ায় বঙ্গবন্ধুর নাম ইতিহাসের পাতায় লিখে রাখবার কথা বলেছেন। আরো বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ার কথাও। গোপালগঞ্জের অখ্যাত এক গ্রাম, সেই গ্রাম বাঙালির ইতিহাসের মহানায়ককে ধারণ করেছিল। লালন-পালন করেছিল। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যত কবিতা-গল্প-উপন্যাস-ছড়া-নাটক-প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখা হয়েছে পৃথিবীর আর কোনো রাষ্ট্রনায়ককে নিয়ে এত সৃজনশীল রচনা রচিত হয়নি।

বঙ্গবন্ধু, বাঙালি ও বাংলাদেশ, এক সুতোয় বাঁধা। একে অপরের পরিপূরক। এর একটিকে ছাড়া অন্যটিকে কল্পনা করা যায় না। আলাদাও করা যায় না। এই আলাদা করতে না পারার বিষয়টি কিন্তু একদিনে তৈরি হয়নি। এটা তৈরি হতে বেশ সময় লেগেছে। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী তার ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, “একাত্তরের আমরা লড়াই করে আলাদা হয়েছি ও আমাদের রাষ্ট্র গঠন করেছি। এটা সহজে হয়নি। এর জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে অনেকের দুঃখ-কষ্টের বিনিময় আমরা একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছি। সবচেয়ে বেশি যিনি কষ্ট স্বীকার করেন তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তিনি যখন কলকাতার কলেজের ছাত্র তখন থেকেই রাজনীতি করেছেন। তখন তিনি একজন তরুণ ছাত্রনেতা। তারও ছিলেন একজন বড় নেতা। তার নাম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এই গুরু বলতেন, শুধু স্বাধীন হলে চলবে না, গণতন্ত্র চাই। অর্থাৎ দেশের সাধারণ মানুষ ভোট দিয়ে নেতা বেছে নেবে। যারা সাধারণ মানুষের ভোটে নেতা হবেন, তারা সকল মানুষের যাতে ভালো হয়, সেই কাজ করবেন। কথাটা শেখ মুজিবের মনের কথা হয়ে উঠল। কিন্তু এখানেই পাকিস্তানের শাসকদের সঙ্গে তার বনিবনা হলো না। কারণ পাকিস্তান যারা শাসন করতেন প্রায় সবাই ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ। বাঙালিদের তারা ভালো চোখে দেখতেন না। তারা ভাবতেন, বাঙালিরা কখনও খাঁটি পাকিস্তানি হবে না। তারা তাদের ভাষা, বাংলাভাষাকে ভালোবাসে। তাদের চালচলনও আলাদা। পাকিস্তানের অনেক দিক দিয়ে অনেক উন্নতি হলো, কিন্তু আর প্রায় সবাই হলো পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব বাংলায় আমরা গরিবই থেকে গেলাম। আমাদের ভাগ্য দিন দিন খারাপ হতে লাগল। তখন আমাদের নেতা শেখ মুজিব বললেন, ‘এ হতে পারে না। দেশের মানুষের ভাগ্য ফেরাতে হবে। সে জন্য দেশ পরিচালনায় বাঙালির জন্য বেশি সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে’।”
 
বঙ্গবন্ধুর অকুতোভয়, সাহস, যোগ্য নেতৃত্ব আর রাজনৈতিক দূরদর্শীতার জন্য আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। একটি লাল-সবুজের পতাকা। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে এই যে পতাকার নিচে দাঁড়ালে গর্বে আমাদের বুক ভরে যায় এই আনন্দে যে আমরা বাঙালি, বাংলা আমাদের ভাষা, বাংলা আমার পরিচয়।

SUMMARY

303-1.jpeg