বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী প্রতিরোধ যুদ্ধ


- সাইফুর রহমান  ৮ আগস্ট

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া দুই কন্যা ব্যতীত পরিবারের বাকি সবাইকে সহ যখন নির্মমভাবে হত্যা করা হলো তারপর থেকে দীর্ঘ সময় স্বৈর শাসকের অধীনে ছিল দেশ। এই দীর্ঘ সময়ে চালানো হয়েছে নানা অপপ্রচার, বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারকে। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলকে প্রশ্নবিদ্ধ করার কোনো চেষ্টাই বাদ রাখা হয়নি। এমনভাবে তা করা হয়েছে যাতে করে পরবর্তী প্রজন্মকে বোঝানো যায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ব্যতীত আর কোনো রাস্তা খোলা ছিল না। পাশাপাশি প্রচার করা হয় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে সারাদেশে কেউ কোনো প্রতিবাদ করেনি, বরং খুশি হয়েছিল।

আজ ইতিহাসের আলোকে জানার চেষ্টা করবো, আসলেই কি তাই? সত্যিই কি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরে বাঙ্গালি জাতি কোনো প্রতিবাদ করেনি? প্রকৃত সত্য আসলে কি? ইতিহাস কী বলে, তা থেকে কিছুটা জানার চেষ্টা করি সত্য-মিথ্যা।
 
১) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়নের সম্মিলিত প্রতিবাদ
সাংবাদিক অজয় দাশ গুপ্ত সেসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের ছাত্র ছিলেন এবং ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় সদস্য ছিলেন, থাকতেন জগন্নাথ হলে। তৎকালীন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন সমূহের জোট ‘সংগ্রামী ছাত্র সমাজ’ এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অজয় দাশ গুপ্ত ডয়েচে ভেলের কাছে দেয়া তার এক সাক্ষাৎকারে জানান, ১৫ আগস্ট সকালেই তারা রেডিওতে বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর পান। এই খবরে তারা স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। তারা ছাত্র নেতারা ওই দিনই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রতিবাদের চেষ্টা করেন। কিন্তু সেনা সদস্যদের কড়া টহলের কারণে ব্যর্থ হন। এরপরই ঈদ ও পূজা মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ১৮ই অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় আবার খোলে। কিন্তু আগের রাতেই তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন, মধুর ক্যান্টিন, কার্জন হলসহ পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পোস্টার ও দেয়াল লিখনে ভরিয়ে দেন। দেয়াল লিখনের ভাষা ছিল ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে’। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে সংগ্রামী ছাত্র সমাজের ব্যানারে এভাবেই ঢাকায় প্রথম বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ জানান হয়।

ছাত্রনেতা মাহবুব জামান বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের করিডরে ঝটিকা মিছিলে নেতৃত্ব দেন। স্লোগান ছিল ‘মুজিব হত্যার বিচার চাই’, ‘এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে’। ছাত্রকর্মীরা ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের প্রতিবাদ–প্রতিরোধে শামিল হওয়ার আহ্বান জানান। বিশ্ববিদ্যালয়ে সাড়া পড়ে যায়।
 
অজয় দাশ গুপ্ত’র উক্ত সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, ২০শে অক্টোবর মধুর কেন্টিনের সামনে প্রথম প্রতিবাদ সমাবেশ শেষ করে পুরো ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে ছাত্ররা। পরদিন সমাবেশ করতে গেলে পুলিশের হামলায় তা সম্ভব হয়নি এবং ২৯শে অক্টোবর সমাবেশের ঘোষণা আসে। উক্ত ঘোষণার প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সেনা মোতায়েন করে টহল বাড়ানো হয় তাদের। ফলে তারা গোপনে মুজিব হত্যার প্রতিবাদে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করতে থাকেন।

৪ নভেম্বর হাজার হাজার ছাত্র মিছিল নিয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসায় যান, সেখানে নিহতের জন্য গায়েবানা জানাযা শেষে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। উক্ত সমাবেশ থেকে ফেরার পথে তারা জানতে পারেন আগের রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৪ জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। এতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে পুরো ছাত্রসমাজ, তারা পরদিন আধা বেলা হরতাল পালন করে এবং হরতাল শেষে বায়তুল মোকাররমে গায়েবানা জানাযা পড়া হয়। ৭ নভেম্বর সামরিক অভ্যুথান এবং সেনাশাসনের মুখে ছাত্রদের প্রতিবাদী আন্দোলন থমকে যায়।
 
২) মুজিববাহিনীর এক যোদ্ধার মুখে শোনা
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে আওয়ামী লীগের প্রতিটি জেলা অফিসে সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসে খুঁজে খুঁজে যাকে পেত তাকেই গ্রেপ্তার করত, ভাংচুর করা হতো। এমন অবস্থায় স্বাভাবিক রাজপথের প্রতিবাদ ছিল একেবারেই অসম্ভব। তিনি সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সীমানা পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যান সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে। ধুতি পরে, একটি সাইকেলে করেই সেদিন সীমানা পাড়ি দিয়েছিলেন সেই যোদ্ধা। ধুতি পরে হিন্দু পরিচয়ে সীমানা পাড়ি দেয়া সহজ হয়েছিল এ কারণেই যে সে সময় প্রশাসন এবং সর্বক্ষেত্রে পাকিস্তানপন্থীদের দাপট এতটাই প্রকট ছিল যে মোটামুটি অনেকেই ভেবে নিয়েছিল যে এই দেশ পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশনে চলে যাচ্ছে, এবং আবারো অস্ত্র হাতে প্রতিরোধ গড়ে তোলা ব্যতীত রক্ষা করা সম্ভব হবে না দেশকে। অপরদিকে সীমান্তরক্ষীরা হিন্দুদের সহজেই চলে যেতে দিচ্ছিল দেশ ছেড়ে। সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি।

৩) প্রতিরোধ যুদ্ধ (১৯৭৫ – ১৯৭৭)
১৫ আগস্টের পর যখন অস্ত্রের মুখে কিংবা প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে কিংবা জেলে বন্দি ছিলেন অনেকেই, আবার অনেকেই নতি স্বীকার করেছিলেন এই ভেবে যে মুজিবের তো বংশসহ মেরে ফেলা হয়েছে, দুই মেয়ে কী আর করবে; তখন একদল দামাল যোদ্ধা অস্ত্র হাতে গর্জে উঠেছিল।

ভারতের আসাম এবং মেঘালয় সীমান্তে গারো পাহাড়ের দুর্গম এলাকা এবং গহীন জঙ্গলে আস্তানা করে স্বাধীন বাংলাদেশের জনকের হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগান তুলে। সারা দেশে যখন সুশীল শ্রেণী মিন মিন করে মোস্তাক সরকারের আনুগত্য মেনে নেয়, কারফিউ এবং সান্ধ্য আইনের কারণে ঘর থেকে বের হতে পারেনি আপামর বাঙ্গালি, বিদেশি মিডিয়াতে প্রচার করা হয় দেশে সবকিছু স্বাভাবিক আছে; সে সময় সীমান্তবর্তী এলাকায় একদল যুবক অদম্য মনোবলের সাথে গজারি গাছের ডাল কেটে শুরু করে গেরিলা যুদ্ধ।

টহল পুলিশ এবং বিডিআর এর উপর অতর্কিত হামলা করে অস্ত্র সংগ্রহ শুরু করলেও পরে ভারতীয় সহযোগিতা পায় তারা। আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র এই কয়েক মাসেই প্রশিক্ষিত হয়ে উঠেন এই প্রতিরোধ যোদ্ধারা। জানা যায় ১৯৭৫ সালের নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে ১৯৭৭ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত স্থায়ী হয় উক্ত যুদ্ধ।
 
উক্ত যুদ্ধ শুধুমাত্র প্রতিকী যুদ্ধ ছিল না, বরং ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোণা জেলার সীমান্তবর্তী অনেক বড় এলাকা দখল করে নিয়েছিল প্রতিরোধ যোদ্ধারা। সীমান্তবর্তী এলাকার ৫ টি বিডিআর ক্যাম্প এবং ২টি থানা দখল করে নিয়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই যোদ্ধারা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে একাধিকবার মুখোমুখি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। উক্ত যুদ্ধে প্রায় চার শতাধিক প্রতিরোধ যোদ্ধা শহীদ হন, যারা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগান দিয়ে হাসতে হাসতে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছিলেন জাতির জনক হত্যার প্রতিবাদে।

মেঘালয় সীমান্তের অভ্যন্তরে ঘন বনাঞ্চল ঘেরা দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল চান্দুভূঁইতে গড়ে উঠে সদর দপ্তর, এবং উক্ত দপ্তরে বসে পুরোটা সময় সর্বাধিনায়কের নেতৃত্ব দেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। প্রধান অর্থ নির্বাহী ছিলেন গারো আদিবাসী চিত্ত রঞ্জন সাংমা, প্রধান নিয়োগ কর্মকর্তা ছিলেন কামারখালীর অধিবাসী আব্দুল হক। এক সময় সেক্টর হেড কোয়ার্টার স্থাপন করা হয়, নেত্রকোণা জেলার দুর্গাপূর থানার ভবানীপুরে। ওই এলাকা ছিল বাংলাদেশের ছিটমহল এবং তাতে যেতে হলে ভারতীয় সীমানা পার হয়ে যেতে হতো বলে বাংলাদেশী সেনা/বিডিআর কিংবা পুলিশের কারো পক্ষে সেখানে পৌঁছানো ছিল অসম্ভব। সেক্টর জিওসি হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন, টাঙ্গাইলের সেলিম তালুকদার, সেকেন্ড ইন কমান্ড প্রশান্ত কুমার সরকার। কোয়ার্টার গার্ডের অধিনায়ক ছিলেন শরীফুল ইসলাম খান, ডিফেন্স কমান্ডার সাইদুর রহমান। উক্ত হেড কোয়ার্টারের অধীনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বেশ কিছু সাব সেক্টর স্থাপন করা হয়।

১৯৭৬ সালের ১৯ জানুয়ারি দুর্গাপুর থানায় অভিযান চালালে ওসি তোফায়েলসহ ৮ জন পুলিশ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পালিয়ে যায় এবং ২৩ জানুয়ারি কলমান্দা থানায় আক্রমণ করে তার দখল নেয়ার পরে যোদ্ধারা আশরাফ আলী এবং তার স্ত্রী সুলতানা আশরাফকে আটক করে নিয়ে যায়। ২০শে জানুয়ারি রংরা এর সেক্টর কমান্ডার জিতেন্দ্র ভৌমিকের নেতৃত্বে যোদ্ধা আকস্মিকভাবে হানা দেয় বারোমারি এবং ফারাংপাড়া বিডিআর ক্যাম্পে। মাত্র অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই দু’টি ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় যোদ্ধারা।
 
২০-২১শে জানুয়ারি কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকায় বিশদ সংবাদ প্রকাশিত হয় এই যুদ্ধ নিয়ে। শিরোনাম করা হয়, ‘কংশ নদীর উত্তরাংশের ৩০০ বর্গমাইল এলাকা বাঘা বাহিনীর দখলে শেখ মুজিব হত্যার প্রতিরোধ চলছে।’

প্রায় আড়াই বছরের এই যুদ্ধের ইতি টানতে হয় ভারতের জাতীয় নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীর পরাজয়ের পরে এবং তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার প্রেক্ষিতে। তিনি কথা দিয়েছিলেন সকল যোদ্ধাকে ফিরিয়ে এনে পুর্নবাসন করা হবে, তবে যারা এতে আশ্বস্ত হয়েছিলেন তাদের অনেককেই পরে খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ আছে। প্রতিরোধ যোদ্ধাদের শেষ দলটি অস্ত্র ত্যাগ করে ১৯৭৮ সালের এপ্রিল মাসে।

SUMMARY

300-1.jpeg