- এখলাসুর রহমান
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে বাংলাদেশে। হত্যাকারীরাও বাংলাদেশের নাগরিক সুতরাং এর বিচারও হবে বাংলাদেশের আইনে এটাই স্বাভাবিক। খুনীদের ফাঁসির দাবিতে এদেশের সাধারণ মানুষ মিছিল, মিটিং, বিক্ষোভ ও মানববন্ধনও করেছে। আইনী প্রক্রিয়ায় যারা ধরা পড়েছে তাদের বিচার হয়েছে। বিচারে ফাঁসির রায় হয়েছে এবং সে রায় কার্যকরও হয়েছে।
এই রায় জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজ উদ্দীন, মনসুর আলী, কামরুজ্জামানের মতো নির্মম জেল হত্যার বিষয় নয়। এ রায় কর্নেল তাহেরের মতো প্রহসনমূলক বিচারের রায়ের ফাঁসি নয়। এই রায় সম্পূর্ণ এদেশীয় আইনী প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়েছে। অথচ মানবাধিকারের নামে কিছু সভ্য দেশ এই অসভ্য খুনীদের রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে।
আমেরিকা, কানাডা ও পাকিস্তানে খুনীরা আশ্রয় নিল। এই আশ্রয় দানের মানবিক ব্যাখ্যা কী। যারা অমানবিক বর্বর পশুর মতো মানুষ হত্যা করে তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করা কোন মানবতা?
পৃথিবীর সকল আইন শাসিত দেশেই এক জেলার মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত খুনের আসামি অন্য জেলায় কোনো বাড়িতে আশ্রয় নিলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে পারে। বাড়িওয়ালা তাকে হস্তান্তরে বাধা দিলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে পারে। কারণ জেনেশুনে কেউ আইনী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাধা দেবার অধিকার রাখেনা।
বলপ্রয়োগে তাকে আটকে রাখতে চাইলে পুলিশ তাকেও গ্রেফতার করতে পারে। এটিই সুস্থ ও মানবিক রীতি হওয়া স্বাভাবিক। আধুনিক সভ্য দেশ দাবিদার কানাডার দেশীয় আইনে মৃত্যুদণ্ড নেই ভালো কথা। দেশ ভিন্নতায় আইনী রীতির ভিন্নতা থাকবেই। কিন্তু আশ্রয় গ্রহণকারী বঙ্গবন্ধুর খুনী নূর চৌধুরীর ফাঁসির রায়তো কানাডার আইনে নয় হয়েছে বাংলাদেশের আইনে।
সর্বস্তরেই যদি এক ধর্ম অপর ধর্মের রীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারে। এক দেশীয় সংস্কৃতি ভিনদেশীয় রাজনীতি ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারে। একদেশ অন্যদেশের স্বাধীনতাকামী চেতনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারে তবে এক দেশ অন্য দেশের আইনী রীতির প্রতি কেন শ্রদ্ধাশীল হতে পারেনা? প্রতিটি দেশ তার জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা, কৃষ্টি কালচার ও সমাজ পারিপার্শ্বিকতার বাস্তব ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে। যেমন কিছু দেশে শিরোশ্ছেদের মতো অমানবিক প্রক্রিয়ায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের রীতি প্রচলিত রয়েছে। সে ব্যাপারে কানাডার কী বক্তব্য? আর আমেরিকাতো নিজেও মৃত্যুদণ্ড দিয়ে থাকে তাদের দেশীয় আইনেই, তবে ভিন দেশের মৃত্যুদণ্ডের রায় প্রাপ্ত ব্যক্তিকে আশ্রয় দিয়ে বিচারের রায় কার্যকরে বাধা দেয়ার ব্যাখ্যা কী।
দেশের অভ্যন্তরে এক জেলার আসামি অন্য জেলায় লুকালে তাদের ও তাদের হস্তান্তরে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে যেমন ব্যবস্থা নেয়ার বিধান রয়েছে। মানে ফাঁসির রায় প্রাপ্ত পলাতক আসামি যদি কারও বাড়িতে আশ্রয় নেয় এবং বাড়িওয়ালা যদি দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে জোরপূর্বক তার বাড়িতে রেখে দিতে চায় তখন কিন্তু আইন শৃংখলা বাহিনী ওই বাড়িওয়ালাকে গ্রেফতার করতে পারবে। মনে হয় পৃথিবীর সকল দেশেই এরকম বিধান রয়েছে। তবে এক দেশে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত খুনের আসামী অন্য দেশে লুকালে ও সেইদেশ তাকে আশ্রয় দিয়ে আইনী প্রক্রিয়া সম্পন্নে বাধার কারণ হলে সেই দেশের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের কেন আন্তর্জাতিক কোনো বিধান নেই? সেটা কি থাকা উচিত নয়? নইলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কুখ্যাত খুনীরা কানাডার মতো দেশে আশ্রয় নেবে। এসব দেশ হয়ে উঠবে খুনী আর অপরাধীদের অভয়ারণ্য।
আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ ও জাতিসংঘের সে ব্যাপারে ভাবা উচিত। সেসব দেশ খুনীদের মানবাধিকার নিয়ে তৎপর রয়েছেন কিন্তু এইসব খুনী কর্তৃক খুন হওয়া ব্যক্তিদের ও তাদের স্বজনদের মানবাধিকার নিয়ে ভাবেন না। যে নূর চৌধুরীকে কানাডা আশ্রয় দিল। সেই নূর চৌধুরী নারী, পুরুষ, শিশু, কিশোর ও যে অনাগত শিশু পৃথিবীর মুখ দেখেনি, মাতৃউদরে ছিল তাকেও হত্যা করেছে। তাদের আর্তনাদ, রক্ত ও মৃত্যযন্ত্রণার কী মানবিক ব্যাখ্যা দেবেন তারা? এযেনো বিড়াল কর্তৃক বিড়ালের পায়খানা ধূলো দিয়ে দিয়ে ঢেকে ধূলোর শুভ্র রঙে রাঙানোর মতো। তাই আমাদের দাবি এই একপেশে, মানবতাবিরোধী বিচারের রায় ঠেকানো এই অমানবিক মানবাধিকার রক্ষার রীতি বন্ধে দ্রুত আন্তর্জাতিক আইনী ব্যবস্থা নেয়া হোক।