- শেখ আদনান ফাহাদ
বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) জ্ঞান অর্জন করতে “সুদূর” চীন পর্যন্ত যাওয়ার কথা বলেছিলেন। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অবিরাম অপপ্রচার, অসহযোগিতা এবং প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ১৯৪৯ সালে স্বাধীনতা অর্জন করা চীন ক্রমশ অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি করে যেন বিশ্ব নবীর সেই পবিত্র উপদেশেরই মহিমা বহন করে চলেছে। উন্নয়নের পশ্চিমা প্রেসক্রিপশন না নিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দর্শন কাজে লাগিয়ে চীন প্রমাণ করেছে অপরের কথায় কান না দিয়ে নিজের উপর আস্থা রেখে সততার সাথে পরিশ্রম করলে সুফল আসবেই। ইতিহাসে জাপানসহ বহু বহিঃশক্তির অন্যায় আগ্রাসনের শিকার হওয়া চীন আজ নমিনাল জিডিপির হিসাবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি, বিশ্বের সবচেয়ে বড় সেনাবাহিনীর মালিক এবং সামগ্রিক সামরিক শক্তির মানদণ্ডে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম শক্তি। বিশ্লেষকদের মতে, ২০২০ সালে দার্শনিক কনফুসিয়াসের এই দেশটি বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতিতে পরিণত হবে।
ইতিহাসের পূর্ববঙ্গ, পূর্ব পাকিস্তান এবং চূড়ান্ত ভাবে বাংলাদেশের সাথে চীনের সম্পর্ক বহু প্রাচীন। সেই প্রাচীন কিন্তু মাঝে ক্ষয়ে যাওয়া সম্পর্ক আবার প্রাণ পেয়েছে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং এর বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে। এ সফর যদিও হঠাৎ করে হয়নি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে ২০১০ সালের মার্চ মাসে চারদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে চীনে যান (আমিও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি মিডিয়া টিমের সদস্য হয়ে গিয়েছিলাম)। আবার তৎকালীন ভাইস-প্রেসিডেন্ট এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং ঐ বছর বাংলাদেশ সফর করেন। সুতরাং, অক্টোবর ১৪-১৫, ২০১৬ তারিখে চীনা প্রেসিডেন্টের সফর শেখ হাসিনা সরকারের দীর্ঘদিনের কাজের ফসল, এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না।
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চীন “কৌশলগত” কারণে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল বিধায় চেতনাগত কারণে আমাদের প্রজন্মের অনেকের মনে খানিকটা সংশয় থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তবে চীনের সে সময়কার অবস্থান যে আঞ্চলিক রসায়নের বাইরে গিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ফসল ছিল, সেটাও আমরা বুঝতে পারি। বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক অনুধাবন এবং দর্শনে চীন দেশের কী পরিমাণ প্রভাব ছিল তা টের পাওয়া যায় তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের কয়েক পাতার বর্ণনায়। জাতির জনকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, অনুধাবন, অনুভূতি এবং প্রতিক্রিয়া আমাদের অনেক কিছু বুঝতে এবং সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক হবে বলে আমি মনে করি।
১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বর মাস। ফেব্রুয়ারি মাসের ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়া আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উপর সরকারি অত্যাচার নির্যাতনের রেশ তখনো বেশ প্রকট। জেল থেকে সদ্য মুক্ত মুজিব নতুন দায়িত্ব পেয়ে পার্টি গোছানোর কাজ করছেন। এমন সময় দাওয়াত পত্র আসল চীন থেকে। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে একটি রাজনৈতিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে “শান্তি” সম্মেলনে যোগ দেয়ার দাওয়াত এসেছে। পুরো পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের ৫ জন সহ ৩০ জনের একটি প্রতিনিধি দল শান্তি সম্মেলনে যোগদান করেন।
আত্মজীবনীতে ২২২ নং পৃষ্ঠায়, চীন দেশে যাত্রা শুরুর তারিখ হিসেবে শেখ মুজিব প্রথমে সেপ্টেম্বর ২৪ তারিখের কথা উল্লেখ করেছেন। আবার এও লিখেছেন, শেষ সময়ে খবর পান প্লেন ২৪ ঘণ্টা ‘লেট’। অর্থাৎ ২৫ সেপ্টেম্বর তারিখে তাঁরা ঢাকা বিমানবন্দর থেকে বিওএসি’র প্লেনে করে রওয়ানা দেন। শেখ মুজিবের ভাষায়, প্লেন ছাড়ার সময় ছিল দুপুর ১ টা। প্লেনে করে প্রতিনিধি দল প্রথমে তৎকালীন ব্রহ্মদেশ (মায়ানমার) যায়, সেখানে এক রাত থেকে পরের দিন ভোরে ব্যাংকক এ্যায়ারপোর্ট হয়ে হংকং পৌঁছান। সময় হিসেব করে তাহলে আমরা বলতে পারি, ২৬ তারিখ সন্ধ্যার দিকে তাঁরা হংকং পৌঁছান। হংকং’এ রাত কাটিয়ে পরের দিন ২৭ তারিখ শেখ মুজিব রেলগাড়িতে করে চীনের সীমান্তে পৌঁছে যান। তিনি লিখেছেন, “বোধ হয় হংকং থেকে ২৭ তারিখে রেলগাড়িতে ক্যান্টন পৌঁছালাম”(পৃষ্ঠা-২২৫)।
চীনের ভূমিতে শেখ মুজিব ও অন্যান্যদের সেদেশের শান্তি কমিটির ‘স্বেচ্ছাসেবক ও স্বেচ্ছাসেবিকারা’ অভ্যর্থনা জানায়। সেনচুনে স্টেশন থেকে ট্রেনে করে দক্ষিণ চীনের শহর ক্যান্টন (গোয়াংঝু)’এ যখন পৌঁছান তখন সন্ধ্যা। ক্যান্টনে যাওয়ার পথে ট্রেনের ভেতরে শেখ মুজিব হাঁটাহাঁটি করেছেন। নব্য স্বাধীন চীনের সাধারণ মানুষকে দেখে স্বাধীনতার শক্তিকে উপলব্ধি করতে চেয়েছেন। তিনি লিখেছেন,“ট্রেনে এ পাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত যাওয়া যায়। নতুন চীনের লোকের চেহারা দেখতে চাই। ‘আফিং’ খাওয়া জাত যেন হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। আফিং এখন আর কেউ খায়না, আর ঝিমিয়েও পড়েনা। মনে হল, এ এক নতুন দেশ, নতুন মানুষ। এদের মনে আশা এসেছে, হতাশা আর নাই। তারা আজ স্বাধীন হয়েছে, দেশের সকল কিছুই জনগণের। ভাবলাম, তিন বছরের মধ্যে এত আলোড়ন সৃষ্টি এরা কি করে করল!”। “দেশের সকল কিছুই জনগণের” লাইনটি এখানে লক্ষণীয়। স্বাধীনতা বলতে শেখ মুজিব বিশ্বাস করতেন জনগণের ভালো থাকা। “আফিং” শব্দ দিয়ে তিনি মার্কসবাদকে আলোচনায় টেনে এনেছেন। ধর্মের কথা বলে যুগে যুগে শাসকরা সাধারণ মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন। সমাজ, ব্যবস্থাকে আঘাত করে নতুনের আহবানকে বার বার বাধাগ্রস্থ করেছেন শোষকশ্রেণী।
২৭ তারিখে ক্যান্টনে থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর ভোরে দেড় হাজার মাইল আকাশপথ পাড়ি দিয়ে শেখ মুজিব অন্যান্য সঙ্গীদের সাথে বিকেলের দিকে পৌঁছান তৎকালীন চীনের রাজধানী পিকিং (বর্তমানে বেজিং)। মুজিব বলেছেন,“বিকেল বেলা আমরা পৌঁছালাম পিকিং এয়ারপোর্টে। …এই সেই পিকিং, চীনের রাজধানী। পূর্বে অনেক জাতি পিকিং দখল করেছে। ইংরেজ বা জাপান অনেক কিছু ধ্বংসও করেছে। অনেক লুটপাট করেছে, দখল করার সময়। এখন সমস্ত শহর যেন নতুন রূপ ধরেছে। পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তি পেয়ে প্রাণভরে হাসছে,”(পৃষ্ঠা- ২২৫)।
১৯৫২ সালের ১লা অক্টোবর চীনের তৃতীয় স্বাধীনতা দিবসে আয়োজিত শান্তি সম্মেলনে শেখ মুজিব এবং নানাদেশ থেকে আগত অতিথিরা অংশগ্রহণ করেন।বিপ্লবের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা পাওয়া চীন দেশের প্রশাসকরা নতুন চিন্তাধারা দিয়ে মানুষের মাঝে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে যে সমৃদ্ধির পথে যাত্রা শুরু করেছেন, তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন শেখ মুজিব।
শেখ মুজিবের মননে ও মগজে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের প্রভাব কতখানি শক্ত ছিল, তার একটা বড় উদাহরণ আমরা চীন সফরে পাই। শান্তি সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিব বক্তৃতা করেছিলেন। জীবনের প্রথম এত বড় সম্মেলনে অংশগ্রহণ! শেখ মুজিব ইংরেজিতে ভাষণ দিতে পারতেন। দেয়াটাই সাধারণ হিসেবে স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন। তাঁর ভাষায়, “আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি, তবু আমার মাতৃভাষায় বলা কর্তব্য,”। চীনে কনফুসিয়ান এবং বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও শেখ মুজিব জানতেন সেখানে বেশ কিছু মুসলমান এবং সামান্যসংখ্যক খ্রিস্টান ধর্মের লোকেরা বসবাস করেন। এত ব্যস্ততার ভেতরেও তিনি সংখ্যালঘুদের হাল-হকিকত জানতে চেষ্টা করেছেন। তিনি লিখেছেন,“একটা মসজিদে গিয়েছিলাম, তারা বললেন, ধর্মে কর্মে বাধা দেয় না এবং সাহায্যও করে না,”। রুশ লেখক অ্যাসিমভ, তুরস্কের বিখ্যাত কবি নাজিম হিকমত, চীনের বিপ্লবের অন্যতম নেত্রী মাদাম সান ইয়েৎ সেনের সাথেও তিনি ঐ সময় দেখা করেছিলেন।
শোষণহীন সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন দেখতেন শেখ মুজিব। কৃষক, মজুরসহ সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির রাজনৈতিক চেতনা লালন ও চর্চা করতেন তিনি। ভোগবাদ, পুঁজিবাদ ইত্যাদি ব্যক্তিতান্ত্রিক চেতনা ও চর্চার অবলুপ্তি ঘটিয়ে একটি সাম্যবাদী ও মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যই রাজনীতি করতেন তিনি। মুজিব চীনে জমিদারী ব্যবস্থার বিলুপ্তি অত্যন্ত ইতিবাচকতার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বর্ণনা করেছেন। শুধুমাত্র ধর্মের উপর অন্ধ বিশ্বাস করে শরীর এবং মগজ না খাটিয়ে অর্থনৈতিক পরিবর্তন কামনা যারা করেন তাদের মন মানসিকতা পরিবর্তন করতে চাইতেন তিনি। চীনদেশে চাক্ষুষ প্রমাণ পেয়ে মুজিব নতুন করে উদ্দীপিত হন।
১৯৫২ সালের ১ লা অক্টোবর শুরু হওয়া নতুন চীনের এ শান্তি সম্মেলন এগারো দিন ধরে অনুষ্ঠিত হয়। আয়োজক চীনা শান্তি কমিটি অতিথিদের জানাল যে, তারা যদি কিছুদিন চীনে থেকে দর্শনীয় স্থান এবং স্থাপনাসমূহ দেখতে চান, তাহলে ব্যবস্থা করা যাবে। মুজিব সিদ্ধান্ত নিলেন আরও কয়েকটা দিন চীনদেশে ঘুরে যাবেন। এই কয়েকদিন শেখ মুজিব ও তাঁর পশ্চিম পাকিস্তানী কিছু রাজনৈতিক সহকর্মী চীনের নানা শিল্প কারখানা, কৃষি ও কৃষকদের অবস্থা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, প্যাগোডা, মসজিদ ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। পিকিং থেকে বিদায় নিয়ে শেখ মুজিব তিয়েন শিং সমুদ্র বন্দরে এলেন। তিয়েন শিং সমুদ্র বন্দর এলাকায় দুই দিন থেকে শেখ মুজিব ও তাঁর সঙ্গীরা চীনের সাবেক রাজধানী নানকিং শহরে যান। তিয়েন শিং থেকে নানকিং যাওয়ার পথে যন্ত্রচালিত গাড়ির প্রাচুর্য না দেখে নব্য চীনের অর্থনৈতিক পলিসির বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। তাঁর ভাষায়, “নতুন সরকার গাড়ি কেনার দিকে নজর না দিয়ে জাতি গঠন কাজে আত্মনিয়োগ করেছে”। নিজে নিজে শেভ করার অভ্যাস ছিল শেখ মুজিবের। চীন সফরে মুখের দাঁড়ি পরিষ্কার করার কাজে ব্লেড কিনতে গিয়ে মুজিব বুঝতে পেরেছিলেন উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে হলে একটি দেশ ও তাঁর জনগণকে কি পরিমাণ জাতীয়তাবাদী হতে হয়। রাজধানী পিকিং (বেইজিং) এ,তিনি ব্লেড কিনতে গিয়ে পাননি। তিয়েন শিং সমুদ্র বন্দর এলাকা বিধায় সেখানে ব্লেড থাকতে পারে বলে ভেবেছিলেন তিনি। অনেক খুঁজে একটা দোকানে যে ব্লেড খুঁজে পেয়েছিলেন সেগুলো এতটাই পুরনো ছিল কাজের লাগানোর মত ছিলনা। অগত্যা তিনি হোটেলের সেলুনেই শেভ হতে বাধ্য হয়েছিলেন। সে ঘটনায় নতুন চীনের ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির ইঙ্গিত পেয়েছিলেন শেখ মুজিব।
পুরনো শহর নানকিং এ গিয়ে বিপ্লবী সান ইয়েৎ সেনের সমাধিতে ফুল দিয়ে, নীরবে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। আজীবন মাঞ্চু রাজতন্ত্র ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে স্বাধীন চীন প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের বীর বিপ্লবী সান ইয়াৎ সেনের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পতন এবং নতুন চীনের আবির্ভাবে শেখ মুজিবের মুগ্ধতা ছিল উল্লেখযোগ্য। তিনি লিখেছেন, “সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোও বুঝতে পেরেছিল চীন জাতিকে বেশি দিন দাবিয়ে রাখা যাবে না, আর শোষণও করা চলবে না।
নানকিং থেকে সাংহাই গিয়ে নানা কিছু দেখে, বঙ্গবন্ধু যে অনুভূতি এবং অনুধাবন নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন, সেটা তার রাজনৈতিক মতাদর্শেরই প্রতিফলন। বিদেশী শক্তিগুলো বারবার সাংহাই দখল করেছে। হংকং এর মতই সাংহাই ছিল বিদেশী শোষকদের আমোদ-ফুর্তির জায়গা। নতুন চীন সৃষ্টির পর বিপ্লবী সরকার সাংহাই এর অনেক ব্যক্তি মালিকানাধীন কারখানা বাজেয়াপ্ত করে, কিছু সমবায় ভিত্তিতে পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিছু কারখানা জাতীয়করণ করা হয়। শ্রমিকদের বাসস্থান, তাদের এবং পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা ও শিক্ষার ভারও নিয়েছিল নতুন সরকার। তিনি আত্মজীবনীতে লিখেছেন,“নতুন, নতুন স্কুল কলেজ গড়ে উঠেছে চারিদিকে। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ভার সরকার নিয়েছে। চীনের নিজস্ব পদ্ধতিতে লেখাপড়া শুরু করা হয়েছে।”
সাংহাই থেকে শেখ মুজিব গিয়েছিলেন চীনের কাশ্মীর বলে খ্যাত হ্যাংচো শহরে। হ্যাংচো শহরের আবহাওয়া, লেক, সবুজ প্রকৃতি, নদীতে চলমান নৌকা, মাঝি, মানুষের ভেসে বেড়ানোর এমন মনোমুগ্ধকর বর্ণনা মুজিব তাঁর আত্মজীবনীতে দিয়েছেন যে পড়লে মনে হবে কোন নামকরা সাহিত্যিক তাঁর ভ্রমণ কাহিনী বর্ণনা করছেন। হ্যাংচোকে পূর্ব বাংলার সাথে তুলনা করে শেখ মুজিব সেখানে তাঁর একটি সংক্ষিপ্ত নৌকা ভ্রমণের বিষয়ে লিখেছেন,“নৌকা ছাড়া বর্ষাকালে এখানে চলাফেরার উপায় নাই। বড়, ছোট সকল অবস্থার লোকেরই নিজস্ব নৌকা আছে। আমি নৌকা বাইতে জানি, পানির দেশের মানুষ। আমি লেকে নৌকা বাইতে শুরু করলাম,”(পৃষ্ঠা-২৩৩)।
হ্যাংচো থেকে হংকং হয়ে দেশে ফেরার পথে মুজিব ক্যান্টন হয়ে এসেছিলেন। ফেরার পথে ক্যান্টনের স্বাধীনচেতা মানুষের কর্মতৎপরতা দেখে মুজিব যেমন অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, আবার ইংরেজ কলোনি হংকং এর “কৃত্রিম সৌন্দর্য ও কৃত্রিম মানুষ” আর চোরাকারবারিদের আড্ডা দেখে ততটাই মন খারাপ করেছিলেন। চীন দেশের জনগণ ও মাও সেতুং এর সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে “নতুন প্রেরণা ও নতুন উৎসাহ” নিয়ে দেশে ফিরেন শেখ মুজিব।
চীন সফর শেষে দেশে ফিরে নিজ দেশের সরকার আর পরিস্থিতির সাথে চীনের তুলনা করার চেষ্টা করেছেন তিনি। শেখ মুজিব লিখেছেন, “আমরা স্বাধীন হয়েছি ১৯৪৭ সালে, আর চীন স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৯ সালে। যে মনোভাব পাকিস্তানের জনগণের ছিল, স্বাধীনতা পাওয়ার সাথে সাথে আজ যেন তা ঝিমিয়ে পরেছে। সরকার তা ব্যবহার না করে তাকে চেপে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে। আর চীনে সরকার জনগণকে ব্যবহার করছে তাদের দেশের উন্নয়নমূলক কাজে। তাদের সাথে আমাদের পার্থক্য হল, তাদের জনগণ জানতে পারল আর অনুভব করতে পারল এই দেশ এবং এই দেশের সম্পদ তাদের। আর আমাদের জনগণ বুঝতে আরম্ভ করল, জাতীয় সম্পদ বিশেষ গোষ্ঠীর আর তারা কেউই নন। ফলে দেশের জনগণের মধ্যে ও রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে”।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থটি ভালো করে পড়লে অনেক দ্বিধা, সংশয় থাকে না। সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণ “রাজনৈতিক” কারণে আমাদের জিএসপি সুবিধা বন্ধ রেখেছে সেখানে চীন বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম ঋণ সহায়তা নিয়ে এসেছে। যদিও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ অনেক। এদিকে চীনের শত্রু জাপান আবার আমাদের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী। ভারতও আমাদের সাথে থেকে কাজ করতে চায়। নানামুখি চ্যালেঞ্জ, সন্দেহ নেই। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে পারলে অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত “দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ” সফল হবেই, কোন সন্দেহ নেই।