বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনে সুচিন্তিত প্রাথমিক যাত্রা
হারুন হাবীব
বাঙালি ছিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী, ৫৬ শতাংশ; কিন্তু দেশটির তথাকথিত ধর্মবাদী, সামরিক সামন্তবাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠীর কাছে বিষয়টি কখনোই গুরুত্ব লাভ করেনি। ব্রিটিশ ভারতের উপনিবেশমুক্তির পর পাকিস্তান রাষ্ট্রের গোড়া থেকেই সে কারণে বঞ্চিত ও নিগৃহীত হতে থাকে পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান। বাঙালি হয়ে ওঠে পাকিস্তনের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। যে বাঙালি মুসলমান পাকিস্তান গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তারাই হয়ে ওঠে নতুন উপনিবেশের মানুষ, যারা তাদের সম্মান-সম্পদ লুণ্ঠিত হতে দেখে, বাংলা ভাষার হরণচেষ্টা দেখে, লুণ্ঠন হতে দেখে নিজের ভাষা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি।
এই প্রেক্ষাপটেই আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয় এবং সামান্য সময়ের ব্যবধানে উত্থান ঘটে অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগের, যে উত্থান ইতিহাসের আশীর্বাদ হয়ে বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেনতার স্ফুরণ ঘটায়। এই প্রেক্ষাপটেই লড়াকু শেখ মুজিবুর রহমানের আপসহীন সাহসী নেতৃত্ব সামনে এগিয়ে আসে, নতুন কর্মপরিকল্পনায় দলটি জাতীয় মঞ্চের শক্তিশালী দলে পরিণত হয়। তরুণ শেখ মুজিব নির্বাচিত হন দলের সাধারণ সম্পাদক এবং আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ সভাপতি।
পাকিস্তানের ধর্ম ও সামরিক আধিপত্যবাদী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস দেখিয়ে এদিকে ধারাবাহিকভাবে নির্যাতিত হতে থাকেন শেখ মুজিব। কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্র নন তিনি। মুসলিম লীগ ও অন্যান্য সাম্প্রদায়িক ভাবধারার বাঙালি রাজনীতিবিদদের বিশ্বাসঘাতকতার নানা দৃষ্টান্তও তাঁকে উত্তরোত্তর দৃঢ়চিত্ত করেছে। সুদূরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনায় তিনি নতুন ইতিহাস সৃষ্টির লক্ষ্যে ব্রত নিয়েছেন। ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ও উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত করেছেন তাঁর ছয় দফা, যা দ্রুত রূপান্তরিত হয়েছে বাঙালির মুক্তির সনদে।
প্রকৃতপক্ষে শেখ মুজিবের ছয় দফা প্রস্তাবটি ছিল পাকিস্তানি রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট বা মোড় ঘোরানো পদক্ষেপ। এর দফাগুলোতে সুস্পষ্ট প্রভাব পড়েছিল ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের, যেখানে পাকিস্তানকে ফেডারেল রাষ্ট্র করার কথা বলা আছে। কিন্তু পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রে সেই প্রস্তাব উপেক্ষিত হয়েছে।
নতুন প্রজন্মের মানুষের জন্য পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর্যায়ক্রমিক ইতিহাসের পঠন জরুরি। জরুরি সবিশেষ গুরুত্ব বহন করায় ৭ জুনের ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের স্মরণ। কারণ ৭ জুন ১৯৬৬ থেকেই বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা বাঙালির মন ও মানসে মিশে যেতে থাকে এবং পরবর্তী সময়ে ব্যাপক জনসম্পৃক্ততার জন্ম দেয়, যা জাতীয় জীবনের অবিস্মরণীয় অধ্যায়।
১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে ডাকা হয় পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলোর একটি সর্বদলীয় বৈঠক। বৈঠকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ছয় দফা পেশ করতে চাইলে খোদ বিরোধী দলগুলো থেকেই বিরোধিতার সম্মুখীন হন; কিন্তু শেখ মুজিব দমে যান না। সম্মেলন থেকে বেরিয়ে এক সংবাদ সম্মেলন ডেকে তিনি তাঁর প্রস্তাবগুলো উপস্থাপন করেন। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোর অস্তিত্ববিনাশী তত্ত্বটি তিনি সেদিনকার পশ্চিম পাকিস্তানের মাটিতেই প্রথম তুলে ধরেছিলেন, যা ছিল বিস্ময়কর এই রাজনীতিপুরুষের অসম সাহসী পদক্ষেপ।
শেখ মুজিব, পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশের জাতির জনক; একদিকে ছিলেন দূরদর্শী, অন্যদিকে দুঃসাহসী জননেতা, যিনি বাঙালির মরমি ও বিপ্লবী ধারার সমন্বয় ঘটিয়েছেন। তিনি হেরে যাওয়ার মানুষ ছিলেন না। অতএব সুদূরপ্রসারী লড়াই পরিকল্পনায় নামতে হয়েছে তাঁকে। ছয় দফা পেশের মাত্র এক মাসের মাথায় ১ মার্চ ১৯৬৬ তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং সাধারণ সম্পাদক হন তাঁরই যোগ্য অনুসারী তাজউদ্দীন আহমদ। স্বৈরতান্ত্রিক পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোকে আঘাত করার লক্ষ্যে এরপর ছয় দফার প্রচারে নামেন তিনি। এই প্রচারাভিযানে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় বারবার। নানা মিথ্যা মামলায়, এমনকি পাকিস্তানের নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হতে হয় তাঁকে। ৭ জুন শেখ মুজিব ও অন্যান্য সহকর্মীর গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে গোটা পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক হরতাল ডাকা হয়। ট্রেন থামানো হয়, যানবাহন বন্ধ থাকে। গণমানুষের সম্পৃক্ততা ঘটে অভাবিত। এই হরতাল চলাকালে পুলিশ ও ইপিআর গুলি চালায় টঙ্গী, তেজগাঁও, সদরঘাট ও নারায়ণগঞ্জে। শহীদ হন মনু মিয়া, সফিক, শামসুল হকসহ ১০ জন।
কিন্তু ছয় দফার আন্দোলনকে রোখা যায়নি। কারণ শেখ মুজিব ছিলেন অবিচল। কোনো হুমকি বা ভয় তাঁকে এক চুলও নড়াতে পারেনি। ছয় দফার সমর্থনে বঙ্গবন্ধু আরো যুক্তি দেখান : ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে ১৭ দিনের যুদ্ধ হয়, সেই যুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানবাসীর কাছে স্পষ্ট করে যে দেশের পূর্ব অংশের প্রতিরক্ষা পশ্চিম পাকিস্তানের করুণা বা সৌজন্যে চলতে পারে না। আরো বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা এক হাজার মাইল দূরের পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর নির্ভর করতে পারে না। বলা বাহুল্য, সাধারণ মানুষ এই দফাগুলোকে স্বল্পতম সময়ে মনেপ্রাণে গ্রহণ করে।
ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধু শুধু প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের জন্যই ছয় দফা উত্থাপন করেননি। বরং তিনি চেয়েছিলেন এমন একটি আন্দোলন, যা বাঙালি জনজীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করবে। তাঁর দূরদৃষ্টি ছিল স্বচ্ছ এবং পদক্ষেপ ছিল সুচিন্তিত। ফলে একের পর এক তাঁকে কারাগারে যেতে হয়েছে। সইতে হয়েছে অবর্ণনীয় নিপীড়ন ও নির্যাতন। কিন্তু যে স্বপ্নে বিভোর হয়ে তিনি ছয় দফার শুরু করেছিলেন, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে। স্বতঃস্ফূর্ত জনসমর্থন লাভ করেছে তাঁর প্রস্তাব। এই আন্দোলনে বড় ভূমিকা রেখেছে ছাত্র ও শ্রমিক সমাজ। আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী জেলে গেছেন। পুলিশি নিপীড়নের মাত্রা সীমা ছাড়িয়েছে। এর পরও পূর্ব বাংলার শহর-নগরে গণবিপ্লব সাধিত হয়েছে।
১৯৬৬ সালে শুরু হওয়া এই আন্দোলন ১৯৬৮-৬৯-৭০ হয়ে শেষ পর্যন্ত বাংলার মাটিকে প্লাবিত করেছে। আন্দোলনে সমর্থন দেওয়ার কারণে জনপ্রিয় পত্রিকা ইত্তেফাক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সম্পাদক মানিক মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর পরও আন্দোলনের তীব্রতা কমানো যায়নি। আন্দোলন বাঙালি জনজীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে। এক পর্যায়ে ১৯৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানকে ভারতের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে সশস্ত্র পথে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। মূল আসামি শেখ মুজিব; যদিও তিনি তখন জেলে বন্দি।
কিন্তু কোনো ষড়যন্ত্রতত্ত্বই কাজে আসেনি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে গোটা পূর্ব পাকিস্তান অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে। ফলে পাকিস্তানের লৌহমানব ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের পতন ঘটেছে। শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হয়েছে। দেশের ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান।
এরপর আসে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, যে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের কেন্দ্র ও পূর্ব পাকিস্তানে সরকার গঠনের বৈধ ও পরিপূর্ণ ম্যান্ডেট লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের ইতিহাস সেখানেই থেমে থাকেনি। সেই গণম্যান্ডেটকে অস্বীকার করে, ক্ষমতা হস্তান্তর না করে, দেশের সেনাবাহিনী বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে। এই ঘটনাপ্রবাহে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু। শুরু হয় পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাঙালিদের সশস্ত্র আন্দোলন, ঘটে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ।
বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছে। কার্যত এটি ছিল এক দফার আন্দোলনের সুচিন্তিত প্রাথমিক যাত্রা। এই আন্দোলন বাঙালি গণমানুষকে আত্মসচেতন করেছে, স্বাধীনতা অর্জনের পথে জাতিকে রণাঙ্গনে নিয়ে গেছে। এই আন্দোলন আইয়ুব খানের একনায়কত্বের পতন ঘটিয়েছে, কুখ্যাত মোনেম খাঁকে অপসারণ করেছে, এমনকি ২৩ বছরের পাকিস্তান রাষ্ট্রে প্রথমবারের মতো প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে একটি নির্বাচন সম্পাদন করতে বাধ্য করেছে। ফলে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনার আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে পত্তন ঘটেছে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। আর এই প্রক্রিয়ার মূল কারিগর, মূল নেতা ছিলেন অসামান্য রাজনীতিপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক