বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ছিল স্বাধীনতার মূলমন্ত্র

কবি পারভীন রেজা   
ছয় দফা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘অনেকেই ছয় দফা দাবি নিয়ে অনেক কথা বলেন। কিন্তু, আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি এটা (ছয় দফা দাবি) বঙ্গবন্ধুর একান্ত চিন্তার ফসল।’

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই একক চিন্তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের রোডম্যাপ মুলত রচিত হয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা থেকেই। এটি ছিল রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত।

বাংলাদেশের ইতিহাসে ছয় দফা এতোটাই গুরুত্ব বহন করে যে, এই কর্মসূচিকে বলা হয় বাঙালির মুক্তির সনদ বা ম্যাগনাকার্টা। বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থানের ইতিহাসে ছয় দফার ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

রাজনৈতিক ইতিহাসবিদ মহিউদ্দিন আহমদ তার 'আওয়ামী লীগ : উত্থানপর্ব ১৯৪৮-১৯৭০' গ্রন্থে লিখেছেন, 'ছয় দফা হঠাৎ করে আসমান থেকে পড়েনি। দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি ও ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এর তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরি হচ্ছিল। একই সঙ্গে তৈরি হয়েছিল রাজনীতিবিদদের সঙ্গে অর্থনীতিবিদদের যুগলবন্দি, স্বাধিকারের দাবিতে যাঁরা এক মোহনায় মিলেছিলেন।'

ছয় দফার মূল বক্তব্য ছিল প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয় ছাড়া সব ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকবে। পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানে দুটি পৃথক ও সহজ বিনিময়যোগ্য মুদ্রা থাকবে। সরকারের কর, শুল্ক ধার্য ও আদায় করার দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকাসহ দুই অঞ্চলের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার আলাদা হিসাব থাকবে। পূর্ব বাংলার প্রতিরক্ষা ঝুঁকি কমানোর জন্য এখানে আধা সামরিক বাহিনী গঠন ও নৌবাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপন।

বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ছয় দফা দাবির মুখে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খান বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি হুমকি দিয়ে বলেন, ছয় দফা নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে অস্ত্রের ভাষায় জবাব দেওয়া হবে। ছয় দফা কর্মসূচি জনগণের মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা সমগ্র পূর্ব বাংলা সফর করেন। ছয় দফাকে বাঙালির বাঁচার দাবি হিসেবে অভিহিত করেন।

ছয় দফা আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে অনন্য এক স্থান দখল করে আছে। যিনি এই ইতিহাস রচয়িতা তার মুখ থেকে এই ইতিহাসের গল্প শোনা বা পড়া এক অন্যরকম অনুভূতি জাগায়। আমি এখানে কারাগারের রোজনামচা থেকে কিছু ইতিহাস তুলে ধরছি মাত্র।

বঙ্গবন্ধু বলছেন, 'সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুনলাম রাতে কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়ে এসেছে। বন্দি, সিপাহীরা আলোচনা করছে। ব্যস্ত হয়ে গেলাম; বুঝতে বাকি রইলো না আওয়ামী লীগের নেতা এবং কর্মীদের নিয়ে আসা হয়েছে, ৭ জুনের হরতালকে বানচাল করার জন্য'।

বঙ্গবন্ধু এ সময় কিছু রাজনীতিবিদের মুখোশও খুলে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, 'এক অভিনব খবর কাগজে দেখলাম, মর্নিং নিউজ কাগজ ন্যাপ নেতা মি. মশিয়ুর রহমানের ফটো দিয়ে একটা সংবাদ পরিবেশন করেছে। দৈনিক ইত্তেফাক ও অনান্য কাগজেও খবরটি উঠেছে। তিনি ছয় দফার দাবি নিয়ে তার মতামত দিয়েছেন। তার মত- ছয় দফা কর্মসূচি কার্যকর হলে পরিশেষে এটি সমস্ত দেশে এক বিচ্ছিন্নতাবাদ জাগিয়ে তুলবে। এমনকি তিনি যদি প্রেসিডেন্ট হতেন, তাহলে ছয় দফা বাস্তবায়িত হতে দিতেন না'।

ছয় দফা নিয়ে এক প্রবন্ধে তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, 'পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরই বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন, এই রাষ্ট্র বাঙালির জন্য তৈরি হয়নি। একদিন বাঙালিকেই বাঙালির ভাগ্যনিয়ন্তা হতে হবে। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরই তাই এই একজন মানুষ (বঙ্গবন্ধু) তার লক্ষ্যও নির্ধারণ করে ফেলেছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তার সে লক্ষ্য পূরণও হয়। ১৯৬৬ সালে এ ছয় দফা প্রণয়নের পর বঙ্গবন্ধু এটি গ্রহণ করার জন্য আতাউর রহমান খানসহ তৎকালীন পূর্ব ও পাকিস্তানের বিরোধী দলের সব নেতার কাছেই গিয়েছিলেন। কিন্তু ছয় দফা নিয়ে অগ্রসর হলে 'ফাঁসিতে ঝুলানো হবে' এমন ভয় থেকে কোনো নেতাই এগিয়ে আসেননি। তখন বঙ্গবন্ধু নিজেই সিদ্ধান্ত নেন ছয় দফা নিয়ে তিনি জনগণের কাছে যাবেন। এর পরই এ নিয়ে জনজাগরণ সৃষ্টি হয়।’

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ৭ই জুন এক অবিস্মরণীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ দিন। ১৯৬৬ সালের এই দিন বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা আদায়ের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের ডাকে হরতাল চলাকালে নিরস্ত্র জনতার ওপর পুলিশ ও তৎকালীন ইপিআর গুলিবর্ষণ করে।

এতে ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জে মনু মিয়া, সফিক ও শামসুল হকসহ ১১ জন শহীদ হন। শহীদের রক্তে ৬ দফা আন্দোলন স্ফুলিঙ্গের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র; রাজপথে নেমে আসে বাংলার মুক্তিকামী জনগণ।

পাকিস্তানি শাসন-শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে স্বৈরাচার আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সব বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ডাকা এক জাতীয় সম্মেলনে পূর্ব বাংলার জনগণের পক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন।

পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ফিরে ৬ দফার পক্ষে দেশব্যাপী প্রচারাভিযান শুরু করেন এবং বাংলার আনাচে-কানাচে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে জনগণের সামনে ৬ দফার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। 

৬ দফা হয়ে ওঠে পূর্ব বাংলার শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির সনদ। ৬ দফার প্রতি ব্যাপক জনসমর্থন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের নেতৃত্বে স্বৈরাচারী সরকার ১৯৬৬ সালের ৮ মে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ৬ দফা আন্দোলন ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন নতুন মাত্রা পায়। শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দির মুক্তির দাবিতে ৭ই জুন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল ডাকা হয়। এদিন পুলিশের গুলিতে ১১ জন শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ নিহত হয়।

শেখ মুজিবুর রহমানের সমসাময়িক রাজনীতিক অলি আহাদ তার 'জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-১৯৭৫' গ্রন্থে লিখেছেন, 'সকাল ৮টার দিকে তেজগাঁওয়ে অবস্থিত কোহিনূর কেমিক্যাল কো. ও হক ব্রাদার্স কো. সম্মুখস্থ রাজপথের পূর্ব পার্শ্বে অবস্থিত একটি চায়ের দোকানে ধর্মঘটী শ্রমিক দল চা-নাস্তা গ্রহণকালে একজন শ্রমিক সাইকেল তথায় আসিলে দোকানে উপবিষ্ট শ্রমিকদের একজন সাইকেলের হাওয়া ছাড়িয়া দেয়। এমনি আপসী দৃশ্যে হাসি-কৌতুকের হিল্লোড় বাহিয়া যায়। হঠাৎ হরিষে বিষাদ সৃষ্টি করে একটি পুলিশ জিপের আগমন। পুলিশ জিপে আগত পুলিশ শ্রমিকদিগকে লাঠিপেটা আরম্ভ করে, শুরু হয় পাল্টা শ্রমিক প্রতিরোধ। অসহিষ্ণু পুলিশের রিভলবারের গুলিতে তিনজন শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হয়।'

ছয় দফা ঘোষণার পর ন্যাশনাল আওয়ামী র্পাটি বা ন্যাপ-এর পূর্ব পাকিস্তান প্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ শেখ মুজবিুর রহমানকে জিজ্ঞেস করছেলিনে, 'আপনি এই যে ৬ দফা দিলেন তার মূল কথাটি কী?' আঞ্চলকি ভাষায় এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন শেখ মুজবি: "আরে মিয়া বুঝলা না, দফা তো একটাই। একটু ঘুরাইয়া কইলাম।'

SUMMARY

2885-2.jpg