শান্তির দূত বঙ্গবন্ধু এবং জুলিও কুরি পদক

সৈয়দ শামসুদ্দিন আহমেদ
 
দীর্ঘ শোষণ-বঞ্চনা ও পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে স্বাধীনতা পেয়েছে বাঙালি। কিন্তু এই স্বাধীনতা অর্জন কোনোভাবেই সহজ ছিল না। এর জন্য মানুষের প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে; নির্যাতিত হতে হয়েছে লাখ লাখ মা-বোনকে। পাকিস্তানি গোষ্ঠীর শোষণ-নিপীড়ন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে সাড়ে সাত কোটি মানুষকে যিনি স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেছেন, মুক্তির মন্ত্রে দীক্ষিত করেছেন- তিনি সর্বকালের সেরা ও রূপবান পুরুষ, ক্ষণজন্মা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি আজীবন মানবমুক্তির জয়গান গেয়েছেন। মানুষের অধিকারের কথা বলতে গিয়ে কারান্তরালে গেছেন বারবার। সেই মহান মানুষটির নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। আমরা যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি এবং এর পেছনে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অসামান্য অবদান প্রত্যক্ষ করেছি, তা ভাষায় ব্যক্ত করা খুবই দুরূহ।

আকাশসম হৃদয়ের অধিকারী এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের কর্মকাণ্ড এবং রাজনৈতিক চিন্তাধারায় ছিল শুধু মানুষের কল্যাণ; মানবমুক্তি, অসাম্প্রদায়িক বিশ্ব, ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ও শান্তির বার্তা। যার পরিচয় আমরা তার কর্মকাণ্ডে দেখতে পাই। এ ছাড়া তার লেখা 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' গ্রন্থেও সেই চিন্তার ছাপ রয়েছে। ১৯৭৩ সালের ৩ মে 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'তে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, 'একজন মানুষ হিসাবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসাবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্প্রীতির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।'

বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালির নেতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন বিশ্বের নির্যাতিত গণমানুষের নেতা। যেখানে মানবতার বিপর্যয় ঘটেছে, সেখানে মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। এ জন্য বিশ্বজুড়ে মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন এই মহান নেতা। জনগণের জন্য ভালোবাসা ছিল বঙ্গবন্ধুর কর্মকাণ্ডের প্রেরণা এবং মানুষের কল্যাণই ছিল তার কর্মকাণ্ডের লক্ষ্য। এই মানবিক মূল্যবোধই তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল রাজনৈতিক সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে; যা প্রতিফলিত হয় তার বিভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শে, যেমন- গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা ও সমাজতন্ত্র। একটা কথা তিনি প্রায়ই বলতেন, 'আমার সারাজীবনের স্বপ্ন হচ্ছে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো।' তার এই প্রত্যয় থেকেই আমরা বুঝতে পারি, সমাজের উন্নয়ন সম্পর্কে তার কত ব্যাপক এবং বহুমাত্রিক ধারণা ছিল।

মানুষের জন্য কিছু করার প্রত্যয় থেকেই রাজনীতি ও সমাজের উন্নয়ন কাজে শৈশবেই জড়িয়ে পড়েন টুঙ্গিপাড়ার সেই ছোট্ট খোকা। বাইগার নদীর তীরে বেড়ে ওঠা খোকার রাজনৈতিক সচেতনতার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল দরিদ্র, নির্যাতিত ও বঞ্চিত মানুষের মুক্তির অব্যক্ত আকাঙ্ক্ষা।

তিনি ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় লঙ্গরখানায় কাজ করেছেন। কলকাতায় ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বঙ্গবন্ধু মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের লোককেই উদ্ধার করেছেন। এটা রাজনৈতিক চিন্তাধারারই পরিচায়ক। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর বঙ্গবন্ধু বঞ্চিত বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে যুক্ত হন। এজন্য তাকে বারবার কারাবরণ করতে হয়। তবে সে সময় বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতি রক্ষার পাশাপাশি তার বৃহত্তর সংগ্রাম ছিল বাঙালি জাতিকে বিভিন্ন শোষণের হাত থেকে মুক্ত করা এবং তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদের ধ্যান-ধারণার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সুষম সমাজব্যবস্থার চিন্তা। তিনি লিখেছেন, 'আমি নিজে কমিউনিস্ট নই, তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসেবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে, ততদিন দুনিয়ার মানুষের উপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না।' তিনি চেয়েছিলেন নির্যাতিত মানুষের শোষণমুক্তি এবং ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ। 'আমার দেখা নয়াচীন' বইয়ে লিখেছেন, 'রাশিয়া হউক, আমেরিকা হউক, ব্রিটেন হউক, চীন হউক, যেই শান্তির জন্য সংগ্রাম করবে তাদের সাথে আমরা সহস্র কণ্ঠে আওয়াজ তুলতে রাজি আছি, আমরা শান্তি চাই।'

বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ছিল অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি। তিনি সারাজীবন ধর্মের অপব্যাখ্যা, ধর্মের নামে সহিংসতা, ধর্ম নিয়ে রাজনীতির বিরোধিতা করেছেন। অসাম্প্রদায়িকতা বলতে যে তিনি সব সম্প্রদায়ের সহ-অবস্থানের কথা বলেছেন, শুধু তা-ই নয়; সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার যে বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে- সে কথাও স্মরণ করিয়ে দেন এবং সে উদ্দেশ্যে তিনি সারাজীবন কাজ করেন, যা ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণেও বলেছেন। জনগণকে সতর্ক করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'দেখবেন, আমাদের যেন বদনাম না হয়।' অর্থাৎ দেশে যেন কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা না ঘটে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে। ২৪ বছরের পাকিস্তানি আমলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ক্রমাগত বেগবান হয়েছে; কিন্তু তিনি সব সময়ই শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যেই ছিলেন। যা আমরা তার ৭ মার্চের ভাষণেই শুনতে পাই।

শান্তি, মুক্তি এবং মানবতার অগ্রদূত হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়তে অত্যন্ত সহায়ক হয়েছিল। পরে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে দেশটির পররাষ্ট্রনীতিতেও মানবতা, মুক্তি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি থেকে যায়। 'সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং কারও সঙ্গেই বৈরিতা নয়'- এই ছিল বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির আদর্শ ছিল জোটনিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং উপনিবেশবাদ, বর্ণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা। সমগ্র পৃথিবীর, বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামের প্রতি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে সমর্থন জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।


১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ আরবদের সমর্থনে মেডিকেল ইউনিট এবং চা পাঠিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত এই মানবতার পথ ধরে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও ২০১৭ সালে সাত লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয় দিয়ে নিজেকে সারা পৃথিবীতে মানবতার অগ্রদূত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেন। জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রাপ্তির পর বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সংস্থাটির অধিবেশনে বাংলায় বক্তৃতা করেন।

এর আগে ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগে শোষক শ্রেণি, আরেক ভাগে শোষিত। আমি শোষিতের দলে।'

শোষিত ও নিপীড়িত জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম তথা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ওই বছর (১৯৭৩) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান 'জুলিও কুরি' পুরস্কারে ভূষিত হন। ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি পরিষদের দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের শেষ দিন অর্থাৎ ২৩ মে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে তার হাতে সম্মানীয় এ পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। এ সময় সংস্থার তৎকালীন মহাসচিব রমেশ চন্দ্র বলেছিলেন- 'শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে।' এর আগে ফিদেল কাস্ত্রো, হো চি মিন, ইয়াসির আরাফাত, সালভাদর আলেন্দে, নেলসন ম্যান্ডেলা, ইন্দিরা গান্ধী, মাদার তেরেসা, জহরলাল নেহরু, মার্টিন লুথার কিং, লিওনিদ ব্রেজনেভ পেয়েছেন মর্যাদাবান এ পুরস্কার। এ সম্মানে ভূষিত হন কবি ও রাজনীতিবিদ পাবলো নেরুদা।

এ পদক ছিল বঙ্গবন্ধুর কর্মের স্বীকৃতি। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের জন্য প্রথম বৈশ্বিক সম্মান। এ পদকে ভূষিত হওয়ার পর জাতির পিতা বলেছিলেন- ''এ সম্মান কোনো ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয়। এ সম্মান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদানকারী শহীদদের, স্বাধীনতা সংগ্রামের বীরসেনানীদের। 'জুলিও কুরি' শান্তিপদক সমগ্র বাঙালি জাতির।" এ বছর বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি শান্তিপদকে ভূষিত হওয়ার ৪৮তম বছর। পাশাপাশি আমরা তার জন্মশতবার্ষিকী- মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করেছি। এই সময়ে বহু ঘাত-প্রতিঘাত জয় করে বঙ্গবন্ধুর লাল-সবুজের বাংলাদেশ অর্জন করেছে অভূতপূর্ব সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাফল্য। বঙ্গবন্ধু জনগণের 'ঐক্যবদ্ধ ও যৌথ প্রচেষ্টা'র ওপর গুরুত্ব দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন।

বিশ্বশান্তির সংগ্রামে বিজ্ঞানী দম্পতি মেরি কুরি ও পিয়েরি কুরির অবদানকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে ১৯৫০ সালে জুলিও কুরি শান্তিপদক প্রবর্তন করা হয়। ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম এবং মানবকল্যাণে শান্তির সপক্ষে বিশেষ অবদান রাখায় বঙ্গবন্ধুকে এ পদকে ভূষিত করেছিল বিশ্ব শান্তি পরিষদ। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, এর দুই বছরের মধ্যেই সাম্রাজ্যবাদীদের নীলনকশায় এক অশান্তির আগুনে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে প্রাণ দিতে হয় 'পোয়েট অব পলিটিক্স'কে। বঙ্গবন্ধু আজীবন মানবকল্যাণ ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। আজ তিনি নেই, তবে তার আদর্শ এবং দেখানো পথে জনগণের 'ঐক্যবদ্ধ ও যৌথ প্রচেষ্টা'র মাধ্যমে অগ্রযাত্রা অভিমুখে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। যার নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমাদের সবার উচিত বঙ্গবন্ধুকন্যার হাতকে শক্তিশালী করা। তার সুদূরপ্রসারী চিন্তা ও দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও যৌথ প্রচেষ্টায় গড়ে উঠবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা তথা উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। যেখানে বিরাজ করবে সদা শান্তি; লঙ্ঘিত হবে না মানবাধিকার। মানুষে মানুষে সৃষ্টি হবে অপার ভ্রাতৃত্ব- যে স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা।

উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর
vcbsfmstu@gmail.com

SUMMARY

2884-2.jpg