আগরতলা মামলা এবং আমার বাবা

এস. এম. তরিকুল ইসলাম
 ধূসর হয়ে যাওয়া বাবার হাতের লেখা চিঠি পড়ি আর স্মৃতির পাখায় ভর করে ভাবি- একজন মানুষ এতটা পথ পাড়ি দিতে পারেন কীভাবে? ২৯ বছরের চাকরি জীবনে কীভাবে ছয় বছর যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে পারেন? আমার বাবা সুবেদার আব্দুর রাজ্জাক সেটা পেরেছেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার চৌদ্দ নম্বর অভিযুক্ত হয়ে জেল খেটেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কাশ্মীর নিয়ে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করেছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিল বাবার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ১৯১৭ সালের ১০ মে বাবার জন্ম। বেঁচে নেই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করে একদল বিপথগামী। আর ২০০৪ সালের ওই ১৫ আগস্টেই বাবা প্রয়াত হন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যরা ভারতের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন- এমন অভিযোগ তুলে ১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি একটি মামলা করা হয়। মামলাটির পূর্ণ নাম ছিল 'রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান গং মামলা'। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহ ওই মামলা পরবর্তী সময়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে পরিচিতি পায়। মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে করা হয় ১ নম্বর আসামি। মোট ৩৫ জনকে আসামি করে তাদের বিরুদ্ধে একশটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উল্লেখ করে মামলা করে তৎকালীন সরকার। আমার বাবা সুবেদার আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন এ মামলার চৌদ্দ নম্বর অভিযুক্ত। মামলার অভিযোগে বলা হয়, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় কথিত ষড়যন্ত্রটি শুরু হয়েছিল। ১৯৬৮ সালে ৬ জানুয়ারি বাবাসহ ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই অভিযোগে আগে থেকেই জেলে আটক থাকা শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে ১৮ জানুয়ারি ফের গ্রেপ্তার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সামরিক হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেনাবাহিনী থেকে ছুটি নিয়ে বাবা তখন যশোরের ছোট গোবিন্দপুরের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্যকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে বাবাকে ঢাকা এনে গ্রেপ্তার করা হয়। কুর্মিটোলা সেনানিবাসে যেখানে বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল, তার অল্প দূরেই টিনশেড, একটি কক্ষে রাখা হয় বাবাসহ গ্রেপ্তার হওয়া অন্যদের। বন্দিশালায় বাবার ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য দিনের পর দিন নানা কৌশলে তার ওপর চলে অত্যাচার। 'ফাঁসির দড়িতে ঝুললেও সাক্ষ্য দেব না' স্পষ্ট করেই পাকিস্তানি সেনাদের জানিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। শুধু বাবাকে নয়, এমন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন গ্রেপ্তার হওয়া প্রায় সবাই। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও বাবা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেননি।
যুদ্ধের মাঠে মাঠেই বাবার জীবনের বড় একটা অংশ কেটে গেছে। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরির ২৯ বছরের মধ্যে ছয় বছরের বেশি সময় তিনি যুদ্ধের ময়দানে কাটিয়েছেন। দেশ স্বাধীন করার জন্য পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার কারণে আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত হন তিনি। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগদানের পরপরই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৬৫ সালে কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত এবং পাকিস্তানে পদায়ন থাকায় তিনি সে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে বাবা মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। যশোর এলাকায় কখনও যুদ্ধের ময়দানে সরাসরি অংশগ্রহণ কখনও আবার প্রশিক্ষক হিসেবে ভারতের ৮ নম্বর থিয়েটারে দায়িত্ব পালন করেছেন।

এস. এম. তরিকুল ইসলাম, জেলা প্রশাসক, গাজীপুর

SUMMARY

2880-2.jpg

সুবেদার আব্দুর রাজ্জাক, (১৯১৭-২০০৪)