বাঙালির দুই চিরসাথি রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধু

আবুল মোমেন  

করোনার অতিমারির এই সময়ে বিশ্বব্যাপী মানবিক সংকট এত প্রকট হয়ে উঠেছে যে তাকে উপেক্ষা করা অসম্ভব এবং মনে করি অনুচিত। পাশ্চাত্য সভ্যতার অভূতপূর্ব উন্নয়ন, পার্থিব জীবনের চরম উৎকর্ষের মধ্যেও কবির ভাষায়—‘এই কায়াবহুল সভ্যতার’ বিকার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ মন্তব্য তিনি করেছেন গত শতকের ত্রিশের দশকে। আজ একবিংশ শতাব্দীর এই দুঃসময়ে তাঁকে স্মরণ করার শ্রেষ্ঠ উপায় হতে পারে তাঁরই ভাবনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পথহারা, গতিহারা মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে পণ্যাসক্ত বিকারগ্রস্ত সভ্যতার সংকট নিয়ে শেষ জন্মদিনে এবং জীবনের বিভিন্ন পর্বে কবির উচ্চারিত তাৎপর্যপূর্ণ বাণীর শরণ নেওয়া।

নিশ্চিত করে বলা যায়, এখন অতিমারির দাপটের মধ্যেও পৃথিবীর নানা প্রান্তে আত্মঘাতী বোমা কিংবা বিমান থেকে গোলাবর্ষণের শিকার হচ্ছে অসহায় নারী-পুরুষ-শিশু, হয়তো ভূমধ্যসাগরে তলিয়ে যাচ্ছে ভাগ্যান্বেষী মরিয়া মানুষ, ধর্মান্ধতার বলি হচ্ছে মুক্তপ্রাণ ভাবুক কিংবা ভিন্নমতের অসংখ্য মানুষ, ধর্ষিতা হচ্ছে নারী ও কন্যাশিশু, অস্ত্রের মুখে উত্খাত হচ্ছে পরিবার, প্রাণভয়ে দেশান্তরি হচ্ছে অনেকেই, গুঁড়িয়ে যাচ্ছে বসতভিটা, পুড়ে খাক হচ্ছে জনপদ। সত্যিই মানবসভ্যতা বিপন্ন আজ।

শেষ জন্মদিনের ভাষণে সভ্যতার সংকটের কথাই বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রথম জীবনে যে ইউরোপীয় সভ্যতার দানকে অন্তরে বিশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন তার পরিণতি হয়েছিল বিশ্বাস ভঙ্গে—‘আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল।’ কবি দেখেছেন ক্ষমতামত্ত শক্তি কী অবজ্ঞাপূর্ণ ঔদ্ধত্যের সঙ্গে নিজের স্বার্থে সব দস্যুবৃত্তিকে তুচ্ছ বলে গণ্য করতে পারে। পারে কারণ পাশ্চাত্য সভ্যতা ‘তার শক্তিরূপ আমাদের দেখিয়েছে, মুক্তিরূপ দেখাতে পারে নি।’ বরং এ সভ্যতা ‘সমস্ত য়ুরোপে বর্বরতার নখদন্ত বিকাশ করে বিভীষিকা বিস্তার করছে।’ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ঘনঘটার মধ্যে কবির উপলব্ধি—‘এই মানবপীড়নের মহামারি পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভিতর থেকে জাগ্রত হয়ে উঠে মানবাত্মার অপমানে দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত বাতাস কলুষিত করে দিয়েছে।’ কবিতায় তিনি উচ্চারণ করলেন সরল সত্যভাষণ—‘নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস/শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।’

গানে বললেন—হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী, নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব;

     ঘোর কুটিল পন্থ তার, লোভজটিল বন্ধ।

এই কুটিল-আবিল পথ পাড়ি দিয়ে মানুষ কোথায় এসে পৌঁছাল?—

     ক্রন্দনময় নিখিলহৃদয় তাপদহনদীপ্ত

     বিষয়বিষবিকারজীর্ণ খিন্ন অপরিতৃপ্ত।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রস্তুতি দেখে এবং তারপর যখন যুদ্ধ শুরুই হয়ে গেল তার মধ্যে কবি দেখলেন—‘য়ুরোপে বর্বরতা কী রকম নখদন্ত বিকাশ করে বিভীষিকা বিস্তার করতে উদ্যত।

কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লবের পরে পাশ্চাত্য সভ্যতাকেই অনুসরণে বাধ্য হয়েছিল বাকি বিশ্ব। সবার সঙ্গে একই কাতারে থেকে একদিন আমাদেরও দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতে হলো, ‘প্রত্যহ দেখতে পেলুম, সভ্যতাকে যারা চরিত্র-উৎস থেকে উৎসারিত রূপে স্বীকার করেছে রিপুর প্রবর্তনায় তারা তাকে কী অনায়াসে লঙ্ঘন করতে পারে।’ ফলে পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভেতর থেকে যে মারির বিকার উত্থিত হয়েছে বলে কবি একদিন প্রত্যয়দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন তার আঘাতে জর্জরিত হচ্ছে গোটা বিশ্ব, পুরো মানবজাতি। অতিমারির প্রতাপের মুখে আত্মরক্ষার যুদ্ধে বিপর্যয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে দেখতে হচ্ছে মানুষ যে অপরাজেয় শক্তি ও ক্ষমতার সাধনা করেছে তা অজান্তে তাকে এই বিশ্ব-প্রকৃতির প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। বিশ্ববিধান বারবার লঙ্ঘনের দায়ে আজ মানবজাতি যেন মহাবিশ্বের দরবারে অভিযুক্ত হয়ে আছে, নানা দণ্ডের কশাঘাত হামলে পড়ছে জনজীবনে—ঘূর্ণিঝড়, সুনামি, ভূমিকম্প, দাবানল, উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং নানা রোগ... শেষ পর্যন্ত করোনা।

২.

আজ এই সংকটাপন্ন বিশ্বসভ্যতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমরা বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্রের সুবর্ণ জয়ন্তী যাপন করছি। একই সঙ্গে মনে রাখছি এই রাষ্ট্রটির রূপকার বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষের কথা। ৮০ বছর আগে অশীতিপর রবীন্দ্রনাথ তাঁর অস্তায়মান জীবনে নৈরাশ্যের মধ্যেও ‘সভ্যতার দৈববাণী’ শোনার প্রত্যয় ধ্বনিত করেছিল, বলেছিলেন, ‘মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপরাধ মনে করি... আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে নৈরাশ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মম আত্মপ্রকাশ হয়ত আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে।’

কবির জীবনসায়াহ্নের শেষ ভাষণের ঠিক তিন দশক পরে বসন্তের এক অপরাহ্নে সত্যিই এই বদ্বীপ বাংলায় গণমানুষের নেতা তাত্ক্ষণিক ভাষণে নবজাগ্রত বাঙালি জাতিকে ডাক দিয়েছিলেন স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়ার। তাঁর অমর ভাষণের উদ্দীপনায় সেদিন বাঙালি ফিরে পেয়েছিল আত্মবিশ্বাস, অন্তরে ধারণ করেছিল সঠিক প্রেরণা, যথার্থ দিকনির্দেশনা। বাংলা ভাষার মহত্তম কবির শেষ প্রত্যাশার অরুণোদয়ের রূপকার হয়ে এলেন রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।

কবি-ভাবুক যথার্থই বলেছিলেন—‘বহুকালের সাধনায় যখন মানুষের মহাসঙ্ঘ একটি সচেতন চরিত্র সৃজন করে তাহাই জাতিসত্ত্ব।’ ছয় দফার আন্দোলন আর একাত্তরের সংগ্রামে রাজনীতির কবির ডাকে এ বাংলায় অভূতপূর্ব জাগরণ দেখে কবির বক্তব্যের সত্যতা আমরা উপলব্ধি করেছি। হ্যাঁ, সত্যিই, ‘এইবার সময় আসিয়াছে যখন আমাদের সমাজ একটি সুবৃহৎ স্বদেশীসমাজ হইয়া উঠিবে। সময় আসিয়াছে যখন প্রত্যেকে জানিবে আমি একা নহি... এই উদার হৃদয়বেত্তার অধিকারী হওয়ার জন্যে চাই সত্যিকারের স্বাধীনমানস।’ কবির সেই আশা ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা ও আহ্বানে যেন এই বাংলায় রূপ লাভ করেছিল। তাঁর নেতৃত্বের জাদুকরী ছোঁয়ায় বাঙালির রূপান্তর ঘটল এক বীরের জাতিতে।

আত্মশক্তি প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—‘স্বদেশকে একটি বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে আমরা উপলব্ধি করতে চাই। এমন একটি লোক চাই, যিনি আমাদের সমাজের প্রতিমাস্বরূপ হইবেন। তাঁহাকে অবলম্বন করিয়াই আমরা আমাদের বৃহৎ স্বদেশীয় সমাজকে ভক্তি করিব, সেবা করিব।’ আর তখন কবির মনে হয়েছিল সেই মহান ব্যক্তিকে ‘আশ্রয় করিয়া আমাদের সমাজ এক জায়গায় আপন হৃদয় স্থাপন, আপন ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেছে।’ হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধুর মধ্যে সেই মহান ব্যক্তিকে পেয়েই আমরা স্বাধীনতার অদম্য স্পৃহায় মাথা তুলে লড়াই করে কবির প্রত্যাশাকে বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছিলাম। বঙ্গবন্ধুর জাদুকরী নেতৃত্বেই পাকিস্তানি শাসনের তিমির রাত্রির অবসান হয়েছিল—

ওই পোহাইল তিমিররাতি

পূর্বগগনে দেখা দিল নব প্রভাতছটা,

জীবনে-যৌবনে হৃদয়ে-বাহিরে

প্রকাশিল অতি অপরূপ মধুর ভাতি

বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবির প্রত্যাশা রূপ পেয়েছিল রাজনীতির কবির মধ্যে, যার স্মরণীয় প্রকাশ ঘটেছিল একালের কবি নির্মলেন্দু গুণের রচনায়—

শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,

রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে

অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন?

তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,

হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার

সকল দুয়ার খোলা? কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?

গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি :

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,

এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম?’

সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের?

ইতিহাসের এক ত্রিবেণী সঙ্গমে স্বাধীন বাংলাদেশে কবিকে স্মরণ করার পাশাপাশি তাঁর প্রত্যাশা পূরণের কারিগর রাজনীতির কবিকেও স্মরণ করি শ্রদ্ধার সঙ্গে—

কে পাঠালে এ শুভদিন নিদ্রা-মাঝে,

মহা মহোল্লাসে জাগাইলে চরাচর,

সুমঙ্গল আশীর্বাদ বরষিলে

করি প্রচার সুখবারতা—

তুমি চির সাথের সাথি

মানবজাতির কঠিন দুঃসময়ে বাঙালির দুই চিরসাথিকে আজ স্মরণ করছি ভয় না পেয়ে হতোদ্যম না হয়ে প্রতিকারের প্রেরণায় আত্মবিশ্বাসী, কল্যাণকামী ও উদ্যমী হওয়ার শক্তি সঞ্চয়ের প্রত্যাশায়।

লেখক : সাংবাদিক

SUMMARY

2877-2.jpg