বার্মার প্রেসিডেন্ট নে উইনের বাংলাদেশ সফর ও বঙ্গবন্ধুর ‘রিভারক্রজ ডিপ্লোমেসি’
মো. বায়েজিদ সরোয়ার
ডেট লাইন ২৮ এপ্রিল ১৯৭৪। সকাল ১০টা। তরল রুপার উজ্জ্বলতা নিয়ে বাংলার বুক চিরে বইছে বুড়িগঙ্গা। বৈশাখের এই রোদভরা সকালে সুসজ্জিত জাহাজ ‘পাথ ফাইন্ডার’ ভাসছে এই নদীর শান্ত জলে। সফররত বার্মার প্রেসিডেন্ট নে উইনের সম্মানে আয়োজিত নৌবিহারে এই অতিথির সঙ্গে আছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ, বাংলার নদী আর এ দেশের মানুষকে নিয়ে তাঁর স্বপ্নের কথা জেনারেল নে উইনকে বলছেন বঙ্গবন্ধু। এই জাহাজটি এখন চলছে মেঘনার পথে।
১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানিয়ে বার্মা (বর্তমানের মিয়ানমার) ছিল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানকারী রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রথম সারিতে। দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল ১৯৭২-এর ২১ মার্চ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ ১৯৭২-এর মে মাসে বার্মা সফর করেন। এরপর সেই সময়ের জ্যেষ্ঠতম কূটনীতিক খাজা মোহাম্মদ কায়সারকে (কে এম কায়সার) বার্মার রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন (অক্টোবর, ১৯৭২) বঙ্গবন্ধু। তিনি রেঙ্গুন দূতাবাসে যোগদানের পর সেখানে কূটনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল হয়। উল্লেখ্য, এর আগে কে এম কায়সার চীনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিলেন। মাও জেদং ও বিশেষত চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
এরপর কর্নেল নুরুল ইসলামকে (পরবর্তী সময়ে মেজর জেনারেল) বার্মার প্রতিরক্ষা অ্যাটাচি (ডিফেন্স অ্যাটাচি) হিসেবে নিয়োগ (অক্টোবর ১৯৭৩) প্রদান করা হয়। এভাবে রেঙ্গুনে শুরু হয় বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা কূটনীতি। এসব কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে প্রেসিডেন্ট নে উইনের বাংলাদেশ সফরের কর্মসূচি ঘোষিত হলো।
পাকিস্তান ও ভারত সফর শেষে চার দিনের (২৬-২৯ এপ্রিল) সফরে এসেছেন নে উইন (১৯১১-২০০২)। সংক্ষিপ্ত কর্মসূচি এ রকম : বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত্ ও মতবিনিময়, আনুষ্ঠানিক আলোচনা, স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণ, রাষ্ট্রীয় নৈশভোজ ও নৌবিহার...।
সরকারিভাবে এই নৌবিহারের মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে দুই দেশের নেতাদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিকভাবে মতবিনিময়। মনোরমভাবে শোভিত এই নৌভ্রমণে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন, পাটমন্ত্রী শামসুল হক, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ, কে এম কায়সারসহ আরো কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। বর্মী রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে আছেন ১৪ সদস্যের প্রতিনিধিদল। এঁদের মধ্যে অন্যতম পররাষ্ট্রমন্ত্রী উলা ফোন এবং কাউন্সিল অব স্টেটের সদস্য ড. লা হান ও ড. মঙ মঙ। রিভারক্রজটি শুরু হয়েছে ঢাকার পাগলাঘাট থেকে । বিআইডাব্লিউটিসির সুসজ্জিত জলযানটি এখন বুড়িগঙ্গা হয়ে জল কেটে কেটে চলছে চাঁদপুরের দিকে।
জাহাজে ওঠার পর হালকা নাশতা পরিবেশনের মাধ্যমে দুই দেশের নেতাদের আলাপচারিতা জমে ওঠে। অভিজ্ঞ রাষ্ট্রপ্রধান নে উইন কূটনীতি শোভন দু-একটা বাংলা শব্দ ব্যবহার করলে পরিবেশটি দ্রুত বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যান্ত্রিক তরিটি ততক্ষণে পৌঁছেছে বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরীর মিলনস্থলে। বৈশাখের নদী। জল কম, কোথাও পড়েছে চর। নদীর প্রায় মধ্য দিয়ে চলছে পাথ ফাইন্ডার। নদীর দুই তীরে গ্রামের সবুজ শোভা। নদী পারে কৃষ্ণচূড়া বনে গ্রীষ্মের আগুন। রোদ্দুর গায়ে মেখে পাখির দল উড়ছে তো উড়ছেই। ততক্ষণে বিদেশি মেহমানদের সম্মানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে।
নে উইন ঢাকা এসেছেন ২৬ এপ্রিল সকাল ১১টায়। দুই দেশের পতাকা শোভিত বিশেষ বিমান থেকে বের হয়ে আসতেই সেনাবাহিনীর দুই ফিল্ড রেজিমেন্টের কামানগুলো থেকে ২১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে বাংলার মাটিতে বরণ করা হলো। প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোহাম্মদউল্লাহ ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাদরে মান্যবর অতিথিকে অভ্যর্থনা জানান। এরপর সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে ২ ইস্ট বেঙ্গলের মেজর আহসান উল্লাহর নেতৃত্বে চৌকস দল গার্ড অব অনার প্রদান করে।
২৬ এপ্রিল বিকেলে নে উইন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন। ওই দিন রাতে বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট প্রদত্ত নৈশভোজে নে উইন বলেন, ‘আমি বন্ধুত্ব ও শুভেচ্ছার মিশন নিয়ে বাংলাদেশে এসেছি। বাংলাদেশ ও বার্মা—এ দুটি নিকটতম প্রতিবেশী দেশের জনগণ ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনে আবদ্ধ। আমি বাংলাদেশ ও বার্মার মধ্যে চিরন্তন মৈত্রীর সম্পর্ক কামনা করি।’ বঙ্গভবনের আলো ঝলমলে কক্ষে এই বক্তব্যটি উপস্থিত বাংলাদেশের নেতাদের হূদয় ছুঁয়ে যায়।
২৭ এপ্রিল, নতুন গণভবনে অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে বঙ্গবন্ধু ও নে উইনের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উভয় নেতা পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাপক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রী প্রথমেই মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের হাজার হাজার নাগরিককে বার্মায় আশ্রয় ও দ্রুত স্বীকৃতি দেওয়ায় নে উইনকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
নৌবিহারে বঙ্গবন্ধু নে উইনের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ একাকী আলোচনা করেন। তিনি ১৯৫২ সালে চীনে যাওয়ার পথে (পিকিং শান্তি সম্মেলন) রেঙ্গুনে প্রায় ১৫-১৬ ঘণ্টা যাত্রাবিরতিতে রাজধানী নগরটি ঘুরে দেখার অম্ল মধুর অভিজ্ঞতার কথা প্রেসিডেন্টকে জানান (বঙ্গবন্ধুর লেখা বই : অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও আমার দেখা নয়াচীনে এর বর্ণনা রয়েছে)। ২৭ এপ্রিল রাতে নে উইনের সম্মানে আয়োজিত প্রধানমন্ত্রীর নৈশভোজে বঙ্গবন্ধু ‘বাংলাদেশকে’ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও উপমহাদেশের ‘ভূমি সেতু’ হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের বর্তমান পররাষ্ট্রনীতি আঞ্চলিক সহযোগিতা, প্রতিবেশী বার্মার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে।’ নদী ভ্রমণে এসে প্রধানমন্ত্রী বার্মার সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কটি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেন।
নে উইন এর আগে ভারত ও পাকিস্তান সফর করলেও বাংলাদেশে এসে দেশটির নেতাদের ও সাধারণ মানুষের আন্তরিকতা তাঁকে মুগ্ধ করেছে। সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে দেশটির প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিব। অত্যন্ত স্বাধীনচেতা, তেজি অথচ অত্যন্ত আন্তরিক এই নেতাকে তিনি বুঝতে চেষ্টা করছেন। নে উইন লক্ষ করেছেন, সাধারণ মানুষের সঙ্গে এই নেতার কী আন্তরিক সম্পর্ক, কী সহজেই তিনি মানুষকে কাছে টেনে নিতে পারেন। নে উইন ১০ বছর ধরে বার্মার প্রেসিডেন্ট অথচ দেশের সাধারণ মানুষ থেকে কত দূরে। জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে এই বিষয়টি লৌহমানব নে উইনকেও ভাবায়।
নে উইন এই সফরে জুলফিকার আলী ভুট্টো ও ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় করেন। এর আগে আইয়ুব খানের সঙ্গেও অনেকবার সাক্ষাত্ ও মতবিনিময় হয়েছে। কিন্তু নে উইনের কাছে শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্ব, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি, উপমহাদেশের আঞ্চলিক সহযোগিতা, জোটনিরপেক্ষতা, বাংলাদেশকে দুই অঞ্চলের ভূমি সেতু হিসেবে দেখা ও বাংলাদেশ-বার্মা সম্পর্ক নিয়ে তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটা ভিন্নধর্মী ও আন্তরিকতাপূর্ণ বলে মনে হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের দক্ষিণ দিকে কলাগাছিয়ায় শীতলক্ষা, ধলেশ্বরী ও মেঘনা মিলেছে একত্রে। এখানে নদী-নিসর্গ একেবারেই ভিন্ন। নদীর এপার থেকে অন্য পার দেখা যায় না। কত বিচিত্র রঙের শত শত পাল তোলা নৌকা, যাত্রীবাহী লঞ্চ চলছে। নে উইন বুঝলেন, অনেক অঞ্চলে নদীই বাংলাদেশে হাইওয়ে। পাথ ফাইন্ডার জাহাজটি এখন ভাসছে মোহময়ী মেঘনার জলে।
নে উইন নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ। নদীর তীরের স্থানে স্থানে এবং নৌকায় সমবেত হয়ে হাজার হাজার গ্রামবাসী নে উইন ও বঙ্গবন্ধুকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাগত জানান। শৌখিন বর্মী নেতা তাদের ছবি তোলেন নিজের মুভি ক্যামেরায়।
বঙ্গবন্ধু ও নে উইনকে দেখে উত্ফুল্ল হয় জনতা। গ্রামবাসীর প্রতি হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান দুই নেতা। তবে বঙ্গবন্ধুর মনে কিছুটা বিষাদের ছায়া। বিভিন্ন কারণে দেশে জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে, নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে কয়েকটি হঠকারী উগ্র রাজনৈতিক দল। দেশটি এখনো যুদ্ধের ক্ষত কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এসবের মধ্যেও শুধু তাঁকে এক নজর দেখতে এসেছে হাজারো মানুষ। কষ্টে থাকা মানুষদের দেখে বঙ্গবন্ধুর প্রাণ কাঁদে।
জাহাজটি মেঘনার বক্ষে এগিয়ে যায় নদীবন্দর চাঁদপুরের দিকে। নদীটি এখানে বেশ প্রশস্ত। নৌবিহারে এ পর্যায়ে প্রায় মাছকেন্দ্রিক মধ্যহ্নভোজ শুরু হয়েছে। চাঁদপুরের কাছে এসে নৌযানটি আবার ঢাকার দিকে ফিরতি যাত্রা শুরু করেছে।
বেশ আনন্দঘন পরিবেশে নৌবিহারকালে দুই নেতা পারস্পরিক সংশ্লিষ্ট বিষয় ঘরোয়াভাবে ও মুক্তমনে মতবিনিময় করেন। দুই দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যেও অনানুষ্ঠানিকভাবে অনেক বিষয় আলোচিত হয়। বার্মার পররাষ্ট্রমন্ত্রী উলা ফোনের সঙ্গে ড. কামাল হোসেনের দীর্ঘ সময় মতবিনিময় হয়। এখানেই নৌবিহার পর্বের অনন্যতা। আলোচনার এক পর্যায়ে নে উইন বঙ্গবন্ধুকে বার্মা সফরের আমন্ত্রণ জানান। বঙ্গবন্ধু এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। তবে বঙ্গবন্ধুর আর বার্মা যাওয়া হয় না। সে এক অন্য ইতিহাস।
প্রায় ছয় ঘণ্টা নৌবিহার শেষে জাহাজটি পাগলা ঘাটে ভিড়ছে। চারদিকে বিকেলের কমলা রঙের আলোর উত্সব। এক ঝাঁক সাদা পাখি ফ্লাই পাস্টের মতো জাহাজটির ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। বার্মিজ প্রেসিডেন্ট এখন পাখিগুলোর ছবি তুলতে ব্যস্ত। জাহাজটির ‘পাথ ফাইন্ডার’ নামটি আশ্চর্য রকম অর্থবোধক। এই জলযানে নদী ভ্রমণটি বার্মা-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেন আজ নতুন পথের সন্ধান দিল। এভাবেই বৈশাখের বিকেলে শেষ হলো বঙ্গবন্ধুর ‘রিভারক্রজ ডিপ্লোমেসি’।
২৯ এপ্রিল বাংলাদেশ-বার্মা যৌথ ইশতেহার প্রকাশিত হয়। ইশতেহারে উভয় নেতা এই প্রত্যয় ব্যক্ত করেন যে ‘বাংলাদেশ-বার্মা সীমান্ত সব সময় শান্তি ও শুভেচ্ছার সীমান্ত হিসেবে বজায় থাকবে এবং তাতে দুই দেশের জনগণের চিরস্থায়ী মৈত্রীই প্রতিফলিত হবে।’ চার দিনের সফর শেষে নে উইন ২৯ এপ্রিল রেঙ্গুনের উদ্দেশে রওনা হন। যাওয়ার আগে বিমানবন্দরে তিনি (প্রেস কনফারেন্স) সাংবাদিকদের বলেন যে এই সফর অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর দুই দেশের অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
এই সফরের পর রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুই দেশের সম্পর্ক বেশ উষ্ণ ও সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠে। ১৯৭৪ সালের জুলাই মাসে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য একটি প্রতিনিধিদল বার্মা যায়। সেটাই ছিল বার্মার সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ সমঝোতার প্রথম পদক্ষেপ।
১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির (সেপ্টেম্বর) পরপরই রেঙ্গুনের চীনা রাষ্ট্রদূত কে এম কায়সারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে ওঠেন। দুই রাষ্ট্রদূতের বিভিন্ন বৈঠক ও দূতিয়ালির ফলে ঢাকা থেকে একটি প্রতিনিধিদল ১৯৭৫-এর এপ্রিলে চীনের ক্যান্টন (গুয়াংজু) বাণিজ্য মেলায় যোগদান করে। এতে বাণিজ্য শুরু করার সম্ভাবনা নিয়ে কথাবার্তা হয়। এ ছাড়া কে এম কায়সার উত্তর কোরিয়া সফর করেন ও যাত্রা পথে বেইজিংয়ে নেমে চীনা নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন। দেশে ফিরে তিনি জানান, চীনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক শিগগিরই শুরু হতে পারে।
এভাবে বৃক্ষ শোভিত, শত মন্দিরের শান্ত ও সুন্দর শহর রেঙ্গুন, সেই সময় চীনসহ পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশের কূটনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। এমনই প্রাণবন্ত ছিল বাংলাদেশ-বার্মা সম্পর্কের প্রথম দিকের দিনগুলো। এখন যা রূপকথার মতো মনে হয়।
নিষ্ঠুর গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। এই মানবিক কার্যক্রমের জন্য বাংলাদেশের জনগণের উদারতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। বর্তমানে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে আপ্রাণ লড়াই চালাচ্ছে বাংলাদেশ ।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন যুগপত্ উত্সব-উদযাপনের, তেমনি আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মসমালোচনারও। এই মাহেন্দ্রক্ষণে বাংলাদেশের অন্যতম বড় সমস্যা অর্থাত্ রোহিঙ্গা সমস্যা তথা বাংলাদেশ-বার্মার সম্পর্ক নিয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি ও আবশ্যক।
একসময় আমরা রেঙ্গুন থেকে বেইজিং পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি। অথচ প্রায় ৫০ বছর পর এখন বেইজিং থেকে রেঙ্গুন বা নেপিডাতে পৌঁছানোর পথ খুঁজছি। কেন এমন হলো? ভারত ছাড়া একমাত্র স্থলবেষ্টিত দেশ বার্মা, যা একসময় ছিল অত্যন্ত পরিচিত, কেন এত দিনেও কাছের অচিন দেশ হয়েই রইল? অসাধারণ ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব ও সম্পদশালী কার্যকর দেশটির সঙ্গে কেন গত ৫০ বছরে সৌহার্দপূর্ণ বা কার্যকর বোঝাপড়ার সম্পর্ক গড়ে উঠল না? কেন আমরা বার্মিজদের মনোজগেক বুঝতে বা অনুধাবন করতে পারিনি? এ বিষয়ে মিয়ানমারের দৃষ্টিভঙ্গি বহুল আলোচিত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা কী কী তা অনুসন্ধানের সময় এসেছে। ভবিষ্যতের ভুল এড়ানোর জন্য অতীতের ভুলগুলোর দিকে আমাদের দৃষ্টিপাত করা জরুরি।
মিয়ানমার এখন প্রায় গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান তাই আরো জটিল হয়ে পড়েছে। কিছুটা সময় সাপেক্ষ হলেও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান সম্ভব। এর জন্য একদিকে প্রয়োজন মিয়ানমারের ওপর প্রচণ্ড আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি। অন্যদিকে এর সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন, আমাদের গত ৫০ বছরের ‘মিয়ানমার নীতির’ (পলিসি) সাফল্য, ব্যর্থতা, দুর্বলতা, ভুলত্রুটির একটি নির্মোহ বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন ও পুনর্বিবেচনা ।
যার ওপর ভিত্তি করে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান তথা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক উন্নয়নে তৈরি করা যেতে পারে একটি বহুমুখী কিন্তু সমন্বিত দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি (কৌশলগত, কূটনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, জনকূটনীতিসহ বহুমুখী এনগেজমেন্ট)। এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর ‘নৌবিহার কূটনীতির’ নির্যাস এখনো দিতে পারে অনুপ্রেরণা ও প্রার্থিত আলোর সন্ধান।
লেখক : বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বাংলাদেশ রাইফেলসে (বর্তমানে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড) অধিনায়ক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।