ড. আশিকুর রহমান বিপ্লব:
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে স্বাধীন দেশের মাটিতে পা রাখেন দুদিন পর অর্থাৎ ১০ জানুয়ারি। দীর্ঘ কারাভোগের পর শারীরিকভাবে তিনি ছিলেন ক্লান্ত এবং কিছুটা অসুস্থ।
তৎকালীন IPGMR-এর পরিচালক অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুকে বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দিলেন। সে কারণে স্বদেশে আসার পরও তিনি বেশ কিছুদিন সভা-সমাবেশ থেকে দূরে ছিলেন। এরপর তিনি প্রথম যে অনুষ্ঠানে যোগদান করেন সেটা হলো ১৯৭২ সালের ৮ অক্টোবর তৎকালীন IPGMR-এর A ব্লকের দোতলায় কেন্দ্রীয় রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র উদ্বোধন। বর্তমানে যেটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগ নামে পরিচিত।
বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে গড়া কেন্দ্রীয় রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রটি অর্থাৎ বর্তমানের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগ নিয়ে এ জন্য আমরা গর্বিত। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই বিভাগে কর্মরত হতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি।
বঙ্গবন্ধু উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসে প্রথমে যে কথাটি বললেন তা হলো- ডাক্তার নুরুল ইসলাম আমাকে বলেছেন, আপনি কোথাও যাবেন না। কোনো প্রোগ্রামে অ্যাটেন্ড করবেন না। তাই কোনো প্রোগ্রামে আমি এখনো পর্যন্ত অ্যাটেন্ড করিনি। তার যখন প্রয়োজন, তিনি মনে করেছেন এখানে আসা দরকার, তিনি আমাকে নিয়ে এসেছেন। ডাক্তারের হুকুম আমাকে মানতেই হয়, আমি অসুস্থ যখন। তবুও আমি খুশি আপনাদের সঙ্গে দেখা হলো। যে রক্ত সংরক্ষণ কেন্দ্র আপনারা খুলেছেন, এটা অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। গবেষণার দিক দিয়ে এর অত্যন্ত গুরুত্ব রয়েছে। দেশের অবস্থা সম্পর্কে আপনারা জানেন। আপনাদের অবস্থা কী? স্বাধীনতা সংগ্রামে বিভিন্ন স্তরের লোকজন জীবন দিয়েছেন। এ পর্যন্ত যে নাম আমরা পেয়েছি, তাতে ৫০ জন ডাক্তার শহীদ হয়েছেন (পরবর্তী সময়ে এর সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৪)। এত জন ডাক্তার তৈরি করতে কী লাগে, তা আপনারা জানেন।
সারা দুনিয়ার ইতিহাসে দেখা যায়, যুদ্ধক্ষেত্রে ডাক্তারদের হত্যা করা হয় না। ডাক্তারদের অন্য একটা মর্যাদা আছে। দুই দেশের যখন যুদ্ধ হয় তখন ডাক্তারদের যদি গ্রেপ্তার করা হয়, তখন তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয় না, তাদের হত্যা করা হয় না। কিন্তু পাকিস্তানি নরপশুরা এত বড় পশু যে আমার ডাক্তারদেরকে তারা হত্যা করেছে। আমি অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে বলেছি, যে ডাক্তারের লিস্ট পাওয়া গেছে পিজি হাসপাতালের দরজার কাছে এই ডাক্তারদের নামগুলো ইতিহাসস্বরূপ লিখে রাখুন। প্রত্যেক ডাক্তার যেন দেখে যে, স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের দান কতখানি। তাহলে বোধহয় দেশের জনগণের প্রতি তাদের দরদ বাড়বে।
আমাদের একটা ইনস্টিটিউটের বিশেষ প্রয়োজন ছিল। আমি অন্যান্য দেশে দেখেছি। আপনারা সেটা করেছেন। এটা নিয়ে জাতি গৌরববোধ করতে পারে। যদি আরও কিছু প্রয়োজন হয় সরকার নিশ্চয়ই সেদিকে নজর রাখবে। কিন্তু শুধু পয়সা দিয়ে কিছু হয় না, সেটা আপনারা বোঝেন। পয়সার সাথে সাথে যেটা দরকার সেটা হলো মানবতাবোধ। আমরা যেন মানবতাবোধ হারিয়ে ফেলেছি।
আমি কুমিল্লায় জনসভায় বলেছিলাম, শেখ মুজিবুর রহমানকে বেটে খাওয়ালেও সোনার বাংলা গড়তে পারবেন না। যদি সোনার মানুষ গড়তে না পারেন। আমি যেন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছি আপনাদের কাছে বলতে গেলে যে, যেদিকেই আমি চাই, সেদিকেই যেন দেখি মানুষ এত নীচু হয় কী করে! মানুষ মানুষের পয়সা খায় কী করে! মানুষ গরিব-দুঃখীর কাছ থেকে কী করে লুট করে! আমি বুঝতে পারি না।
এত রক্ত! ৩০ লাখ লোকের জীবন! এত শহীদ! এত মায়ের আর্তনাদ! এত শিশুর আর্তনাদ! এত বাপ-মার ক্রন্দন! দেয়ালে দেয়ালে রক্তের লেখা। রাস্তায় রাস্তায় রক্তের স্বাক্ষর। আর সেখানে বসে, তাদেরই টাকায় সরকারি কর্মচারীরা যদি পয়সা খায়, তাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, এই দুঃখ বলবার জায়গা কোথায় আছে, আমাকে বুঝিয়ে বলেন। আইন দিয়ে তো এইটা করা যায় না। এ জন্য মানুষের হৃদয়ের পরিবর্তন দরকার, মনের পরিবর্তন দরকার, মাতবতাবোধ জাগ্রত হওয়া দরকার।
বড় ডাক্তার যারা আছেন, যারা স্পেশালিস্ট আছেন, তারা গ্রামের দিকে কেন যেতে চান না? গ্রামে তো শতকরা ৯৫ জন বাস করে। তারাই তো সম্পদ দিয়ে আমাদের সবকিছু করেছেন। নতুন নতুন শহর দেখেন, আপনাদের দোতলা অফিস দেখেন, মেডিকেলের পোস্ট গ্রাজুয়েট দেখেন, যেখানেই যান সবকিছুই তো এই বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের পয়সায়। তাদের দিকে কেন নজর দেবেন না? সাদা পোশাকের কোনো লোক দেখলে আপনারা তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেন আর গরিব, দুঃখী কোনো লোক আসলে চিৎকার করে বাইরে বসতে বলেন কেন? এই মনোভাবের পরিবর্তন আনতে হবে। এটা এখন আমাদের জাতীয় চরিত্র হয়ে গেছে।
কোনো এক খবরের কাগজ বা টেলিভিশন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনার কোয়ালিফিকেশন কী? আমি হাসতে হাসতে বলেছিলাম- Love may People. তারা আমাকে আবার জিজ্ঞস করেছিল, আপনার ডিসকোয়ালিফিকেশন কী? আমি বললাম- Love them too much. বোধ হয় সেটা অনেকেই দুর্বলতা মনে করে নিয়েছিল। সেই দুর্বলতার খাতির নিয়ে যা কিছু করে চলেছে। যদি আমরা চরিত্রের পরিবর্তন করতে না পারি তাহলে দেখবেন এমন ঝড় আসবে, সে ঝড়ে সবকিছু ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। দেশের জনগণ রক্ত দিতে কোনো দিন কার্পণ্য করেনি। গত আন্দোলনের সময় আমি জেলে যাওয়ার আগে যখন বলেছিলাম রক্ত দরকার। বাংলাদেশের মানুষ লাইন ধরে রক্ত দিয়েছিল। রক্ত আপনারা পাবেন। রক্ত বাংলার মানুষ দেয়। গুলি খেয়েও রক্ত দেয়, আবার অন্যকে বাঁচাবার জন্যও বাংলার মানুষ রক্ত দেয়। কিন্তু রক্তের সদ্ব্যবহার হওয়া দরকার এবং সেটা যদি হয় নিশ্চয় ডাক্তার সাহেব, রক্তের অভাব হবে না।
বিদেশে আমাদের অনেক ডাক্তার ও প্রফেসরের সাথে আমার দেখা হয়েছে। আমাকে দেখতে এসেছিলেন তাঁরা। ডাক্তার নুরুল ইসলামের সামনে তাঁদের বলেছি, আপনারা সবাই দেশে ফিরে আসুন। দেশ আপনাদের, দেশ আপনাদের দাবি করতে পারে। কারণ যে মেডিকেলে পড়েছেন, সে মেডিকেল কলেজগুলোতে জনগণের টাকা থেকে আপনাদের সাহায্য করা হয়েছে। আর আপনারা লেখাপড়া শিখে বিদেশে গিয়ে বড় ডিগ্রি নিয়ে সেখানেই বেশি টাকা উপার্জন করতে চান, সেটা বড় অন্যায়। কারণ আপনারা যে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন, তার পেছনে যে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে তা এ দেশের দুঃখী মানুষের ট্যাক্সের টাকা থেকে।
আমাদের নার্সিং যেন আমাদের সমাজের জন্য একটা অসম্মানজনক পেশা। আমি বুঝতে পারি না এ সমাজ কীভাবে বাঁচবে। একটা মেয়ে দেশের খাতিরে নার্সের কাজ করছে, তার সম্মান হবে না। আমি ডাক্তার সাহেবদের সঙ্গে পরামর্শ করেছিলাম যে, আপনারা আমাকে একটা কর্মসূচি দেন যাতে গ্রাজুয়েট মেয়েরাও এখানে আসতে পারে। তাদের আসতে হবে সেবার মনোবৃত্তি নিয়ে।
আপনারা ডাক্তার যারা আছেন, তাদের অনেকেই তো বিদেশে ঘুরে এসেছেন। বিদেশে যা শিখে এসেছেন তা আমাদের দেশে কেন চালু করেন না। এখানে আসলে আপনারা মনে করেন যে, আপনারা বড় ডাক্তার সাহেব হয়ে গেছেন ও নার্সরা কিছুই না। কিন্তু ওখানে ডাক্তার নার্সের সঙ্গে কথা বলতে গেলে সমীহ করে কথা বলে। ইজ্জতের সঙ্গে কথা বলে। যে কাজই করুক না কেন সে কাজের জন্য তার সম্মান আছে। এছাড়া তিনি ওয়ার্ড বয়, ক্লিনার এবং সুইপারদের কাজের কথাও উল্লেখ করেন। তাদেরও মানসম্মান দিয়ে সবার কথা বলা উচিত। কারণ সবাই সেবক। সবার সম্মিলিত কাজ ব্যতীত উন্নত সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। শুধু নিজেদের পেটের তাগিদে তারা কাজ করে না, সমাজের প্রয়োজনেও তারা কাজ করে।
১৯৭২ সালে A ব্লকের ২য় তলার জায়গা নিয়ে কেন্দ্রীয় রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রটি শুরু হয়েছিল, যা নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন আইন মোতাবেক চলছে যুগের চাহিদা মোতাবেক। বিভাগটি জরুরি বিধায় শুরু থেকেই বিভাগটির কার্যক্রম দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা চলমান ছিল এবং যা এখনো চলমান। করোনা মহামারির মধ্যেও বিভাগটির কোনো কার্যক্রম এক মিনিটের জন্যও বন্ধ হয়নি। রোগীর প্রতি দায়িত্ববোধ এবং সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকেই বিভাগের সকল শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা করোনা মহামারির মধ্যেও দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে।
পরবর্তী সময়ে পূর্বের কার্যক্রমের পাশাপাশি একই জায়গায় ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগটি মেডিসিন ফ্যাকালটির অধীনে MD (Residency), MD, FCPS, DBS&T, MTM, MCPS & PhD Course চালিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্ন থেকে। পূর্বে রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রটি শুধু রক্ত সংগ্রহ ও বিতরণে সীমাবদ্ধ ছিল অথচ এই সুদীর্ঘ সময়ে কাজের পরিধি বেড়েছে কয়েকগুণ। যেমন- Major Blood Grouping, Minor Blood Grouping, Coomb`s test, Genotype, Phenotype, Antibody detection & Titration, Blood Screening, Apheresis platelet collection, Convalescent plasma therapy, Therapeutic plasma exchange (TPE), Stem cell collection transfusion of blood & different blood products, Iron chelation etc.
১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান A ব্লকের ২য় তলায় নিজ হাতে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মাধ্যমে গড়ে তুলেছিলেন কেন্দ্রীয় রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রটি অথচ ২০২০ সালে এসে সেই একই জায়গায় ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগটি চলছে। এই সুদীর্ঘ সময়ে শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীর সংখ্যা এবং কাজের পরিধি বেড়েছে কয়েক গুণ। জায়গার স্বল্পতার কারণে Day Care-এর কার্যক্রম এবং Apheresis Unit-এর কার্যক্রম মূল বিভাগের বাইরে দুটি পৃথক জায়গায় পরিচালনা করতে হচ্ছে। বিভাগের সকল কার্যক্রম একই ছাদের নিচে করতে পারলে কাজের পরিধি এবং গুণগতমান আরও উন্নত হতো। তাই এখন সময়ের দাবি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজ হাতে গড়ে তোলা কেন্দ্রীয় রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রটি অক্ষুণ্ন রেখে নতুন একটি ভবনে বিভাগের কার্যক্রম স্থানান্তরিত করা।
লেখক: