নাসের মাহমুদ
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির রূপরেখা দিয়েছিলেন। তিনি বাংলার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির কথা ব্যক্ত করেছিলেন রেসকোর্স ময়দানে। পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলায় প্রত্যাবর্তন করে বঙ্গবন্ধু দেশ গঠনে মনোনিবেশ করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাকে কী করে গড়ে তুলবেন? বিদেশি এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার আছে সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলার মাটি আর আছে সোনার মানুষ। এই দুই দিয়েই আমি সোনার বাংলা গড়ব।’ আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না যে, বঙ্গবন্ধু সোনার মানুষ বলতে সোনালি ফসল ফলানো বাংলার কৃষককে বুঝিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর মূল শক্তি ছিল এ দেশের মানুষকে ভালোবাসা। একইসঙ্গে তিনি বাংলার মাটি, জল, সবুজ প্রকৃতি, পরিবেশকেও গভীরভাবে হৃদয়ে ধারণ করতেন। তাই তিনি উপলব্ধি করেন, সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বাঁচাতে হলে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের বিকল্প নেই। এ জন্যই স্বাধীনতার পরপর ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়তে বঙ্গবন্ধু সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমাদের গ্রামের দিকে নজর দিতে হবে। কেননা, গ্রামই কৃষি প্রধান বাংলাদেশের উৎপাদনের মূল কেন্দ্র। গ্রামের উন্নয়ন ও কৃষকের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারলেই সোনার বাংলা বাস্তবায়িত হবে।’ বঙ্গবন্ধু চিন্তায় প্রথমেই ছিল খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি। খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করতে না-পারলে সব উন্নয়ন কার্যক্রম ভেস্তে যাবে। তাই তিনি খাদ্যের বহুমুখিতার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন, ‘খাদ্য বলতে শুধু ধান, চাল, গম ও আটা, ময়দা আর ভুট্টাকে বোঝায় না; বরং মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, শাকসবজি, ফলমূল এসবকেও বোঝায়।’ ফলে তিনি সামগ্রিক কৃষি ক্ষেত্রের উন্নয়ন চেয়েছিলেন। সামগ্রিক কৃষিক্ষেত্রের মধ্যে শস্য, বীজ, তৈল, পশু সম্পদ, পোলট্রি যেমন গুরুত্বপূর্ণ; তেমনি অপরিহার্য বনজ সম্পদ, নদী, জলাশয় ও প্রকৃতি পরিবেশ সংরক্ষণ। গ্রামীণ নির্মল পরিবেশে বেড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু কৃষক ও কৃষিকে খুব গভীরভাবে চিনতেন। প্রতিবছর পলি পড়লে জমির উর্বরতা বাড়ে; কিন্তু বন্যায় প্রায়ই ফসলের মাঠে পানি ঢুকে উৎপাদন ব্যহৃত হয়-এটিও বঙ্গবন্ধুর অজানা ছিল না। তাই তিনি যন্ত্রনির্ভর বৈজ্ঞানিক কৃষিব্যবস্থা চালু করতে প্রাতিষ্ঠানিক কৃষি, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, বাঁধ নির্মাণ ও পরিবেশ সংরক্ষণে উদ্যোগী হন।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে সবুজ বিপ্লব সফল করতে কৃষি গ্র্যাজুয়েটদের আহ্বান করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আপনারা যারা কৃষি শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছেন। আপনাদের গ্রামে গিয়ে কৃষকের সঙ্গে মিশে যেতে হবে, মনোযোগ দিতে হবে তাদের চাহিদা আর কর্মের ওপর, তবেই তারা সাহসী হবে, আগ্রহী হবে, উন্নতি করবে। ফলাবে সোনার ফসল খেত ভরে। গ্রাম উন্নত হলে দেশ উন্নত হবে। কৃষককে বাঁচাতে হবে, উৎপাদন বাড়াতে হবে। তা না-হলে বাংলাদেশেকে বাঁচতে পারব না।’ গ্রাম বাংলার ষড়ঋতুর নানা রূপ দেখে অভ্যস্ত বঙ্গবন্ধু জানতেন নদীনালা, খাল-বিল গ্রামীণ পরিবেশের অন্যতম অনুষঙ্গ। কিন্তু বর্ষায় আকস্মিক ভারী উজানের ঢলে পাহাড়ি বন্যার প্রার্দুভাব এবং চৈত্র মাসের খরা ও বৃষ্টিহীনতার দরুন পানির অভাব গ্রামীণ জনজীবনে বয়ে আনে দুর্ভোগ। প্রকৃতির বিরূপ আচরণ মোকাবেলায় পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা গ্রহণে বঙ্গবন্ধু ইপিওয়াপদার পানি উইং আলাদা করে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড গঠন করেন। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী চিন্তায় ১৯৭২ সালেই প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে অভিন্ন নদীগুলোর পানির হিস্যা আদায়ে যৌথ নদী কমিশন গঠিত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুই প্রথম নদীর নাব্যতা রক্ষার্থে ১৯৭২ সালে নেদারল্যান্ডস সরকারের সঙ্গে নদী খননের জন্য ড্রেজিংয়ের চুক্তি সম্পাদন করেন। সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে সবুজ বিপ্লব সফল করতে নদীমাতৃক আবহমান বাংলার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন ইত্যাদি দুর্যোগ প্রতিরোধে বঙ্গবন্ধু কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ১৯৭৩ সালে নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ হাওড় উন্নয়ন বোর্ড ও নারায়ণগঞ্জ ড্রেজার পরিদপ্তর গঠনের উদ্যোগ নেন। বঙ্গবন্ধুর আমলে চারটি ড্রেজার ক্রয় করা হয়।
মার্চ-এপ্রিল মাসে অকস্মাৎ পাহাড়ি ঢলে হাওড় এলাকায় আগাম বন্যা দেখা দেয়। অন্যদিকে জুলাই-আগস্ট মাসে বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের ফলে ভরা কাটালের সময় জোয়ারের নোনা পানি ঢুকে উপকূলীয় এলাকায় আমন ধান তলিয়ে দেয়। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু ঢাকাস্থ নেদারল্যান্ডস অ্যাম্বাসেডরকে ডেকে অকাল বন্যা ও বড় জোয়ারের হাত থেকে ফসল রক্ষায় স্বল্প ব্যয়ে এবং স্বল্প সময়ে বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্প প্রণয়নে কারিগরি সহায়তা প্রদানের অনুরোধ করেন। ওই বছরই নেদারল্যান্ডস থেকে একটি পরামর্শক দল হাওড় ও উপকূলীয় এলাকা পরিদর্শন করে। সমীক্ষা শেষে পরামর্শক দল হাওড় এলাকার জনগণের দীর্ঘদিনের পুরোনো প্রথা ‘আফর’ বা ডুবন্ত বাঁধ (Submergible Embankment) এবং উপকূলীয় এলাকায় অষ্টামাসি বাঁধ (Coastal Dyke) তৈরির একটি প্রকল্পের সুপারিশ করে, যা Early Implementation Project (EIP) নামে ১৯৭৫-৭৬ সালে বাস্তবায়ন শুরু হয়।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রস্তুতিতে পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও স্বাধীনতার আগে এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কৌশল হিসাবে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীন বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। সবুজ ও নির্মল পরিবেশ নিশ্চিত করতে বঙ্গবন্ধু সর্বস্তরে বৃক্ষ রোপণ, উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ শেষে উপকূলীয় বনায়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেন এবং জলাভূমি রক্ষার রূপরেখা প্রণয়ন করেন। আজ সারা বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস কার্যক্রম খুবই আলোচিত বিষয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন দেশে দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস কর্মসূচি প্রণয়নের পথিকৃৎ। তিনি ঘূর্ণিঝড় থেকে জানমাল রক্ষায় ‘মুজিব কিল্লা’ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হিসাবে ১৯৭৩ সালে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিসি) প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনে চরম ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশের জনগণের দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে বঙ্গবন্ধুর অবদান চিরস্মরণীয়।
পরিবেশ সংরক্ষণ ও কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণে বনায়ন খুবই কার্যকর উদ্যোগ। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই উপকূলীয় বনায়নের সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৭২ সালে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বনজসম্পদের অবৈধ পাচার রোধে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে চিটাগাং হিল ট্র্যাক্টস ফরেস্ট ট্রানজিট রুলস-১৯৭৩ জারি করেন। এ ছাড়া জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন-১৯৭৪’ বঙ্গবন্ধুর শাসন আমলে প্রণয়ন করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘনঘন সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা পেতে উপকূলীয় বাঁধ ও বনায়ন খুবই কার্যকর। উপকূলীয় অঞ্চলকে জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় থেকে বাঁচাতে সুন্দরবনের ভূমিকা সিডর, আইলা ও আম্ফানের পর সহজবোধ্যভাবে ধরা পড়েছে। কিন্তু দূরদর্শী কালজয়ী নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই বৃক্ষরোপণ সপ্তাহের উদ্বোধনকালেই সুন্দরবন যে উপকূলের সুরক্ষা প্রাচীর তা সুস্পষ্ট করে বলেছিলেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা গাছ লাগাইয়া সুন্দরবন পয়দা করি নাই। স্বাভাবিকভাবে প্রকৃতি এটাকে করে দিয়েছে বাংলাদেশকে রক্ষা করার জন্য। বঙ্গোপসাগরের পাশে যে সুন্দরবনটা রয়েছে, এইটা হলো বেরিয়ার। এটা যদি রক্ষা করা না-হয়, তাহলে একদিন খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, কুমিল্লার কিছু অংশ, ঢাকার কিছু অংশ, এ পর্যন্ত পুরো এরিয়া সমুদ্রের মধ্যে চলে যাবে এবং এগুলো হাতিয়া, সন্দ্বীপের মতো আইল্যান্ড হয়ে যাবে। একবার যদি সুন্দরবন শেষ হয়ে যায়, তো সমুদ্র যে ভাঙন সৃষ্টি করবে, সেই ভাঙন থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় আর থাকবে না।’ বঙ্গবন্ধু সবুজ প্রকৃতির বিষয়ে প্রজ্ঞাবান ছিলেন বলেই ভবিষ্যৎ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া নিরসনে প্রাকৃতিক বনভূমির অবদান নিয়ে এত স্পষ্টভাবে সতর্কবাণী করতে পেরেছিলেন। এখানেই বঙ্গবন্ধুর প্রকৃতি দর্শন প্রতীয়মান হয়।
বাংলা, বাংলার মাটি, জল, কাদা, নদী, জলাশয় ও প্রাকৃতিক পরিবেশকে বঙ্গবন্ধু নিবিড়ভাবে আত্মস্থ করেছেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর ভাবনার মূল প্রেরণা ছিল তার দেশপ্রেম। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের পরিবেশ প্রকৃতিকে, বাংলার মানুষকে জানতেন, চিনতেন, বুঝতেন তার হাতের তালুর মতো করে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন বলেছিলেন ‘দেশকে ভালোবাসিবার প্রথম লক্ষণ ও প্রথম কর্তব্য পরিষ্কারভাবে জানা। দেশে জন্মালেই দেশ আপন হয় না। যতক্ষণ দেশকে না-জানি, ততক্ষণ সে দেশ আপনার নয়।’ দেশের প্রতিটি অঞ্চলের মানুষ ও পরিবেশ প্রকৃতির সঙ্গে গভীর সংযোগ থাকায় দেশকে আন্তরিকভাবে জেনেই বাংলার প্রকৃতির সবুজ রূপের প্রেমে পড়েন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই তিনি ১৯৭২ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের ঘোড়দৌড় বন্ধের পর বৃক্ষ রোপণ করে তৈরি করেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সবুজ পরিবেশ সুস্থ জাতি-এই ভাবনায় ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু ওয়াটার পলুশন কন্ট্রোল অর্ডিনেন্স-১৯৭৩ জারি করেন। পরিবেশ সংরক্ষণে সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশনকে জাতীয়করণ ও আধুনিকায়ন করেন। দেশের উদ্ভিদ বৈচিত্র্যে সংরক্ষণ ও শ্রেণিবিন্যাসকরণে বঙ্গবন্ধুর পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭৫ সালের ১ জুলাই বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়াম প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সবুজ বাংলাদেশ বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধু অখণ্ড জমিতে সমবায়ী বহুমুখী খামারভিত্তিক আধুনিক চাষাবাদ, মানসম্মত বীজ উৎপাদন, বিতরণ, সুষ্ঠু সার ও সেচ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের ওপর গুরুত্ব প্রদান করেন। ফসলের উৎপাদন বাড়াতে প্রতি ইঞ্চি জমিতে সবাইকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে অংশ নিতে আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধু।
নদ-নদী বাঙালির অমূল্য সম্পদ এবং খাল-বিল, নদ-নদীই আমাদের সেচের মূল উৎস শক্তি। নদীমাতৃক বাংলাদেশের নৌপরিবহণ অব্যাহত রাখতে পলি অপসারণে বঙ্গবন্ধুর সরকার ড্রেজিং কার্যক্রম জোরদার করেন। বাংলাদেশের দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মোংলা থেকে বাণিজ্যিক নৌযানগুলো সুন্দরবনের বুক চিরে প্রবাহিত শেলা নদী ওপর দিয়ে শিল্পনগরী খুলনায় যাতায়াত করত। ভারী জাহাজ চলাচলের নৌপথটি সুন্দরবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে-এ আশঙ্কায় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে লুপ কাটিং ড্রেজিংয়ের সাহায্যে বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ উপজেলার ঘষিয়াখালী থেকে রামপাল উপজেলার বেতবুনিয়া পর্যন্ত ৬.৫ কিমি. সংযোগ খাল খনন করা হয়। সুন্দরবনকে ঝুঁকিমুক্ত রেখে ১৯৭৪ সালে মোংলা ঘষিয়াখালী বাণিজ্যিক নৌপথ চালু করা হয়। কেবল অভ্যন্তরীণ নৌপথই নয়, সমুদ্র সংরক্ষণেও বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। সমুদ্রের প্রাণিজসম্পদের নির্বিচারে আহরণ, ধ্বংস, হ্রাস এবং নীল জলরাশির দূষণ রোধে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র তিন বছরের মধ্যে টেরিটোরিয়াল ওয়াটার্স অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট, ১৯৭৪ নামে প্রথম সমুদ্র আইন প্রণয়ন করেন।
বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন ভাবনায় নদীমাতৃক বাংলার জলজ প্রতিবেশ সংরক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে কৃষক ও কৃষির মানোন্নয়নের প্রচেষ্টা প্রাধান্য পেয়েছিল। সবুজ বিপ্লবের কর্মসূচি তিনি হাতে নিয়েছিলে সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যাশায়। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা মূলত ধন ধান্য পুষ্পভরা, সুজলা-সুফলা বাঙালির বসুন্ধরা। তার উন্নয়ন দর্শনের মূল লক্ষ্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সবাইকে একত্রে নিয়ে সমবায়ভিত্তিক গ্রামোন্নয়ন। টেকসই উন্নয়নের মূল কথাই কাউকে পেছনে না-ফেলে, চারপাশের প্রতিবেশকে যথাসম্ভব অক্ষুণ্ন রেখে অসমতা হ্রাসের ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন অগ্রগামিতা। বর্তমানে বিশ্বজনীন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মাধ্যমে যে কাঙ্ক্ষিত ধরিত্রীর প্রত্যাশা-তারই মূলকথা নিহিত রয়েছে বঙ্গবন্ধুর সবুজ বিপ্লবের সফল বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে।
নাসের মাহমুদ : পরিবেশবিষয়ক গবেষক