মার্চ ১৯৭১। উত্তাল মার্চে দেশজুড়ে চাউর হয় বঙ্গবন্ধু যেকোনো সময় দেবেন স্বাধীনতার ঘোষণা। কোথাও কোথাও দলে দলে যুবকরা ডামি রাইফেল নিয়ে শুরু করেন প্রশিক্ষণ। একসময় জানা গেল, ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেবেন। নেতা কী বলেন, তা জানতে সবার ছিল দুর্নিবার আগ্রহ। সাধারণ মানুষের তোড়ে রেসকোর্স তৈরি হয় জনসমুদ্রে। ৭ই মার্চ সেই ময়দানে উপস্থিত থেকে বঙ্গবন্ধুকে স্বচক্ষে দেখেছেন, তাঁর কথা শুনেছেন—এমন কয়েকজন সৌভাগ্যবানকে খুঁজে বের করে তাঁদের মুখ থেকেই সেদিনের গল্প শুনেছেন কালের কণ্ঠ’র জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক লায়েকুজ্জামান।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মোতালেব : ‘৩ মার্চ। পল্টন ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জনসভা ছিল। ওই সভায় আমি উপস্থিত ছিলাম। সভায় স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করা হয়। ছাত্রনেতাদের সঙ্গে মঞ্চে বঙ্গবন্ধুও ছিলেন। বক্তব্য দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর নামও ঘোষণা করা হলো। তবে বঙ্গবন্ধু বেশি কথা বললেন না, তাঁর কয়েকটি কথার মধ্যে অন্যতম ছিল—আমার যা বলার ৭ই মার্চ রেসকোর্সে বলব। বঙ্গবন্ধুর এ কথাটি আমার মনে খুব ধরল। ভেতরে একটা প্রবল আগ্রহ তৈরি হলো। যেভাবেই হোক ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে যেতেই হবে।’ বলছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আবদুল মোতালেব।
আবদুল মোতালেব বলেন, ‘আমি তখন ঢাকা কলেজে বিএ ক্লাসে পড়ি। বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়ির বিপরীত দিকে শুক্রাবাদে একটি মেসে থাকি। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনের সড়ক, লেকপার প্রায় সব সময় লোকে লোকারণ্য থাকে। ৬ মার্চ সকাল থেকেই বলা যায় ৩২ নম্বরের বাড়িতে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে টানা বৈঠক করে চলেছেন বঙ্গবন্ধু। বাড়ির বাইরে হাজার হাজার লোকের জটলা। আলোচনার বিষয় একটাই—কী বলবেন বঙ্গবন্ধু? ৭ই মার্চ সকালেও জ্যেষ্ঠ নেতারা এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে। সকাল থেকেই বঙ্গবন্ধুর বাসায় ছিলাম। শহরজুড়ে তখন রেসকোর্সে যাওয়ার সাজ সাজ রব। আমি মেসে এসে খেয়ে রেসকোর্স ময়দানে যাই।’ তিনি বলেন, “প্রবেশপথে এখন যেখানে পুলিশ কন্ট্রোল রুম, সেখানে একটি বড় গাছ ছিল, গাছের ডালে ডালে মানুষ উঠে বসে আছে। বঙ্গবন্ধু মঞ্চে এলেন, তোফায়েল আহমেদ স্লোগান দিচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠেই চারদিকে হাত নেড়ে জনতাকে অভিবাদন জানালেন, একই সঙ্গে জনতা তাদের হাতে থাকা লাখ লাখ লাঠি উঁচিয়ে বঙ্গবন্ধুর অভিবাদন গ্রহণ করল। বঙ্গবন্ধুর গর্জন চোখে দেখলাম, কানে শুনলাম। বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট ভাষায়ই বলে দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।”
জাফর আহমেদ গাজী
‘তখন আমি জিন্নাহ কলেজে (বর্তমান তিতুমীর কলেজ) পড়ি। বাসা ছিল মিরপুরের ইব্রাহিমপুর। তখনো কাফরুল থানা হয়নি, এটা ছিল ইউনিয়ন। এলাকাটি ছিল সেনানিবাসের অধীনে। বাবা সে সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত। এর ফলে বাড়িতে একটি রাজনৈতিক আবাহ ছিল। পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা দিচ্ছে না, গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হয়েছে, এ নিয়ে বলতে গেলে একটি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা চলছিল। কারো কাছেই সঠিক খবর ছিল না। এর মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ল ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। এ সময় মানুষের মধ্যে একটি আগ্রহ তৈরি হলো—কী বলবেন বঙ্গবন্ধু, সবাই তাঁর মুখ থেকে তা শুনবে।’ এভাবেই বলছিলেন ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রত্যক্ষদর্শী জাফর আহমেদ গাজী।
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতারা এলাকায় জনসভার কথা প্রচার করতে থাকলেন। বলা হলো, সবাইকে বাঁশের লাঠি নিয়ে জনসভায় যেতে হবে। ইব্রাহিমপুর সেনা এলাকার অধীনে থাকায় আমরা মিছিল নিয়ে যেতে পারলাম না। লাঠি নিলাম ঠিকই, তবে দুই-তিনজন করে গেলাম। বর্তমানে যেটা জাহাঙ্গীর গেট, এর নাম ছিল থার্ড গেট। সেই গেট পার হয়ে তেজগাঁও এলাকায় গিয়ে জড়ো হলাম আমরা। তেজগাঁও এলাকায় যাওয়ার পর দেখলাম রেসকোর্স অভিমুখে মানুষের ঢল। জনসভা শেষে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় ১০টা বেজে যায়।’
শেখ ওয়াসিউজ্জামান লেনিন
‘বয়স তখন ১৫-১৬। বাবা শেখ মকসুদুল ইসলাম আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ৭ই মার্চ জনসভার শৃঙ্খলা বিধানের জন্য স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। বাবা ছিলেন ওই কমিটির উপদেষ্টা। কমিটির প্রধান ছিলেন প্রয়াত জননেতা আবদুর রাজ্জাক। আমরা সে সময় গেণ্ডারিয়ায় থাকি। বাবা জনসভার শৃঙ্খলার দায়িত্বে। সে কারণে আমরা আগেই জনসভায় চলে আসি। বাসা থেকে বের হই সকাল ৮টার দিকে। গেণ্ডারিয়া থেকে হেঁটে বাঁশের লাঠি নিয়ে জনসভায় এলাম বিশাল মিছিল নিয়ে।’ বলছিলেন শেখ ওয়াসিউজ্জামান লেনিন।
তিনি বলেন, ‘আমরা জনসভায় ঢুকলাম বর্তমান ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন যেখানে সেখানে একটি গেট ছিল, সেটা দিয়ে। মনে আছে গেণ্ডারিয়া এলাকার প্যাটেল ভাই, খসরু ভাইসহ আমরা একসঙ্গে গিয়েছিলাম। একটু আগে রেসকোর্সে পৌঁছানোর কারণে আমরা মঞ্চের অনেকটা কাছাকাছি জায়গা পেয়ে গেলাম। চারদিকে শুধু লোক আর লোক। সবার হাতে বাঁশের লাঠি। বঙ্গবন্ধু মঞ্চে এলেন। এসেই চারদিকে হাত নাড়ালেন। এর পরই বঙ্গবন্ধু শুরু করলেন ভাষণ।’
নুরুল ইসলাম
‘সবে স্কুল ছেড়ে কলেজে পা দিয়েছি। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভোটে জিতে গেছে। আমি তখন গ্রামে থাকি, আমাদের বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশালে। দেশে তখন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা চলছে। অনেকটা অন্ধকারে ছিলাম আমরা। এর মাঝে আওয়ামী লীগ নেতারা এলাকায় প্রচার শুরু করলেন ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেবেন। আমরা ২০-২১ জন যুবক মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম ঢাকায় যাব নিজেরা বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে ভাষণ শুনব।’ এভাবেই সেই দিনের কথা স্মৃতিচারণা করছিলেন নুরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘টাকা-পয়সার অভাব, বাড়ি থেকে চিড়া ও গুড় গামছায় বেঁধে ৬ মার্চ রাতে ট্রেনে উঠলাম। আমাদের গ্রাম থেকে ট্রেনস্টেশনের দূরত্ব প্রায় ১০ মাইল। বাড়ি থেকে বের হলাম ৬ মার্চ দুপুরে। ঢাকায় ট্রেন এসে পৌঁছাল শেষ রাতের দিকে। স্টেশনে বসেই রাত পার করলাম। ভোরের আলো ফোটার পর রওনা হলাম রেসকোর্সের দিকে। ময়দানে বসে শুকনা চিড়া খেলাম। আমরা রেসকোর্সে পৌঁছে দেখি আগের রাতেই অনেকে এসেছেন। ধীরে ধীরে বিশাল ময়দানটি দুপুর ১২টার মধ্যেই লোকে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। বঙ্গবন্ধু স্পষ্টভাবেই স্বাধীনতার কথা বলে দিলেন। আমরা গ্রামে ফিরলে লোকজন ঘিরে ধরল। সবাই জানতে চায় বঙ্গবন্ধু কী বলেছেন। বললাম দেশ স্বাধীন হবে বঙ্গবন্ধু তা বলে দিয়েছেন।’