আজিজুল পারভেজ ও বাহরাম খান
উপমহাদেশের ইতিহাস বদলে দেওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পূর্ণাঙ্গ অডিও রেকর্ড কোথাও নেই। যে অডিও রেকর্ড রয়েছে, তা ভাষণের গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়ে সম্পাদিত ভাষণ। বাংলাদেশ সংবিধানে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের যে রূপটি তফসিলভুক্ত করা হয়েছে, সেটিও অসম্পূর্ণ এবং উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে অযত্নের ছাপ লক্ষ করা গেছে। সরকার গঠিত একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি ভাষণটি প্রামাণ্যকরণ করেছে। তাতে প্রায় ৫০ বছর পর ভাষণটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পেল। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন অবিলম্বে সংবিধানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের বিশুদ্ধ রূপটি সংযুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের দুটি অডিও রেকর্ড পাওয়া যায়; একটি বাংলাদেশ বেতারের ধারণকৃত আর অন্যটি চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের ধারণকৃত। আর লিখিত রূপ পাওয়া যায় বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চম তফসিলে [১৫০(২) অনুচ্ছেদ]। বাংলা একাডেমিও ভাষণটির একটি লিখিত রূপ প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রকাশনায় বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি। কোনো ভাষণই পূর্ণাঙ্গ নয়। অমিলও লক্ষ করা যায়। বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি কত সময়ের ছিল তা-ও একেক জায়গায় একেক রকম উল্লেখ আছে। কেউ বলেন ১৮ মিনিট, কেউ বলেন ১৯ মিনিট, কেউ বলেন ২৬ মিনিট। কেউ বা বলেন আধাঘণ্টা।
বঙ্গবন্ধুর জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণটি লিখিত ছিল না। এ কারণে এই ভিন্নতা। ভাষণটি প্রামাণ্যকরণের জন্য গত বছরের অক্টোবরে ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত ৭ মার্চের ঐতিহাসিক প্রকৃত ভাষণ নিশ্চিতকরণ’ শীর্ষক একটি কমিটি গঠন করে তথ্য মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক এস এম হারুন-অর-রশিদকে সভাপতি করে গঠিত সাত সদস্যের কমিটির সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের (পিআইবি) মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদ। কমিটির অন্য সদস্যরা হচ্ছেন বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান, ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, বাংলাদেশ বেতারের সাবেক উপমহাপরিচালক আশফাকুর রহমান খান, বেতারের মহাপরিচালক হোসনে আরা তালুকদার এবং চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক স ম গোলাম কিবরিয়া।
এই কমিটি ভাষণের অডিও রেকর্ড এবং বর্তমানে প্রাপ্ত লিখিত রূপ সমন্বয় করে একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ তৈরি করেছে। জাফর ওয়াজেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশ বেতার, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা দপ্তর, বাংলা একাডেমি মুদ্রিত ভাষণের অনুলিপি এবং ওই সময়ে ব্যক্তিগতভাবে ভাষণ সংগ্রহকারীদের সহযোগিতায় ৭ই মার্চ ভাষণের একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিলিপি তৈরি করে আমরা জমা দিয়েছি।’ তথ্য মন্ত্রণালয়ের কমিটির জমা দেওয়া ভাষণের সঙ্গে সংবিধানে থাকা ভাষণ পরীক্ষা করে অন্তত ৭৫টি জায়গায় অমিল পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে।
ভাষণের শুরুতে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণের বর্ণনা দিতে গিয়ে কয়েকটি বড় শহরের নাম উল্লেখ করেন। সংবিধানে থাকা ভাষণে ‘খুলনা’র নাম বাদ পড়েছে। এর দুটি বাক্য পরেই দেশের মানুষের অধিকারের বিষয়টি তুলে ধরেন বঙ্গবন্ধু। ভাষণে অধিকার শব্দের আগে ‘ন্যায্য’ শব্দটি সংবিধানে নেই। পরের বাক্যে (আন্ডারলাইন অংশগুলো ভাষণে নেই) আপনারা নির্বাচনে গিয়ে নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে আপনার ভোট দেন। আমরা ভোট পাই।
বক্তব্যের দ্বিতীয় ধাপের প্রথম বাক্য ‘আমরা দেশের একটা শাসনতন্ত্র তৈয়ার করবো’ সংবিধানে পাওয়া যায়নি। সংবিধানে ভাষণটি সংযোজনের ক্ষেত্রে সাধারণ বানান ও অর্থের দিকেও যে ন্যূনতম মনোযোগ দেওয়া হয়নি তা বোঝা যায়। বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘এ দেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে।’ সংবিধানে লেখা হয়েছে, ‘এ দেশের মানুষ অর্থনীতি, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে।’
বঙ্গবন্ধুর অন্যতম বড় গুণ ছিল তিনি তাঁর পরম শত্রুকেও সম্মান দিয়ে কথা বলতেন। বক্তব্যের যত জায়গায় পাকিস্তানের তৎকালীন স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া এবং পিপিপি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর কথা উল্লেখ করেছেন, ততবারই তাঁদের নামের শেষে ‘সাহেব’ সম্বোধন করেছেন। কিন্তু সংবিধানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ‘সাহেব’ শব্দটি নেই। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু ‘তৈয়ার’ শব্দটি উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু সংবিধানে ‘তৈরি’ লেখা হয়েছে।
সংবিধানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের আরো যে কথা নেই তা আন্ডারলাইন করে তুলে ধরা হলো। কমিটির উপস্থাপিত প্রতিলিপির চতুর্থ প্যারায় বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের শুরু ‘তারপরে অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হলো, আপনারা জানেন। দোষ কি আমাদের? আজকে তিনি...’ এর পরের প্যারায় ‘তারপরে জনাব ভুট্টো সাহেব এসেছিলেন।...তারপরে পশ্চিম পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামির নেতা নূরানি সাহেবের সঙ্গে আলাপ হলো, মুফতি মাহমুদ সাহেবের সঙ্গে আলাপ হলো...। জনগণ আমাকে ভোট দিয়েছে ছয় দফা, এগারো দফা মাধ্যমে শাসনতন্ত্র করতে, এটার পরিবর্তন, পরিবর্ধন করার ক্ষমতা আমার নাই...।’ এ রকম আরো অসংখ্য বাক্য সংবিধানে লেখা হয়নি।