আমরা আপনার জন্যে প্রার্থনা করেছি : বঙ্গবন্ধুকে ব্রিটিশ পুলিশ

একাত্তরে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধুর ভাগ্য নিয়ে আতঙ্কে আচ্ছন্ন ছিল পুরো জাতি। কিন্তু, মুক্তির কয়েক ঘন্টা পর বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডন পৌঁছালেন তখন একজন ব্রিটিশ পুলিশ কর্মকর্তার এক লাইনের একটি সরল মন্তব্যে বোঝা যায়, মূলত তার নিরাপত্তার বিষয়টি বিশ্বজুড়েই সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ব্রিটিশ পুলিশ কর্মকর্তাটি বলেছিলেন, ‘স্যার, আমরা আপনার জন্যে প্রার্থনা করেছি।’

 স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের একজন ছিলেন ড. কামাল হোসেন। সম্প্রতি বাসসকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে তার পৌঁছানোর পর ব্রিটিশ পুলিশ কর্মকর্তার উপরোক্ত মন্তব্যের পটভূমি তিনি তুলে ধরেন।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরার পথে পাকিস্তানী বিমানে করে বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনে পাঠানো হয়। এসময়ে তাঁর যাত্রা পথের সঙ্গী ছিলেন ড. কামাল হোসেন। তিনি সেদিনের সেই দায়িত্বরত সাধারণ এক পুলিশ কর্মকর্তার অশ্রুভরা চোখে করা মন্তব্যের কথাটি তুলে ধরেন।
ড. কামাল হোসেন বলেন, বিমান থেকে এসকর্ট করে আমাদের যখন ভিআইপি লাউঞ্জে নিয়ে আসা হচ্ছিল তখন লাউঞ্জের বাইরে দায়িত্বরত ওই পুলিশ কর্মকর্তার করা মন্তব্যটি আমি ভুলতে পারি না।
বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে আকস্মিক ওই পুলিশ কর্মকর্তা অশ্রুসজল চোখে বলে উঠেন, ‘স্যার, আমরা আপনার জন্যে প্রার্থনা করেছি।’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের ৪৯তম বার্ষিকীতে জাতি যখন সেই স্মৃতি রোমন্থন করে তখন পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর সাবেক সিনিয়র কর্মকর্তার সাক্ষ্য থেকে বিশদভাবে জানা যায়, নয় মাসের বন্দী দশা শেষে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা কিভাবে ওই দেশ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন।
পাকিস্তানের সাবেক বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল জাফর এ চৌধুরী ওই সময়ে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স (পিআইএ)’র চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি তার স্মৃতিকথায় লেখেন, রাওয়ালপিন্ডির শাকলালা বিমানবন্দর থেকে লন্ডন পর্যন্ত তিনি বঙ্গবন্ধুকে এসকর্ট করে নিয়ে যান।
তিনি স্মরণ করেন, সদ্য ক্ষমতা পাওয়া জুলফিকার আলী ভুট্টো বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে বিদায় জানাতে এসেছিলেন। চৌধুরী বলেন, দূর থেকে তিনি পাকিস্তানী নেতার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতার শেষ কথাবার্তা প্রত্যক্ষ করছিলেন। তখনও তাকে তীব্র উত্তেজনা ঘিরে রেখেছিল।
তার মতে, এ উত্তেজনা আরো কয়েকঘন্টা এমনকি পিআইএ ফ্লাইট যাত্রা শুরু করার পরেও ছিল, যতক্ষণ না পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের কমান্ডের আওতায় বিমানটি ছিল ততক্ষণই এক ধরণের উদ্বেগ বঙ্গবন্ধুকে গ্রাস করে ছিল।
চৌধুরী স্মরণ করে বলেন, কয়েক ঘন্টা শেষে রাতের খাবার পরিবেশনের পর পরিস্থিতি স্বস্তিদায়ক হয়ে ওঠে। বিমান তখন লন্ডনের পথে। আমি তখন বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে বসলাম। নিজের পরিচয় দিলাম। এরপর বঙ্গবন্ধু কথা বলতে শুরু করলেন। আবেগঘন ভাবে তিনি বর্ণনা করলেন বাঙালিরা তাকে কতটা ভালোবাসে।
এরপর পিআইএ প্রধান আরো বললেন, খুব সকালে নাশতা দেয়া হলো। এরপর পরই একজন স্টুয়ার্ড সম্মানিত অতিথির জন্যে উপহার নিয়ে এল। পিআইএ’র পক্ষ থেকে শেখ মুজিবর রহমানের জন্যে দুটি পাইপ ও একটি জায়নামাজ উপহার হিসেবে ছিল। বঙ্গবন্ধু উঠে দাঁড়ালেন এবং উপহার গ্রহণের সময়ে তার সাথে হাত মেলালেন।
চৌধুরী স্মরণ করেন, এরপর বঙ্গবন্ধু লন্ডন বিমানবন্দরে তাকে রিসিভ করতে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিনিধির উপস্থিতির জন্যে অনুরোধ জানাতে আমাকে বললেন।
এয়ার মার্শাল বঙ্গবন্ধুর অনুরোধের প্রেক্ষিতে হিথরো বিমান বন্দর কর্তৃপক্ষকে একটি বার্তা পাঠান।
তিনি তার স্মৃতিকথায় আরো লেখেন, সকাল ছয়টা নাগাদ আমরা লন্ডনে অবতরণ করি। মূল টার্মিনাল থেকে বিমানটিকে কিছুটা দূরে রাখা হয়। কিছু কর্মকর্তা বিমানে প্রবেশ করে।
এয়ার মার্শাল জাফর এ চৌধুরী ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
চৌধুরী বলেন, আমি তাকে বললাম এরা ভিআইপি’র প্রটোকল কর্মকর্তা। তারা আপনাকে এসকর্ট করে ভিআইপি লাউঞ্জে নিয়ে যাবে। সেখানে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে।
তিনি আরো জানান, ভিআইপি লাউঞ্জের দিকে যাওয়ার সময়ে বঙ্গবন্ধু তাকে আরেকটি অনুরোধ করে লন্ডনে তার কিছু বন্ধুকে ফোন দেয়ার কথা বলেন।
চৌধুরী বলেন, অধিকাংশই ছিল বাঙালি রেস্টুরেন্টের মালিক। এতো সকালে সকল রেস্টুরেন্টই বন্ধ ছিল। তাই কেউ ফোন ধরছিল না। তবে, তিনি স্মরণ করেন, অবশেষে বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক বন্ধু মাহমুদ হারুন ফোন ধরেন। এ সময়ে বঙ্গবন্ধু নীরবে একটু সরে গিয়ে কথা বলেন, যেন আমি তাদের কথোপকথন শুনতে না পাই।
চৌধুরী বলেন, এরপর শেখ মুজিব আমাকে বললেন, আমার জন্যে যা করলেন তার জন্যে অনেক ধন্যবাদ এয়ার মার্শাল। আমি এখন আমার লোকদের সাথে দেখা করব যারা বাংলাদেশ মিশন থেকে এসেছে, যেহেতু আমি তাদের নেতা।
কামাল হোসেন বলেন, ব্রিটেনে পাকিস্তানের তৎকালীন হাইকমিশনার নাসিম আহমেদ ভিআইপি লাউঞ্জে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বললেন, তাকে স্বাগত জানাতেই তিনি সেখানে উপস্থিত রয়েছেন।
নাসিম বললেন, স্যার, আপনাকে স্বাগত জানাতে আমি এখানে এসেছি। আমাকে বলেন আমি আপনার জন্যে কি করতে পারি।
উত্তরে বঙ্গবন্ধু বললেন, আপনি আমার জন্যে অনেক করেছেন। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
কামাল হোসেন পরে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রীসভার আইন মন্ত্রী ও পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রী হয়েছিলেন। তিনি জানান, হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছানোর কয়েক মিনিটের মধ্যে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের সিনিয়র প্রতিনিধি স্যার ইয়ান সুথারল্যান্ড ঘটনাস্থলে আসেন এবং বঙ্গবন্ধুকে ব্রিটিশ সরকারের উষ্ণ অর্ভ্যত্থনার বিষয়টি অবহিত করেন।
তিনি জানান, ব্রিটিশ সরকার বঙ্গবন্ধুর জন্যে ক্ল্যারিজ’স হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করেছে। সাধরণত বিদেশী রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা এ হোটেলে অবস্থান করেন।
বঙ্গবন্ধু তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, তুলনামূলক আরো কম খরচের হোটেলের ব্যবস্থা করা যায় কিনা যেন স্বল্প সময়ের অবস্থানকালে ব্রিটেনে বসবাসরত সাধারণ বাঙালিরা তার সাথে সাক্ষাত করতে পারেন।
কামাল হোসেন সেই প্রতিনিধির বক্তব্য তুলে ধরে বলেন, স্যার, এই একটি কাজের ব্যবস্থা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, হেড অব সেস্টস সিকিউরিটি কেবলমাত্র ক্ল্যারিজ’স হোটেলে সরবরাহ করা হয়। কিন্তু যে কেউ আপনার সাথে দেখা করতে চাইলে সে যেন পারে তা আমরা দেখবো। এখানে বিষয়টি নিরাপত্তার।
বাংলাদেশের বিজয়ের কয়েক সপ্তাহ পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে অর্ভ্যত্থনা জানাতে তৎকালীন ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আবেগ আপ্লুত লাখো মানুষের ঢল নামে।
বিশ্ব সংবাদ মাধ্যম বিষয়টিকে পৃথিবীর ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ পর্ব হিসেবে বিবেচনা করে।
তেজগাঁও বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমান অবতরনের প্রেক্ষাপটে তৎকালীন এনবিসি টেলিভিশনের ভাষ্যকার বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের গল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বের সমাপ্তি ঘটেছে আজ’।
রিপোর্টে বঙ্গবন্ধুকে ‘বাংলাদেশের জর্জ ওয়াশিংটন’ হিসেবে উল্লেখ করা হয় এবং তার অর্ভ্যত্থনাকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে আবেগঘন ও মর্মস্পর্শী অধ্যায়’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়।
একইসঙ্গে আমেরিকান নেভাল টাস্কফোর্সের উদ্ধৃতি প্রকাশ করে বলা হয়, ‘বঙ্গবন্ধুর ঢাকায় ফেরা যেন বঙ্গোপসাগর থেকে তার উত্থান।’ যদিও এর আগে তারা পাকিস্তানী জান্তার সমর্থক ছিল।
ওই দিন অপর প্রভাবশালী চ্যানেল এবিসি টিভি’র খবরে বলা হয়, অবতরণের আগে চক্কর দিতে থাকা বিমান থেকে বঙ্গবন্ধুর দেখার সুযোগ হয়েছিল আনুমানিক ১০ লাখ লোক তার জন্যে অপেক্ষা করে আছে।
নিউজউইকের ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি সংখ্যায় বলা হয়, মধ্যরাতে কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট মুজিবকে এসকর্ট করে রাওয়ালপিন্ডি বিমানবন্দরে নিয়ে যান এবং ভাড়া করা একটি বিমানে তুলে দেন।
নিউজউইকের ওই আর্টিকেলে আরো বলা হয়, মুজিবকে বহনকারী বিমান লন্ডনের হিথরো বিমান বন্দরে পৌঁছায় এবং আগের বসন্তে পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান তাকে জেলে পোরার পর ৫১ বছর বয়সী বাঙালি নেতাকে বিশ্ব এই প্রথম দেখতে পায়।
ওই আর্টিকেলের শিরোনাম করা হয়, ‘স্বাধীন দেশে মুজিবের যাত্রা’।
খবর বাসস

SUMMARY

2868-2.jpg