অজয় দাশগুপ্ত
তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মুসলিম লীগকে জমিদার-নবাব-খান বাহাদুরদের কব্জা মুক্ত করে জনগণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার জন্য সচেষ্ট থাকেন। তিনি ছাত্র সংগঠন ও আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ পুনর্গঠন করেন। একইসঙ্গে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে শুরু করেছেন। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ভাষা আন্দোলনের পুরোভাগে থাকেন তিনি। সাম্প্রদায়িক সম্পীতির জন্য কাজ করেন। হিন্দুরা যাতে দেশত্যাগ না করে, সে জন্য অনুরোধ করেন। সাহস দেন। একইসঙ্গে তাকে আমরা দেখি কৃষকের পাশে। তিনি বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করার দাবি তোলেন।
তাঁর আন্দোলন কৌশলও ভিন্ন। কেবল বিবৃতিদান ও ঘরে বসে আলোচনায় তাঁর বিশ্বাস নেই। তিনি জেলা-মহকুমায় ঘুরে ঘুরে সংগঠন গড়ে তোলেন। জনসভায় ভাষণ দেন। প্রকৃত অর্থেই ছুটে বেড়ান গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, এক শহর থেকে আরেক শহরে।
তিনি কৃষকের পাশে কীভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, সেটা লিখে গেছেন অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে। পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও আমরা পাই এর বিশদ বিবরণ। ফরিদপুর, ঢাকা, কুমিল্লা প্রভৃতি জেলার ধান কৃষক-দিনমজুররা ধান কাটার জন্য খুলনা, বরিশাল, সিলেট প্রভৃতি জেলায় যেতেন। তারা ধান কাটা-মাড়াইয়ের জন্য ধানের অংশ পেতেন এবং সেটা নৌকায় নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় ফিরতেন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, এদের বলা হত দাওয়াল। কিন্তু পাকিস্তান হওয়ার পর মুসলিম লীগ সরকার দাওয়ালদের ধানের নৌকা আটকাতে শুরু করল। বলা হতো, ধান জমা না দিলে নৌকা ও ধান বাজেয়াপ্ত করা হবে। বিভিন্ন স্থানে কৃষকদের কাছ থেকে পাকা রসিদ ছাড়াই ধান জমা হচ্ছিল। কিন্তু নিজ এলাকায় ফিরে তার বিনিময়ে কৃষকরা ধান পাচ্ছিল না। এভাবে দাওয়ালরা সর্বস্বান্ত হয়ে গেল। [পৃষ্ঠা ১০৩-১০৪]
১৯৪৯ সালের ২৯ জানুয়ারি খুলনার এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৮ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে খুলনা মিউনিসিপ্যাল পার্কে ঢাকা, ফরিদপুর ও কুমিল্লার প্রায় ৩৫০ জন কৃষকের সমাবেশে যোগ দেন। তিনি তাদের নিয়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বাঙলোয় যান এবং ধানকাটার মজুরি বাবদ পাওয়া ধান নিয়ে নিজ নিজ বাড়িতে যাওয়ার পারমিট দাবি করেন। [গোয়েন্দা প্রতিবেদন, প্রথম খণ্ড পৃষ্ঠা ৮৯]
পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মহম্মদ আলী জিন্নাহ-এর মৃত্যুর পর খাজা নাজিমুদ্দীন গভর্নর জেনারেল পদে আসীন হন। তিনি গোপালগঞ্জ সফরে যাবেন। সে সময়ে গোপালগঞ্জসহ আশপাশের এলাকায় দাওয়ালদের আন্দোলন চলছিল। ‘জিন্নাহ ফান্ডে’ অর্থ আদায়ের জন্য জোরজুলুমের অভিযোগও পাওয়া যেতে থাকে। এ দুটি ইস্যুতে আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং তার সামনের সারিতে রয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান। প্রশাসন ও মহকুমা মুসলিম লীগ নেতাদের অনেকে ধারণা করলেন, যেহেতু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির অনুসারী এবং খাজা নাজিমউদ্দীনের বিরোধী, এ কারণে তিনি গভর্নর জেনারেলের সফরের সময় বিক্ষোভ দেখাবেন। কিন্তু তিনি বিচক্ষণতার পরিচয় দিলেন। সকলকে অনুরোধ করলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধানকে স্বাগত জানাতে। একইসঙ্গে তিনি খাজা নাজিমুদ্দীনের কাছে এলাকার সমস্যা তুলে ধরতে ভুললেন না- গোপালগঞ্জ শহরে কলেজ চাই। দাওয়ালদের সমস্যার সমাধান চাই।
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে জেল থেকে মুক্তির কিছুদিন পর তিনি আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। মে মাসে পশ্চিম পাকিস্তান সফর করেন। প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মহান একুশে ফেব্রুয়ারির অবিস্মরণীয় আন্দোলন এবং তার প্রেক্ষাপট তুলে ধরা। তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা, বন্দিমুক্তি ও পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন দাবি করেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক সমাবেশ ও সংবাদ সম্মেলনেও তোলেন এ সব দাবি। কৃষকদের কথাও তিনি ভোলেন নাই। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রকাশিত গোয়েন্দা রিপোর্টের দ্বিতীয় খণ্ডে দেখি (৩০ মে, ১৯৫২) তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন পূর্ব পাকিস্তানের লবণ চাষীদের দুর্দশার শেষ নেই। পাকিস্তানের বৈদেশিক বাণিজ্যের ৭৫ পার্সেন্ট পাট খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এই পাট রফতানি থেকে ইস্পাহানী ও মুসলিম লীগের অন্য ব্যবসায়ীরা বিপুল লাভ করছে। কিন্তু পাটচাষীরা নিদারুণ কষ্টে আছে। তারা ন্যায্য মূল্য পায় না। অন্যদিকে, ব্যবসায়ীদের লোভ সীমাহীন। তারা চড়া চাম চাওয়ায় অনেক দেশ পাটের বিকল্প ভাবতে শুরু করেছে। [পৃষ্ঠা ২২০]
তিনি তামাক ও পানচাষীদের সমস্যাও তুলে ধরেন।
বঙ্গবন্ধু দলের মূল দায়িত্ব আসার পর ব্যাপকভাবে জেলা ও মহকুমা সফর করেন। অনেক সময় এক একটি অঞ্চল ধরে তিনি সফরে বের হতেন। ১৯৫২ সালের ১৫ আগস্ট থেকে একটানা কয়েকদিন সফর করেন রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী ও পাবনা। মহকুমা শহরেও যান এ সময়ে। এই সফরের আগে তিনি ৯ আগস্ট বিভিন্ন জেলা নেতাদের চিঠি দেন। তিনি লিখেছিলেন রাজনৈতিক ও সমাজকর্মীর পাশাপাশি সভাগুলোতে অবশ্যই পাটচাষীদের প্রতিনিধি হাজির করাতে যত্নবান হবেন।
১৭ আগস্ট দিনাজপুরে তিনি বলেন, পাট রফতানির জন্য ব্যবসায়ীরা প্রতি মণের দাম হাকছে ১১৭ টাকা। ফলে অনেক দেশে তুলা ও অন্যান্য দ্রব্যের ব্যবহার বাড়ছে। পাটের বাজার আমরা হারাচ্ছি। এই অপরিণামদর্শী পদক্ষেপের কারণে বাজারে এখন পাটের মণ ৬ টাকায় নেমে এসেছে।আরও অনেক সমাবেশের মতো দিনাজপুরেও পাট জাতীয়করণের দাবি জানানো হয়।
১৮ আগস্ট বগুড়ার সমাবেশে তিনি প্রতি মণ পাটের জন্য ৪০ টাকা ধার্য করার দাবি করেন।
১৭ নভেম্বর চট্টগ্রামের কুমিরায় অনুষ্ঠিত জনসভায় সরকারের পাটনীতির সমালোচনা করেন। চট্টগ্রাম থেকে তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দিসহ যান সিলেট। সেখানে কোর্ট প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বঙ্গবন্ধু ভূমির উচ্চ সিলিং করে উদ্বৃত্ত জমি কৃষকদের মধ্যে বণ্টনের দাবি করেন। পরে যান বরিশাল। সেখানে বলেন, কৃষক সমাজ তথা পূর্ব বাংলাকে অর্থনৈতিক ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষ করার জন্য অবিলম্বে পাট জাতীয়করণ করতে হবে এবং দালালদের মারফত না কিনে সরকারি কর্মচারীদের দ্বারা সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে পাট কিনতে হবে। [গোয়েন্দা প্রতিবেদন, দ্বিতীয় খণ্ড পৃষ্ঠা ৪৫৩]
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক ২১ দফার প্রথম দফা ছিল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা। ২ থেকে ৮ নম্বর দাবি ছিল কৃষি সম্পর্কিত। কৃষি প্রধান পূর্ব পকিস্তানে এটাই স্বাভাবিক ছিল। বঙ্গবন্ধু পরবর্তী সময়ে ২১ দফা বস্তবায়নের ওপর বার বার জোর দিয়েছেন। ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রীসভার সদস্য হলে তার হাতে অনেকগুলো দফতর সামলানোর ভার পড়ে। এর মধ্যে ছিল কৃষি শিল্প উন্নয়ন ও পল্লী উন্নয়ন পরিকল্পনা। কৃষি নিয়ে যে সব দাবি সামনে এনেছেন, তা বাস্তবায়নের সুযোগ আসে হাতে এবং তিনি বিপুল উৎসাহে অর্পিত দায়িত্ব পালনে যত্নবান হন।
১৯৫৬ সালের ১৮ আগস্ট আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী টাঙ্গাইলের কাগমারীতে পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন। সম্মেলনে তিনি সাত দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করেন। কৃষকদের বড় ধরনের এই সমাবেশে সভাপতিত্ব করার বিরল সম্মান দেওয়া হয়েছিল প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানকে। তিনি বিনা খেসারতে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ এবং সার্টিফিকেট প্রথা ও খাজনার সুদ বন্ধ করার দাবি জানান।
তিনি শ্রমিক আন্দোলনেও সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হয়। নির্বাচনের পরপরই (১১ এপ্রিল) বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তান প্রেস শ্রমিক ইউনিয়নের সম্মেলন সভাপতিত্ব করেন। পহেলা মে তিনি ভাষণ দেন নারায়ণগঞ্জের শ্রমিক সমাবেশে। শ্রমিকদের মুক্তির জন্য তিনি ও তাঁর দল কাজ করছে- এ বিষয়টির ওপর তিনি জোর দেন। ১৯৫২ সালে চীন সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণে সে দেশের কমিউনিস্ট সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা বলেন।
ষাটের দশকে তিনি আওয়ামী লীগের শ্রমিক শাখা গড়ে তোলায় নজর দেন। এর আগে মূলত বামপন্থীরাই শ্রমিক সংগঠনে নেতৃত্ব দিতেন। অর্থনৈতিক দাবির পাশাপাশি পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন আদায় ও শোসণ-বঞ্চনার দাবি তিনি তুলে ধরেন এবং তাতে বিপুল সাড়া মেলে। ১৯৬৬ ও ১৯৬৯ সালের আন্দোলনে শ্রমিকদের বিপুল অংশগ্রহণ ছিল এরই প্রত্যক্ষ ফল।
বঙ্গবন্ধু কৈশোর থেকেই আন্দোলন করেছেন। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি, তিনি দাবি আদায়ে সময়োপযোগী কৌশল গ্রহণ করতে পেরেছেন। কখনও একগুয়ে বা হঠকারী অবস্থান গ্রহণ করেননি।
লেখক : ১৯৭৫ সালের ৭ জুন বঙ্গবন্ধু গঠিত জাতীয় ছাত্রলীগ কেন্দ্রয়ি কমিটির সদস্য, সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা।