যুদ্ধ শেষ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরেছেন। নিজ মাটিতে পা দিয়ে যেমন আবেগে আপ্লুত, তেমনি শঙ্কিত ও চিন্তিত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্বাসন নিয়ে। বীরযোদ্ধা, আবালবৃদ্ধবনিতাসহ আপামর জনসাধারণ মুক্তির আনন্দে বিভোর। এদিকে সুযোগসন্ধানীরা উঠেপড়ে লেগেছে আখের গোছাতে।
শিগগিরই আনন্দের ঘোর কাটবে, ক্ষুধা এসে হানা দেবে দুয়ারে। সময় নষ্ট করা যাবে না। চিন্তিত বঙ্গবন্ধু। একের পর এক পরিকল্পনার ছক কেটে যেতে লাগলেন। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে শুরু করলেন। মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে বসলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা আর দেশ পুনর্বাসনে ১৯৭৩ সালেই তৈরি করলেন প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। এর মূল অঙ্গীকার বিধ্বস্ত অবকাঠামো পুননির্মাণ, ভগ্নশিল্প পুনঃপ্রতিষ্ঠা, শিক্ষাব্যবস্থা, প্রশাসন পুনর্বিন্যাস, রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা, সর্বোপরি কৃষির উন্নয়ন।
কেন কৃষির কথা ভাবলেন বঙ্গবন্ধু
মনস্তাত্ত্বিক দিক বিবেচনায় এনে বঙ্গবন্ধু ভাবলেন, এ দেশের জলবায়ু ও মাটি কৃষির মাটি। বাংলার সবচেয়ে বড় সম্পদ কৃষি। কৃষি বাংলার প্রাণ, বাঙালির মুখের হাসি। বাঙালি মনোজগতের দার্শনিক বঙ্গবন্ধু। তিনি জানেন, কৃষি মিশে আছে বাঙালির রক্তে। দেশের ৮৫ শতাংশ লোক কৃষির ওপর নির্ভশীল। তাই উন্নয়নের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হবে কৃষি। দৃশ্যমান বাস্তবতা বিবেচনায় এনে ভাবলেন, মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম খাদ্য। বিশে^র বহু দেশে খাদ্য উৎপাদনের উপযোগী জলবায়ু ও মাটি নেই। খাদ্যের জন্য তাদের নির্ভর করতে হয় বহির্বিশে^র ওপর। যদি বিশ্বে খাদ্যমন্দা দেখা দেয়, তা হলে অনুন্নত দেশগুলোকে তীব্র খাদ্য সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। আমাদের মাটি কৃষির মাটি। এ দেশের মাটিতে সোনা ফলে। এ জন্য যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্বাসনে প্রথম যে বিষয়টি সামনে আসে, তা হলো খাদ্য নিশ্চয়তা। তাই কৃষিকে বাঁচাতে হবে, কৃষককে বাঁচাতে হবে।
বঙ্গবন্ধু কী পদক্ষেপ নিলেন
কৃষি উন্নয়নের কথা ভেবে তিনি যে যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন, সংক্ষেপে সেগুলো ছিল নিম্নরূপ-
ক. জাতীয় উন্নয়নে কৃষিকে অগ্রাধিকার দিয়ে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন : বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান ভিত্তিই হলো কৃষি। এ কারণে ১৯৭৩ সালে প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে বলা হলো, ‘খাদ্যশস্য উৎপাদনে আত্মনির্ভরতা অর্জন, কৃর্ষিক্ষেত্রে কর্মের সুযোগ সম্প্রসারণ এবং শহরমুখী শ্রমিকস্রােত ঠেকানোর উদ্দেশ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ও কারিগরিভিত্তিক কৃষিভিত্তি গড়ে তোলা। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সামাজিক ন্যায়বিচার ও দারিদ্র্য বিমোচনের তাগিদে কৃষি উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রধিকার দেওয়া হলো। স্বল্পমেয়াদে উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ, উন্নত বীজ, সেচ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ সরবরাহ করে এবং কৃষিঋণ মওকুফ, সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার ও খাসজমি বিতরণ করে কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা এবং উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের চেষ্টা করা হলো। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ভূমিসংস্কার ও গ্রামে সমবায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কৃষক-জনতার স্বার্থে গ্রাম-সমবায়ও বিশেষভাবে স্থান পেয়েছিল। এ পরিকল্পনায় সব বিষয়টিকে প্রধানত দুটি অংশে বিভক্ত করা হয়েছিল। এর প্রথম অংশে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে পরিকল্পনা কাঠামো এবং দ্বিতীয় অংশে খাতওয়ারি কর্মসূচি। খাতওয়ারি কর্মসূচির শুরুতেই ছিল কৃষি।
খ. কৃষি পুনর্বাসন ও কৃষককে সুযোগ-সুবিধা প্রদান : ‘কৃষক বাঁচাও দেশ বাঁচাও’ স্লোগানে সবুজ বিপ্লবের ডাক। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মাফ। পরিবারপ্রতি জমির মালিকানা ৩৭৫ বিঘা থেকে কমিয়ে সর্বোচ্চ সীমা ১০০ বিঘা নির্ধারণ। পাকিস্তান শাসনামলে মামলাকৃত ১০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা থেকে কৃষকদের মুক্তি প্রদান ও সুদসহ ঋণ মওকুফ। জমির পূর্ববর্তী সব ভূমি কর মওকুফ। দরিদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের রেশন প্রদানের ব্যবস্থা। উপকূলীয় অঞ্চলে বাঁধ নির্মাণ করে প্রায় ১৮ লাখ একর কৃষিজমি রক্ষা। উচ্চফলনশীল ধান, পাট ও গম বীজ কৃষকদের মধ্যে বিতরণ। স্বাধীনতার পর স্বল্পসময়ের মধ্যে ২২ লাখ কৃষি পরিবারকে পুনর্বাসন। হ্রাসকৃত মূল্যে লো লিফট পাম্প, গভীর নলকূপ ও শ্যালো টিউবওয়েল বিতরণ। নদী কিংবা সাগরে জেগে ওঠা চর জমির মালিকানা রাষ্ট্রের হাতে নিয়ে দরিদ্রতর কৃষকদের মধ্যে বণ্টনব্যবস্থার বিধান। অল্পদামে কিংবা বিনামূল্যে সার, কীটনাশক, বীজ ও কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণ। ভূমিহীনদের মধ্যে খাসজমি বিতরণ। কৃষকদের মধ্যে ষাঁড়, গরু বিতরণ ও কৃষিঋণ প্রদান। সহজ শর্তে ঋণপ্রাপ্তির লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা। কৃষকের কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য ধান, পাট, তামাক, ইক্ষুসহ গুরুত্বপূর্ণ ফসলের ন্যূনতম বিক্রিমূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া। কৃষি উৎপাদন সহযোগী সামগ্রী স্বল্প ও বিনামূল্যে প্রদান করে কৃষিকাজে উৎসাহ ও কৃষকের উৎপাদন ব্যয় কমানো। কৃষিজ পণ্যের ক্ষুদে বিক্রেতাদের শুল্ক থেকে অব্যাহতি প্রদান। কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের জন্য সব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে নির্দেশনা প্রদান। সরকারিভাবে খাদ্য মজুদের জন্য ১৯৭২ সালেই ১০০টি খাদ্য গোডাউন নির্মাণ।
গ. কৃষিভিত্তিক ও কৃষিসহযোগী শিল্প : কৃষি খামার, মৎস্য এবং অন্যান্য কৃষিভিত্তিক ক্ষুদ্রশিল্প প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ প্রদান ও সহজ শর্তে ঋণপ্রাপ্তির ব্যবস্থা। স্থানীয়ভাবে কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরির ক্ষুদ্রশিল্পকে উৎসাহ ও প্রণোদনা প্রদান।
ঘ. কৃষি সমবায় : সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের অধীন বিদ্যমান সমবায় সমিতির পাশাপাশি দ্বিস্তরের সমবায় পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য দেশের প্রথম মাইক্রোক্রেডিট কর্মসূচি প্রণয়ন।
ঙ. সবুজ বিপ্লব : ‘কৃষি বাঁচলে দেশ বাঁচবে’ স্লোগান সামনে রেখে ‘সবুজ বিপ্লব’-এর ডাক। কৃষকদের বিদ্যমান সুবিধা বৃদ্ধি করে নানা সুযোগ প্রদান করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করতে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ছিল এর মূল লক্ষ্য।
চ. কৃষিবিদদের মর্যাদা বৃদ্ধি : অধিকতর মেধাবী শিক্ষার্থীদের কৃষি শিক্ষায় আকৃষ্ট করার জন্য ১৯৭৩ সালে কৃষিবিদদের চাকরি ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণির মর্যাদা প্রদান।
ছ. কৃষি শিক্ষা ও কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন : কৃষি গবেষণা ছাড়া কৃষির উন্নতি সম্ভব নয়- এ কথা উপলদ্ধি করে ১৯৭৩ সালে কৃষি গবেষণা সমন্বয়ের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা। ১৯৭৩ সালে ১০ নম্বর অ্যাক্টের মাধ্যমে নতুন নামে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট পুনর্গঠন করা। ঢাকার আণবিক গবেষণাকেন্দ্রে কৃষি পারমাণবিক গবেষণা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার এগ্রিকালচার প্রতিষ্ঠার নির্দেশ। জুট এগ্রিকালচার রিসার্চ ল্যাবরেটরিকে বাংলাদেশ জুট রিসার্চ ইনস্টিটিউট নামে পুনর্গঠন। সোনালি আঁশের সম্ভবনার দ্বার উন্মুক্ত করতে পাট মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা। তুলার চাষ সম্প্রসারণ করার জন্য তুলা উন্নয়ন বোর্ড গঠন। হর্টিকালচার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড, সিড সার্টিফিকেশন এজেন্সি ও রাবার উন্নয়ন কার্যক্রম পুনর্গঠন। ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট, মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন প্রতিষ্ঠা। কৃষি সেচব্যবস্থার উন্নয়ন, বীজ উৎপাদন, বীজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে বিএডিসিকে পুনর্গঠন ও এর বীজকেন্দ্র সারাদেশে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ।
বঙ্গবন্ধুর পদক্ষেপের সুদূর প্রভাব
শত বিপত্তির মধ্যেও কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে পুরো পৃথিবীতে বাংলাদেশ এখন একটি রোল মডেল হিসেবে পরিচিত। দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবে স্বাধীনতা অর্জন সময়ের তুলনায় মানুষ বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে বাংলাদেশ এখন খাদ্য রফতানি করছে। শিল্পায়ন, বিশ^ব্যাপী বাণিজ্যের প্রসার, সেবাধর্মী কর্মকা-ের বাজার ও শ্রমবাজার বৃদ্ধিসহ নানাবিধ কারণে কৃষি থেকে বিপুল মানবসম্পদের নিয়ত অভিবাসন সত্ত্বেও দেশের জিডিপিতে রয়েছে কৃষির উল্লেখযোগ্য অবদান (বর্তমানে তা মোট জিডিপির প্রায় ১৪ শতাংশ)। এগ্রো ইন্ডাস্ট্রি, পরিকল্পিত ও বাণিজ্যিক কৃষি উৎপাদনে বৃদ্ধি পেয়েছে বেসরকারি বিনিয়োগ এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। তা দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বেকারত্ব দূরীকরণে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এতে বৃদ্ধি পেয়েছে কৃষকের মর্যাদা। এসবই সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী কৃষি ভাবনা ও উপযুক্ত পদক্ষেপের কারণে। তাই স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘বঙ্গবন্ধু’ নামের পাশে খুবই যৌক্তিকভাবে সংযোজিত হয় আরেকটি নাম, আরেকটি বিশেষণ, আরেকটি শ্রদ্ধার্ঘ্য ‘কৃষিবন্ধু মুজিব’।
আবুবকর সিদ্দিক : মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব), গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রলালয়