“ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ” ছিল গণতন্ত্রের পরিপন্থী

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার পর ২৬ সেপ্টেম্বর শুক্রবার রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন। ‘দ্য বাংলাদেশ গেজেট, পাবলিশড বাই অথরিটি’ অধ্যাদেশটিতে রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করেন। খন্দকার মোশতাক মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বাধীনতা-পরবর্তী পানিসম্পদ ও বিদ্যুৎমন্ত্রী ছিলেন। বাকশালের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিরও সদস্য ছিলেন তিনি।

এই অধ্যাদেশটি দু’ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থী যা কিছু ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিমকোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।

১৫ আগস্টের ঘটনা, বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা, সেনাবাহিনীর মধ্যে উস্কানি দেওয়া ইত্যাদি বিষয়ে কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের নিকট কোনো কারণেই প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। খন্দকার মোশতাক উপ-রাষ্ট্রপতি বা স্পিকার ছিলেন না। সেহেতু রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার দায়িত্ব গ্রহণ এবং খুনিদের বাঁচানোর জন্য অধ্যাদেশ জারি ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি। একজন অবৈধ রাষ্ট্রপতির জারিকৃত অধ্যাদেশ অবৈধ হবে। অধ্যাদেশ জারির ৩০ দিনের মধ্যে সংসদে পেশ না হলে তা শাসনতন্ত্র অনুযায়ী বাতিল হয়ে যায়।


 
প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে বলতে হয়, ১৮৬৫ সালের ১৪ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন, ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধী, ১৯৮৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, রাজিব গান্ধী, রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সফল নায়ক ভ ই লেনিন, পাকিস্তান পিপলস্ পার্টির প্রধান বেনজির ভুট্টো, ২০১০ সালের ১০ অক্টোবর শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট বন্দর নায়েককে গুলিতে হত্যার পর সেসব দেশে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বিচারের পথ রুদ্ধ করা হয়নি।

১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল দ্বিতীয় জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটিকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত করে বৈধতা দেওয়া হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শাহ আজিজুর রহমান পঞ্চম সংশোধনী সংক্রান্ত বিলটি পেশ করেন। পাক বাহিনীর সহযোগি ৩৬ জন দালালের মধ্যে কাউন্সিল মুসলিম লীগের শাহ আজিজুর রহমান অন্যতম। দালাল আইন অনুযায়ী তার নাগরিকত্ব বাতিল হয় (সিরাজ উদ্দীন আহমদ রচিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান)। সংসদে পেশকৃত সংক্ষিপ্ত এ বিলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক আইন, বিধি-বিধান জারি করা হয়েছে তা বৈধ বলে উল্লেখ আছে। বিলটি সংসদে পেশ করায় আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা আসাদুজ্জামান, কর্নেল (অব.) শওকত আলী, সালাউদ্দিন ইউসুফ, মিজানুর রহমান চৌধুরী, মহিউদ্দিন আহমেদ, সুধাংশু শেখর হালদার, রাশেদ মোশাররফ, জাতীয় লীগের আতাউর রহমান খান, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের রাশেদ খান মেনন, সংবাদ সম্পাদক আহমদুল কবীর (স্বতন্ত্র) বিরোধিতা করেন। এ বিলের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সরব ছিলেন জাসদের যুগ্ম সম্পাদক, সংসদ সদস্য শাজাহান সিরাজ (আনু মাহমুদ রচিত বঙ্গবন্ধু হত্যার রায় জাতির কলঙ্ক মোচন)। তবে বিলটি পাস হওয়ার আগেই বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যরা ওয়াক আউট করেন। তাদের সেদিনের জোরালো বক্তব্য ছিল গণতন্ত্রবিরোধী ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ আদালতের অধিকার খর্ব করেছে। রাষ্ট্রের চার মূলনীতির মধ্যে অন্যতম গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে। ন্যায়বিচার পাওয়ার পথকে রুদ্ধ করেছে। বিচার প্রার্থীকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের দর্শনে বিশ্বাসী না হলেও আইনের ছাত্র হিসেবে আমাকে বলতে হয়, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি শুধু সংবিধান লঙ্ঘন করেনি, তা একই সঙ্গে সার্বজনীন মানবাধিকার সনদও লঙ্ঘন করেছে। ছয় দফা আন্দোলনের প্রণেতা, স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যার বিচার চাওয়ার অধিকার সেদিন জাতির ছিল।

১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে সংসদে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ উত্থাপন করা হয়। ’৯৬ সালের ১২ নভেম্বর আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু দি ইনডেমনিটি রিপিল অ্যাক্ট-৯৬ নামে বিল সংসদে উত্থাপন করেন। ওইদিনই মানবতাবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল হয়। রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ দি ইনডেমনিটি (রিপিল) বিলে সম্মতি দেন। এ অধ্যাদেশ বাতিলের সঙ্গে সঙ্গে ১৫ আগস্টের বিচারের দ্বার উন্মুক্ত হয়।

SUMMARY

2848-2.jpg