উজ্জ্বল আলোর মাঝে রয়েছেন কেউ, চারদিক থেকে অনেক মানুষ দেখছে তাকে। তাদের কারও কারও হাতে ম্যাগনিফাইং গ্লাস। সামান্য ভুল করলেই রে রে করে উঠতে এক পায়ে খাড়া একদল। ভুল না করলেও বিপদ হতে পারে। মতলববাজরা আছে। ছিদ্রান্বেষীরা আছে। এ অবস্থায় স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা কীভাবে সম্ভব?
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা ও পুত্র শেখ কামাল ছাত্রলীগের নিষ্ঠাবান কর্মী ছিলেন। মিছিল-সমাবেশে অগ্রণী ছিলেন। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে লাঠি-গুলি-টিয়ারগ্যাসের মুখোমুখি হয়েছেন বার বার। কিন্তু ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রিয় নেতৃত্বে তাদের কাউকেই দেখা যায়নি। নেতৃত্ব গুণ তাদের ছিল, এ নিয়ে সন্দেহ নেই। শেখ কামাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থাতেই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ছিলেন সক্রিয়। আবাহনী ক্রীড়াচক্রের মতো বড় প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ছিলেন। বাংলাদেশে আধুনিক ফুটবল তাঁর হাত ধরেই চালু হয়। আর নেতৃত্ব গুণে শেখ হাসিনা কতটা অনন্য, সেটা বাংলাদেশ জানে। বিশ্ব জানে। তাদের অনুজ শেখ জামালও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সব সময় চেয়েছেন তাদের সন্তানরা যেন স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠে। রাষ্ট্র বা প্রশাসন থেকে কোনো ধরনের আনুকূল্য তাদের দেওয়া হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বরং তারা স্বাভাবিক যা পাওনা, তা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আবাহনী ক্লাবের ফুটবল দলের একবার বিদেশ সফরের সময় সামান্য কিছু বিদেশি মুদ্রার আবেদন স্বাভাবিকভাবে নিষ্পত্তি হতে পারত। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এ আবেদনের কথা জানতে পেরে মুহূর্ত চিন্তা না করে তা নাকচ করে দিয়েছিলেন।
জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের উত্তরাধিকার বহন করছেন। পুত্র-কন্যার মেধা-প্রতিভার স্বাভাবিক বিকাশ ঘটতে দিয়েছেন। অযথা আনুকূল্য প্রদর্শন করেননি। নিজেদের যোগ্যতাতেই তারা আজ খ্যাতিমান এবং আমাদের জন্য গর্বের যে এ দ্যূতি দেশের সীমানা ছাড়িয়েছে অনেক আগেই।
পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া জ্যেষ্ঠ পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্মের সময়ের কথা লিখেছেন তাঁর ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থে। ১৯৭১ সালে গণহত্যা চলছে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগারে। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে তাকে ফাঁসির দণ্ড দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। এমন সময়ে সন্তানসম্ভবা শেখ হাসিনাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা চিকিৎসা কাজে পদে পদে বাধা সৃষ্টি করছে। চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দিচ্ছে না। ওষুধ কিনতে দিচ্ছে না। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মেয়ের কাছে হাসপাতালে থাকতে চাইলে রূঢ় ভাষায় উত্তর আসে- ‘আপনি কি নার্স যে মেয়ের কাছে থাকবেন?’
জন্ম থেকেই কঠিন সময় অতিক্রম করছেন সজীব ওয়াজেদ জয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বাবা-মায়ের সঙ্গে জার্মানি থাকার কারণে সৌভাগ্যক্রমে ঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পেয়ে যান। ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা যখন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে প্রিয় স্বদেশে ফিরে আসেন, শিশু পুত্র-কন্যারা তখন ভারতে বাবার কাছে। কী কষ্টের জীবন কেটেছে তাদের!
শেখ হাসিনা ১৫ বছর নিরলস সংগ্রাম পরিচালনা করে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নিয়ে আসেন। পুত্র-কন্যারা এ সময়ে কমই মায়ের স্নেহ-মমতা পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনও তো এমনই ছিল। তিনি যন্ত্রণা-কষ্ট চেপে রাখতেন। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও তেমনটি ঘটেছে।
কিন্তু সূর্যের আলো আড়ালে রাখা যায় না। ঘন কালো মেঘও কেটে যায়। শেখ হাসিনার সন্তানরা আপন আলোয় উদ্ভাসিত। তারা কী করছে সেটা সকলে ম্যাগনিফায়িং গ্লাস দিয়ে দেখছে। অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ নেই তাদের নামে। ছিদ্রান্বেষীরা হতাশ বৈকি। কেউ কেউ তো দেশ-বিদেশে দেদারসে অর্থ বিলিয়েছে- ‘যদি একটা কিছু পাওয়া যায়’। পদ্মা সেতু প্রকল্প ভণ্ডুল করার অপচেষ্টার সময়েও তারা সক্রিয় ছিল বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের বদনাম করার জন্য।
ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারণা আনুষ্ঠানিক রূপ পায় ২০০৮ সালে, সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে। সজীব ওয়াজেদ জয় তার আগেই তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছিলেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের কর্মসূচি ও স্লোগান যখন অন্তর্ভুক্ত হয়, অনেকের কাছে বিষয়টিকে অবাস্তব ও হাস্যকর মনে হয়েছে। কিন্তু অবাক বিস্ময়ে আমরা দেখি তরুণ-তরুণীরা এ স্লোগান লুফে নিয়েছে। হতাশাবাদী ও মতলববাজরা হাল ছাড়েনি।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর বিদ্যুৎ চলে গেলে বলা হতো- ডিজিটাল গেছে। ঝড়-বন্যা হলে বলা হতো- ডিজিটাল পানি এসেছে ভারত থেকে। কিন্তু মাত্র কয়েক বছরেই দৃশ্যপট কীভাবে বদলে গেল। এখন করোনাভাইরাস বিপর্যয়ের সময় বাংলাদেশের অর্থনীতি বহুলাংশে যে সচল রয়েছে, তার কিছু কৃতিত্ব দিতে হবে তথ্য-প্রযুক্তি খাতকে। মোবাইল ফোনের আওতায় এসেছে গোটা দেশ। ইন্টারনেট সুবিধা সহজ ও সুলভ হয়েছে। আমার মনে আছে, শেখ হাসিনা প্রথমবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের সময় ‘সুলভ কম্পিউটার সবল অর্থনীতি’ শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশ করেছিলাম। জাতীয় বাজেটে তিনি কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জামের ওপর শুল্ক ‘শূন্য’ করে দিয়েছিলেন।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের কর্মসূচি গ্রহণের পর ইন্টারনেট চলে এসেছে কোটি কোটি মানুষের হাতের মুঠোয়, কম ব্যয়ে। সামনে রয়েছে আরও বড় বড় লক্ষ্য। সরকারি কত ধরনের কাজে এখন ইন্টারনেট। হতদরিদ্র মানুষও টাকা লেনদেন করছে মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধা ব্যবহার করে। আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলি। রিকশাচালককে ভাড়া দিতে গেলে বলে ওঠেন- বিকাশে পাঠিয়ে দেন। লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী ভর্তির আবেদন করছে দেশের নানা প্রান্ত থেকে। বিদেশ যাওয়া, পাসপোর্ট পাওয়া- আবেদন করা যাচ্ছে গ্রামে হাতের কাছের ডিজিটাল সেন্টারে। সরকার দরিদ্রদের অর্থ সহায়তা দিচ্ছে মোবাইলে। এ সুবিধার অপব্যবহারের চেষ্টা নস্যাৎ করে দিচ্ছে প্রযুক্তি। ভূয়া নাম তালিকায় যুক্ত করলে প্রযুক্তি তা ধরিয়ে দিচ্ছে। কৃষিতে বাংলাদেশ যে এখন সুবিধাজনক অবস্থায়, তাতেও অবদান রাখছে তথ্য-প্রযুক্তি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ক্ষেত্রে ভাগ্যবান যে ঘরের মধ্যেই, রাষ্ট্রের কোনো অর্থ ব্যয় না করেই পেয়ে যাচ্ছেন এ অনন্য সুবিধা। এমন একটি দেশে তাকে এ সুবিধা চালু করতে হয়েছে, যেটি মাত্র কিছুদিন আগেও স্বল্পোন্নত দেশের তালিকাতেও ছিল নিচের দিকে। কুসংস্কার অনেক মানুষের মনে বদ্ধমূল। এটাও লক্ষণীয় যে, বিজ্ঞান শিক্ষার ঘোরতরবিরোধী একটি মহল তথ্য-প্রযুক্তির বিকাশের সুযোগকে কাজে লাগাতে শুরু করেছে বাংলাদেশের ক্ষতি করার জন্য। তারা অপপ্রচার চালাচ্ছে, কুৎসা রটনা করছে। সুস্পষ্ট লক্ষ্য তাদের সামনে- মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নস্যাৎ, জনগণের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি, দেশকে নৈরাজ্যের মুখে ঠেলে দেওয়া, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত করা এবং বিশ্বসমাজে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা।
সজীব ওয়াজেদ জয় বাংলাদেশের সমান বয়সী। এই বাংলাদেশের উন্নয়ন-সমৃদ্ধি ঘটছে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণে। শ্রমনির্ভর অর্থনীতিকে প্রযুক্তিনির্ভর করে তুলতে জাতীয় পর্যায়ে চলমান কর্মপ্রয়াসের কেন্দ্রবিন্দুতে তিনি। অফলাইন থেকে অনলাইনে দেশের উত্তরণ ঘটাতে কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। বিশ্বব্যাপীই প্রযুক্তির অগ্রগতি ঘটছে। এর যাত্রা শুরু উন্নত বিশ্ব থেকে। তাদের অঢেল অর্থ আছে। দক্ষ জনশক্তি আছে। এমনকি আমাদের দেশ থেকেও মেধা পাচার করে নিয়ে তারা নিজেদের সৃমদ্ধ করছে। তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা সহজ কাজ নয়। দেশের মধ্যেও বাধার প্রাচীর রয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে সাবমেরিন ক্যাবল বিনা মূল্যে চালু করার সুবিধা হাতছাড়া করেছেন। মহাকাশে বাংলাদেশের নিজস্ব স্যাটেলাইট ঘুরে বেড়ানোর বড় অর্জন তাদের গাত্রদাহ সৃষ্টি করে। তরুণ সমাজকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলার উদ্যোগ বানচাল করতে তাদের উৎসাহের শেষ নেই।
কিন্তু ভরসা করতে পারি আমরা একাত্তরের চেতনায় উজ্জীবিত বাংলাদেশের নেতৃত্বের ওপর। তথ্য-প্রযুক্তির ওপর যথাসময়েই তারা গুরুত্ব দিয়েছেন। সামনে কী করণীয়, কোথায় কী বাধা রয়েছে এবং কীভাবে তা দূর করতে হবে, সে বিষয়ে আমাদের নেতৃত্ব সচেতন। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী কর্মপরিকল্পনা সামনে রেখেই বাংলাদেশ অগ্রসর হচ্ছে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা কৃতিত্ব পেতে পারেন। এ কাজে এমন যোগ্য সহযোগী নির্বাচন করতে পেরেছেন তিনি যিনি উজ্জ্বল আলোক শিখার কেন্দ্রে থেকেও আপন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে নিভৃতে, সযতনে দেশের ও দশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে চলেছেন।
লেখক: অজয় দাশগুপ্ত, গবেষক ও কলামিস্ট
সূত্র: বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম