লেখক ভট্টাচার্য
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদেশের মাটি আর মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। শৈশব থেকেই তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করেছেন। কৈশোরে তিনি তার স্কুলের দুরবস্থার কথা তুলে ধরেছিলেন স্কুল পরিদর্শনে আসা পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে। স্কুল শিক্ষকের অব্যবস্থাপনায় শিক্ষা ব্যবস্থায় দুরবস্থার সৃষ্টি হলে তিনি স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ক্লাস বর্জন করেছিলেন, তার এই আন্দোলনের ফলে স্কুলে শিক্ষা ও শৃঙ্খলা ফিরে এসেছিল। এরপর তিনি কলকাতা যান ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য। ১৯৪৩ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ শুরু হয়, বাংলায় লাখ লাখ লোক মারা যাচ্ছিল। বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লেখেন, 'এ সময় আমি লেখাপড়া ছেড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অনেক লঙ্গরখানা খুললাম। দিনে একবার করে খাবার দিতাম। মুসলিম লীগ অফিসে, কলকাতা মাদ্রাসায় এবং আরও অনেক জায়গায় লঙ্গরখানা খুললাম। দিনভর কাজ করতাম আর রাতে কোনোদিন বেকার হোস্টেলে ফিরে আসতাম, কোনোদিন লীগ অফিসের টেবিলে শুয়ে পড়তাম।' ছাত্রজীবনে বঙ্গবন্ধু ছাত্রদের বিপদে আপদে পাশে দাঁড়াতেন। কোন ছাত্রের কী অসুবিধা হচ্ছে, কোনো ছাত্র হোস্টেলে জায়গা পেল না, কার ফ্রি মিল দরকার; তাকে বললেই প্রিন্সিপাল ড. জুবেরী সাহেবের কাছে গিয়ে হাজির হতেন। দুঃখী মানুষের কষ্ট বঙ্গবন্ধু সহ্য করতে পারতেন না। কোনো অন্যায় দেখলেই তাৎক্ষণিকভাবে এর প্রতিবাদ করতেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন একটি সুখী-সমৃদ্ধ, গণতান্ত্রিক, ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। দেশের মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তিই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান ও সাধনা। ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম দিয়ে শুরুর পর থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনা পর্যন্ত সারা জীবনের এক-চতুর্থাংশ সময় কারাগারেই কাটাতে হয়েছিল তাকে। ৫৫ বছরের জীবনে বঙ্গবন্ধু ৪৬৮২ দিন কারাগারে ছিলেন। বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তার অসীম সাহসী নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে যে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়, তার প্রেরণাও ছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে যখন বঙ্গবন্ধু নতুন করে গড়ে তোলার কাজে ব্রতী হন, তখনই দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীরা ষড়যন্ত্র শুরু করে। এই ষড়যন্ত্র কেবল ব্যক্তি মুজিবের বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও তার আদর্শের বিরুদ্ধে।
যে মানুষটার জন্য আজ আমরা একটা দেশ পেয়েছি, একটা পতাকা পেয়েছি, একটা জাতীয় সংগীত পেয়েছি; সেই মানুষটাকেই এই দেশে নৃশংসভাবে সপরিবারে হত্যা করা হলো। যে বাঙালিকে তিনি আজীবন বিশ্বাস করেছেন, তাদেরই কয়েকজন তাকে হত্যা করল। বিশ্বাসঘাতকতার এই করুণ ইতিহাস ভুলবার নয়। এর থেকে দুঃখের, এর থেকে বেদনার আর কী হতে পারে বাঙালির জন্য। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে রচিত হয় ইতিহাসের সেই কলঙ্কিত অধ্যায়। এই দিনে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল নরপিশাচরা। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশকে এর মূলনীতি ও প্রত্যয় থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু ছাড়াও ১৫ আগস্ট রাতে ধানমন্ডির বাড়িতে তার সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও ১০ বছরের শিশুপুত্র শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের, বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিলকে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মনির বাসায়ও হামলা করা হয়। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার এবং নিকটাত্মীয়সহ ২৬ জনকে ওই রাতে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সে সময় তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করায় তারা প্রাণে বেঁচে যান।
পিতা মুজিবের আপসহীন এবং সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনাদর্শ নিয়েই তার সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা পিতার অসমাপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে চলেছেন অপ্রতিরোধ্য গতিতে। দেশরত্ন শেখ হাসিনা সবকিছু হারিয়ে, অভিমান-কষ্ট-ব্যথা ভুলে সেই বাঙালিকেই আবার আগলে ধরেছেন। হাজারো বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে তিনি আবার হারানো সেই 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' স্লোগানকে তার প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছেন। ১৯৮১ সালে তার আগমনে বাংলার মানুষ আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল, যে স্বপ্ন আজ বাস্তবায়িত হচ্ছে। বিশ্বমোড়লদের তাক লাগিয়ে দিয়ে তলাবিহীন ঝুড়ি আখ্যা দেওয়া বাংলাদেশকে তিনি অমিত সম্ভাবনার দেশ হিসেবে বিশ্বলোকে সুপরিচিত করেছেন।
যে শোকাবহ আগস্টে পিতা-মাতাসহ সমগ্র পরিবারকে তিনি হারিয়েছিলেন, সেই ২০০৪ সালে আগস্টের ২১ তারিখ তাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। দেশরত্ন শেখ হাসিনা পিতা মুজিবের রক্তের সুযোগ্য উত্তরাধিকার। তার ধমনিতে শিরায় শিরায় জাতির পিতার পুণ্য রক্তের স্রোত প্রবহমান। এই রক্ত কখনও বাংলা, বাঙালি আর বাংলাদেশকে হারতে দেবে না, দিতে পারে না। তাই তো সকল বাধা পেরিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি সুখী সমৃদ্ধ আধুনিক বাংলাদেশ তথা জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে তিনি এগিয়ে চলছেন দুর্বার গতিতে। আর সব বাধা পেরিয়ে বিশ্ব মানবতাবাদের অন্যতম মানবতাবাদী নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের অসম্ভব ত্যাগ ও মানবকল্যাণে নিবেদিত জীবনাদর্শ দিয়ে গড়ে ওঠা তার প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠান এবং তার আদর্শে অনুপ্রাণিত কোটি কোটি বাঙালির চেতনা শক্তির কাছে পরাজিত হবে সকল অপশক্তি। এভাবেই দেশরত্ন শেখ হাসিনার হাত ধরে এগিয়ে যাবে পিতা মুজিবের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ। আমি বিশ্বাস করি, মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানানোর শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে সুখী, সমৃদ্ধ, গণতান্ত্রিক ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশের যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, তার বাস্তব রূপ দিতে দেশরত্ন শেখ হাসিনার নির্দেশমতো কাজ করা। দেশরত্ন শেখ হাসিনার হাত ধরেই আমরা পৌঁছে যাচ্ছি বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায়।
বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশের কল্পনা করা অসম্ভব। বঙ্গবন্ধুই আমাদের বাংলাদেশ।
সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ