- এখলাসুর রহমান
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৫ আগস্ট রাতে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। মৃত্যুর পরে তার লাশকেও করা হয় চরম অসম্মান। তাকে নতুন কাফনের কাপড় পরানো হয়নি। মাখানো হয়নি সুগন্ধী সাবান। কাপড় কাচার ৫৭০ সাবান দিয়ে বঙ্গবন্ধুর লাশ ধোয়ানো হয়েছে। রেড ক্রিসেন্টের রিলিফের সাদা শাড়ি কেটে তাকে কাফন পরানো হয়। মুক্তিযোদ্ধারা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পায় কিন্তু মুক্তিযুূদ্ধের স্থপতি তা পেলোনা! স্বাধীনতার পক্ষে কবিতা ও গান রচয়িতারা মারা গেলে তাদের লাশে পুস্পস্তবক অর্পন করে সম্মান প্রদর্শন করা হয় কিন্তু স্বাধীনতার স্থপতিকে তা করা হল না। যে জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিলেন বঙ্গবন্ধু সে জাতি কেন মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে তার জানাযায় যেতে পারলোনা? আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা কেন খুনী মুশতাক সরকারে গেল? কেউ মন্ত্রী হল, স্পিকার ও সাংসদ থাকল?
আজ যারা বঙ্গবন্ধুর প্রয়াণ দিনে শোক প্রকাশের প্রতিযোগিতা করছেন সেদিন তারা সাহসী হওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলে অন্যরকম ইতিহাস হত।জন্মদাতা পিতা খুন হলে ভীরু কন্যাও রুখে দাঁড়ায়।আর জাতির পিতাকে সপরিবারে খুনের পরেও জাতির তরুনরা কেন রুখে দাঁড়ালো না? তবে হ্যাঁ, সামান্য কিছু তরুন রুখে দাঁড়িয়েছিল।এদের বেশির ভাগই অজপাড়া গাঁয়ের খেটে খাওয়া মানুষ।আর যারা বঙ্গবন্ধুর সরকারের সুবিধাভোগী তাদের আর কয়জন রুখে দাঁড়িয়েছিল? তাদেরতো বেশির ভাগই লুকিয়েছিল কিংবা মুশতাক সরকারের সাথে আঁতাত করেছিল। বিপদেই বন্ধুর পরিচয় সুদিনেতো শত্রুরাও বন্ধুর মুখোশ পরে থাকে। এটা যেন একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।
ওয়ান ইলেভেন এর পরে শেখ হাসিনা বিষয়ে কিছু দলীয় নেতার মাইনাস টু সম্পৃক্ততাও জাতি প্রত্যক্ষ করেছে।দূর্দিনে যারা থাকে সুদিনে তারা মূল্যায়িত হয়না। মূল্যায়নটাও অর্জন করে নিতে হয়। যেমন একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের একতাবদ্ধ সাংগঠনিক কর্ম প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আজ মূল্যায়নের জায়গা অর্জন করে নিয়েছে। দেশব্যাপী সক্রিয় রয়েছে তাদের অধিকার আদায়ের সংগঠন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ। রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রনালয় যার মন্ত্রীও থাকেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। এখন তারা মাসিক সম্মানী পাচ্ছে ১০,০০০ টাকা করে। আরও পাচ্ছে বিশেষ ব্যাংক ঋন সুবিধা। পাচ্ছে গৃহ নির্মাণের অনূদান। তাদের নাতিপুতিরা পাচ্ছে চাকরির কোটা সুবিধা। পাচ্ছে ঈদ বোনাস। জাতীয় দিবস গুলোতে তারা পায় সম্মানজনক উপস্থিতির মর্যাদা। মৃত্যুর পরে পায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার। তারা পেয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত বিশেষন ‘জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান’। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারীরা রয়েছে চরম উপেক্ষিত।
চ্যানেল আই ও বাংলাদেশ প্রতিদিনে তাদের নিয়ে লেখালেখি হওয়ায় তারা কিছুটা দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর হতে এক লাখ টাকা করে অনুদান প্রদান করা হচ্ছে। প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সাথে কথা বলে জানা যায় এ অনুদান অনেক প্রতিরোধ যোদ্ধা পায়নি। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার মত ভুয়া প্রতিরোধ যোদ্ধা সৃষ্টি হোক এটা তারা আকাঙ্ক্ষা করেন না। প্রতিরোধ যোদ্ধা পরিষদ নামে একটি সংগঠন হয়েছে। কিন্তু এটি কেবলই নামকাওয়াস্তে এর কোন সক্রিয় ভূমিকা নেই। সারাদেশের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের তালিকাভূক্ত করে সাংগঠনিক তৎপরতা সক্রিয় করা উচিত বলে মনে করেন তারা। আর যারা আজও ভারতে রয়েছে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়াও দরকার।
প্রতিটি দিবসের সাথে এর সাথে সংশ্লিষ্টরা মূল্যায়িত হবে এটাই যৌক্তিক। যেমন ভাষা সংগ্রামজনিত দিবসে ভাষা সৈনিক, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনকারীরা, একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধারা, নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনকারীরা প্রভৃতি। কিন্তু ব্যাতিক্রম ১৫ আগস্টের জাতীয় শোক দিবস। এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়। হত্যাকারীদের টার্গেট দলগতভাবে আওয়ামী লীগ ছিলনা। ছিল ব্যক্তি মুজিব। বাস্তবতা ছিল আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা লুটপাট ও দূর্নীতি করে এক অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। তাদের এসব কর্মকান্ড খুনীদের সহায়ক হয়েছিল। খুনীরা বুঝে যায় এমন পরিস্থিতিতে এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটালে দেশ চুপসে যাবে। তবে হ্যাঁ গোটা কয়েক লোক চুপসে যায়নি তারা বঙ্গবন্ধু হত্যা ও খুনী সরকারকে মেনে নিতে পারেনি। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নেমে যায় প্রতিরোধ যুদ্ধে। তখন তাদেরকে বলা হতো দুস্কৃতিকারী। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারীদের মধ্যে যারা প্রতিরোধ যুদ্ধে মারা গেছেন তাদের নেই শহীদের স্বীকৃতি। যারা আজও ভারতে রয়েছেন তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসনেরও কোন উদ্যোগ নেই। ১৫ আগস্টের অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু হত্যার এই প্রতিবাদকারীরা পায়না কোন আমন্ত্রন। প্রতিরোধ যোদ্ধারা বঙ্গবন্ধু আমলের এমপিদের বিপ্লবী সরকার গঠনের প্রস্তাব দেয়। তারা বঙ্গবন্ধুর খুনী সরকারকে মেনে নিতে পারেনি।অথচ অনেক ভিভিআইপি নেতা শুধু খুনী সরকারকে মেনেই নেয়নি সেখানে যোগও দেয়।
১৯৭৬ সালে ঢাকার মগবাজারে আব্দুল মান্নান (টাঙ্গাইল) এর বাসায় গোটা কয়েক এমপিদের নিয়ে বৈঠক করে তারা। প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সাথে কথা বলে জানা যায় , বিপ্লবী সরকার গঠনে যশোরের চিত্তরঞ্জন সুতার এমপি একমত হন। আব্দুল মান্নানের বাসার বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, আব্দুল মজিদ তারা মিয়া (কলমা কান্দা -দূর্গাপুরের এমপি), আখলাকুল হোসাইন আহমেদ (মোহন গঞ্জ), হাতেম আলী (গৌরীপুর), আনোয়ারুল কাদির, শামসুল হক (গোঁয়ার শামসু), হাতেম আলী তাং ও মোশারফ হোসেন ও ডাঃ জগদীশ দত্ত প্রমুখ। এরপর তারা সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের বাসায় বৈঠকে মিলিত হন। কিন্তু এমপিরা বিপ্লবী সরকার গঠন করতে সাহসী হলো না। কিন্তু প্রতিরোধ যোদ্ধারা থেমে থাকেনি। তারা পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেছে বিভিন্ন হাওর এলাকায়।
তাদের অনেকেই আজ পঙ্গু হয়ে বেঁচে আছে। কেউ ভারতে মানবেতর জীবন পাড় করছে। তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসনেরও কোন তৎপরতা নেই। ১৫ আগস্ট আসে ও ১৫ আগস্ট যায়। কিন্তু ১৫ আগস্টের বীর সৈনিকরা আজও উপেক্ষিতই থেকে যায়। খুনী সরকার তাদেরকে দুষ্কৃতিকারী বিশেষন দিয়েছিল। তবে কি আজও তারা দুষ্কৃতিকারীই রয়ে গেছেন?