কবি রফিক আজাদ কবিতায় উচ্চারণ করেছিলেন, ‘এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে’। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির সেই সিঁড়িতে আক্ষরিক অর্থেই সে রাতে রক্তগঙ্গা বয়ে গিয়েছিল। বাংলার সবুজ শস্যের মাঠ বেয়ে সে রক্ত গিয়ে মিশেছিল বঙ্গোপসাগরে। বিশ্বাসঘাতক হন্তারকদের হাতে শাহাদৎবরণ করেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের ১৮ জন সদস্য। আরবের সব সুগন্ধি মেখেও বিশ্বাসঘাতকদের সে কলুষিত হাতের দুর্গন্ধ রোধ করা যাবে না কোন দিনও। অথচ কথা ছিল বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কথা ভুলে গিয়ে হিমালয়সম বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ভর করে আমরা ঘুরে দাঁড়াব মাথা উঁচু করে। কিন্তু সে সৌভাগ্য আমাদের এ দুর্ভাগা জাতির হয়নি।
সে রাতে এ জাতির মতোই দুর্ভাগা ছিলেন আরও চারজন নারী। একজন চিরসহিষ্ণু সহধর্মিণী; যিনি বুক পেতে আগলে রেখেছিলেন একটি ঐতিহাসিক পরিবারকে। দু’জন নবপরিণীতা রাঙা বধূ; যাদের হাতে তখনো শুকায়নি মেহেদি পাতার রঙ। আরেকজন সদ্য অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী; যার অগোছালো সংসারটি তখনো গুছিয়ে নেয়া হয়নি ঠিকঠাকভাবে। তারা প্রত্যেকে অন্য পরিবার থেকে এসে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন মুজিব পরিবারের সাথে। বিজয়লক্ষ্মী প্রেরণাদায়ী হিসেবে তারা তাদের জীবনসঙ্গীর পারিপার্শ্বে ছড়িয়েছেন প্রেম ও কল্যাণের সৌরভ। অথচ অর্ধাঙ্গী হিসেবে পরিপূর্ণ যোগ্যতা ও অবদান থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ সময় তারা থেকে গেছেন অনুচ্চারিত। আবার হয়তো সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা হারানোর শোক ও বিহ্বলতা আমাদের কিছুটা বিস্মৃত হতে দিয়েছে এই চার আত্মত্যাগী নারীর গৌরবগাঁথা।
প্রথমজন জাতির পিতার সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, ডাক নাম রেনু। বঙ্গবন্ধুর জন্মেরও দশ বছর পরে ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট তার জন্ম। চাচাতো ভাই শেখ মুজিবের সঙ্গে যখন বিয়ে হয় তখন তার বয়স মাত্র তিন বছর। এরপর পিতৃ-মাতৃহীন রেনু লালিত হন শ্বশুরালয়ে। তাই জাতির পিতার সাথে গড়ে ওঠে তার আশৈশব অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। রেনুর জীবনকাল পর্যালোচনা করতে গিয়ে আমরা অবলোকন করি এক বনফুলের পরিপূর্ণ পরিস্ফুটন, এক সাধারণ নারীর ধীরে ধীরে বঙ্গজননী হয়ে ওঠা। সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে তিনি ছিলেন জাতির পিতার ছায়াসঙ্গী। জীবনভর স্বীকার করেছেন অসামান্য ত্যাগ ও সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু নিজেই তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘রেনু খুব কষ্ট করতো কিন্তু কিছুই বলতো না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকা পয়সা জোগাড় করে রাখত। যাতে আমার কষ্ট না হয়’।
ছাত্রজীবন থেকেই ছন্নছাড়া, গৃহত্যাগী ও সংগ্রামী এক পুরুষের সহযাত্রী হওয়া রোমাঞ্চকর শোনালেও সে পথ ছিল বিপদসঙ্কুল। দিনভর অনিশ্চয়তা আর শঙ্কায় চাপা পড়ে যায় কিশোরীর উচ্ছ্বাস ও প্রগলভতা। নির্মম বাস্তবতা কিশোরী রেনুকে করে তোলে পরিণত ও প্রাজ্ঞ। তাই পরবর্তীত সময়ে আমরা দেখি, আর দশজন সাধারণ বাঙালি নারীর মতো স্বাভাবিক সংসারের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে সমগ্র দেশটাকেই আপন সংসার বানিয়ে নিয়েছেন রেনু। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন একজন সহযোদ্ধা, বঙ্গবন্ধুর একান্ত পরামর্শদাতা। তার প্রমাণ আমরা পাই বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনায়। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় যখন দলীয় নেতাকর্মীরা কিছুটা দিগভ্রান্ত, বঙ্গবন্ধু নিজেও কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত তার প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে, তখন রেনু তার বড় মেয়েকে দিয়ে স্বামীর কাছে বার্তা পাঠালেন, ‘গোলটেবিল বৈঠকে অবশ্যই যাবে, তবে মুক্ত মুজিব হিসেবে’। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পূর্বে তিনি চিন্তাগ্রস্ত মুজিবকে বললেন, ‘তুমি যা বিশ্বাস করো, তাই বলবে’। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের মিয়াওয়ালী কারাগারে পাঠানো হলে সীমাহীন ধৈর্য্য ও বিচক্ষণতা দিয়ে তিনি মোকাবিলা করলেন পরিবর্তিত পরিস্থিতি।
অথচ দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু যখন স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে দেশের হাল ধরলেন, তখন হয়ত রেনু চেয়েছিলেন কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে। চেয়েছিলেন অন্নপূর্ণার মতো তার কখনো না হওয়া সংসারটি ঠিকঠাক মতো করতে। মাতৃরূপেন সংস্থিতা হয়ে সমগ্র দেশের নারীদের জন্য অবদান রাখতে। কিন্তু সে সৌভাগ্য তার বেশিদিন হয়নি। সে রাতে ঘাতকদের বুলেটের আঘাতে তিনি লুটিয়ে পড়লেন সিঁড়ির মুখের ঘরটাতে, যে সিঁড়িতে নিথর শুয়ে ছিল লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরিহিত সমগ্র বাংলাদেশ।
দ্বিতীয় নারীটি হলেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামালের নবপরিণীতা স্ত্রী সুলতানা কামাল খুকি। জন্ম ১০ ডিসেম্বর ১৯৫১। ছিলেন ষাটের দশকের দেশসেরা নারী ক্রীড়াবিদ। ১৯৬২ সালে আন্তঃবিদ্যালয় অ্যাথলেটিক্স, ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান অলিম্পিক, ১৯৭০ সালে লাহোরে ন্যাশনাল গেমস, ১৯৭৩ সালে অল ইন্ডিয়া গ্রামীণ স্পোর্টস, ১৯৭৫ সালে জাতীয় অ্যাথলেটিক্সসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় উচ্চলম্ফ, দীর্ঘলম্ফ ও ১০০ মিটার হার্ডলসে স্বর্ণপদকসহ অসংখ্য পদক অর্জন করেছিলেন। প্রিয়দর্শিনী এই ক্রীড়াবিদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। একই বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল।
হঠাৎ একদিন শেখ কামাল আবিষ্কার করলেন, এই ফুটফুটে মিষ্টি মেয়েটিকে তিনি প্রচন্ড ভালবাসেন। তবে সমস্যা হলো, ছোটবেলা থেকে ডানপিটে স্বভাবের কামাল ভালোবাসার কথা কোনোভাবেই খুকিকে জানাতে পারছিলেন না। বহু উপায় খুঁজলেন। বাদ গেলো না বন্ধুদের দিয়ে বলানোর বৃথা চেষ্টাও। শেষমেশ একদিন নিজেই বলে দিলেন মনের কথা। জবাবে খুকি বলেছিলেন, প্রেম-ট্রেম করতে পারবেন না। এতোই যদি ভালো লাগে তবে যেন বাসায় লোক পাঠায়।
এরপর দুই পরিবারের সম্মতিতে কামাল ও খুকির বিয়ে সম্পন্ন হয় ১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই। এর ঠিক এক মাস পরেই, ১৫ই আগস্ট ঘাতকদের গুলিতে নিহত হন খুকি। তার লাশ পড়ে ছিল স্নেহের দেবর শেখ রাসেলের পাশেই। অথচ কী এমন বয়স হয়েছিল খুকির? চব্বিশ-পঁচিশ বছরের তরুণী। তখনো এমএ পরীক্ষার ফল বেরোয়নি তার। করার ছিল অনেক কিছুই। আমরা জানতে পারি তিনি ছিলেন প্রচন্ড উচ্ছ্বল, বন্ধুবৎসল আর প্রতিবাদী স্বভাবের। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানে ন্যাশনাল গেমস খেলতে গিয়ে পাকিস্তানি কর্তাদের বিমাতাসুলভ আচরণের প্রতিবাদ করেছিলেন। এরপর ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে হারিয়েছিলেন প্রাণপ্রিয় ভাইকে। স্বাধীনতার পর অনেক কিছুই পাওয়ার ও দেয়ার ছিল তার। কিন্তু চির অধরা থেকে গেল এক অমিত প্রতিভাধর ও সম্ভাবনাময় নারীর প্রেম, বন্ধুত্ব আর সৃষ্টিশীলতার স্বপ্ন।
তৃতীয় নারীটি বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামালের নবপরিণীতা স্ত্রী পারভীন জামাল রোজী। জন্ম সিলেটে, ১৯৫৬ সালে। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছোট বোন খাদেজা হোসেন লিলির কনিষ্ঠ কন্যা। গোলাপের মত সুশ্রী বলে জন্মের পর বঙ্গবন্ধুই তার নাম রেখেছিলেন রোজী।
১৯৭৫ সালের ১৪ই জুলাই শেখ কামাল ও খুকির বিয়ের দিন রোজীকে দেখে বঙ্গবন্ধু তার বোন লিলিকে বলেছিলেন, ‘আমার জামালের জন্য বউ খুঁজতে দূরে যেতে হবে না। তোমার মেয়েকে আমি নিলাম’। এর তিনদিন পর ১৭ জুলাই শেখ জামালের সাথে পরিণয় সুত্রে আবদ্ধ হন রোজী। কিন্তু নিয়তির কী নির্মম পরিহাস! শেখ পরিবারের দুই বধূ খুকি ও রোজী এসেছিলেন মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে, কিন্তু বিদায় নিলেন একই দিনে।
কিশোরী রোজীর সংসার জীবন ছিল মাত্র আঠাশ দিনের। এরপরই তার জীবনে নেমে আসে ১৫ আগস্টের কালো থাবা। মাত্র উনিশ বছর বয়সে স্বপ্ন দেখার আগেই খানখান হয়ে যায় একটি কিশোরীর জীবন। ধানমন্ডি গার্লস স্কুল থেকে সদ্য ম্যাট্রিক পাশ করে বদরুন্নেসা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী রোজীর আর কখনোই কোন পরীক্ষায় বসা হয়নি। অথচ তখনো তার হাতে লেগে ছিল মেহেদী পাতার রং। হয়তো তখনো ঠিকমতো শিখে নেয়া হয়নি শাড়ির ভাঁজের রীতি। বুঝে ওঠা হয়নি দাম্পত্যের রহস্য।
সবশেষে, চতুর্থ নারীটি হলেন বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মনি। জন্ম ১৫ মার্চ ১৯৪৭। তিনি ছিলেন আবদুর রব সেরনিয়াবাতের জ্যেষ্ঠ কন্যা। ১৯৭০ সালে খালতো ভাই শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ফজলুল হক মনি তখন বিপ্লবী তরুণ নেতা। ১৯৭১ সালে তিনি অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে, গড়ে তুলেছিলেন মুজিব বাহিনী। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন আওয়ামী যুবলীগ। দেশের যুব সমাজ নিয়ে তখন অনেক স্বপ্ন ও ব্যস্ততা তার।
আরজু মনি তাই একা হাতে সামলান ছোট্ট পরিবারটিকে। ঘর আলো করে আসে দুই সন্তান পরশ ও তাপস। সংসারের দায়িত্ব, সন্তানদের লালন পালনের পাশাপাশি চলতে থাকে তার পড়াশোনা। বিদূষী আরজু মনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে এমএ পরীক্ষা দেন ১৯৭৫ সালে। কিন্তু পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগেই তার জীবনেও হানা দেয় ১৫ আগস্ট।
জাতির পিতার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির পাশাপাশি সেদিন রাতে হামলা হয়েছিল আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ ফজলুল হক মনির বাড়িতেও। সেদিন আরজু মনি তার পিতা ও স্বামী দু’জনকেই হারান। ঘাতকদের বুলেটে বিদ্ধ হয়ে তিনি নিজেও যখন লুটিয়ে পড়েন, তখন তার শরীরে বেড়ে উঠছিল তার অনাগত তৃতীয় সন্তান। একই দিনে নিঃশ্বেষ হয়ে যায় তিনটি প্রজন্ম। সেই কষ্ট আজও বয়ে বেড়ান আরজু মনির দুই সন্তান পরশ ও তাপস।
আজ আরেকটি ১৫ আগস্ট, পয়তাল্লিশতম শোকবার্ষিকী। সেই সঙ্গে স্বাধীনতার পঞ্চাশতম বছরে পদার্পণ করেছে বাংলাদেশ। কালের স্রোতে নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ আজ সমৃদ্ধির দিকে ধাবমান। কিন্তু আজকের দিনে এসেও আমরা বিস্মৃত হতে পারি না আমাদের সেই জ্বাজল্যমান ইতিহাসের কথা। ভুলে যেতে পারি না জাতির পিতার পরিবারের আদর্শ, আর সেই চার নারীর আত্মত্যাগের কথা, যারা বধু হয়ে এসে তাদের পরিবার ও দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। আজকের আধুনিক পৃথিবীতে চারিদিকে যখন নারীদের জয়জয়কার, বিশ্বব্যবস্থায় যখন নতুন করে মূল্যায়িত হচ্ছে নারীদের অসামান্য অবদান, তখন জাতিগতভাবে আমাদেরও মনে রাখা উচিত আমাদের বাংলার ইতিহাসের নারীদের কথা। আর সে ইতিহাস ঘাটতে খুব বেশিদূর পেছনে যাওয়ার দরকার নেই, এই চার মহীয়সী নারীর জীবনের দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়।
শাহনেওয়াজ শুভ, পরিসংখ্যান কর্মকর্তা, বিবিএস
ইমেইলঃ s.m.shahnawaze@gmail.com