- ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন
ছোটবেলায় মাঝে মাঝে শুনতাম, আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এলে দেশ ভারত হয়ে যাবে, মসজিদে আজানের আওয়াজ ধ্বনিত হবে না; উলুধ্বনি শোনা যাবে। কিন্তু এখন দেখা গেলো, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ কয়েকবার ক্ষমতায় এলেও দেশ ভারত হয়ে যায়নি আর মসজিদেও উলুধ্বনি শোনা যায়নি। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বিরোধীতার খাতিরে কিছু মানুষ বলতেন, বেটা আওয়ামীলীগও করে আবার নামাজও পড়ে। মানে আওয়ামীলীগ করলে নামাজও পড়া যাবে না। কিছু মানুষতো আরো অনেকটা অগ্রগামী হয়ে বলতেন, বেটা মুসলমান আবার করে আওয়ামীলীগ। অর্থাৎ তাদের দৃষ্টিতে মুসলমান আর আওয়ামীলীগ পরস্পর বিপরীতধর্মী দুটি বিষয়; যেন কোনো মুসলমান আওয়ামীলীগ করলে সেটি তাদের কাছে রীতিমতো বিস্ময়ের ও নিন্দনীয় বিষয়।
কিন্তু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর অকোতভয় নেতৃত্বে ত্রিশ লক্ষ মানুষের আত্মাহুতি আর দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের সমাজচিত্র ও বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। সেটি হলো‒ গোটা দেশের সর্বত্রই দেখা যায়, আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা শুধু মুসলমানি দাবি করে বসে থাকেন না; তারা মসজিদে নামাজের তরে যান, সামনের কাতারেও বসেন, মসজিদ কমিটির সভাপতিসহ নানা দায়িত্বও পালন করেন। মসজিদের ইমামের ভরণ-পোষণের চিন্তায় তারাও সময় ব্যয় করেন, মসজিদ পরিচালনায় নানাভাবে সহযোগিতার হাতও প্রসারিত করেন। তারা বিভিন্ন ক্যাটাগরির ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা মাদ্রাসাও প্রতিষ্ঠা করেন। মাদ্রাসায় যেন ভালোভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চলে সেজন্যেও সাধ্যমতো সবধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন।
বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সাথে সম্পৃক্ত মানুষজনের ইসলাম-সংশ্লিষ্ঠ কর্মকাণ্ড এমন হওয়া ঐতিহাসিক কারণেই স্বাভাবিক। কেননা ঐতিহ্যবাহী এ দলটির মহান নেতা, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শান্তির ধর্ম ইসলাম ও এর মূল্যবোধ প্রচার-প্রসারে যে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন তা ইতিহাসে বিরল।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে এদেশে মদ-জুয়া-হাউজির লাইসেন্স বাতিল করেছিলেন, ঘোড়দৌড় নিষিদ্ধ করেছিলেন, তাবলিগ জামাতের নিরবিচ্ছিন্ন ইসলাম প্রচারের স্বার্থে কাকরাইল মসজিদের স্থান প্রদান, পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত টঙ্গীর ‘বিশ্ব ইজতেমা’ ময়দানের জায়গা নির্ধারণ, মাদ্রাসা বোর্ডের সংস্কার ও আধুনিকায়ন, বেতার-টিভিতে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের ফরমান, জাতীয় পর্যায়ে সিরাত মজলিস ও ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপন, শবে কদরের মহিমান্বিত রজনীতে সংবিধান পাশ, হজ্ব যাত্রীদের ভ্রমণ কর রহিতকরণ, রাশিয়ায় তাবলিগ জামাতের প্রতিনিধি প্রেরণ এবং একেকজন সদস্যকে স্বদেশের পক্ষে কুটনীতিকের ভূমিকা পালনের আহ্বান, মুসলিম মিল্লাতের বৃহত্তর স্বার্থ সংরক্ষণের তাগিদে ওআইসি-এর সম্মেলনে অংশগ্রহণসহ নানাবিধ কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ইসলামবিষয়ক কীর্তির স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তবে বাংলাদেশে ইসলামের তরে চিরস্মরণীয় ও নজিরবিহীন যে কাজটি তিনি করেছেন সেটি হলো ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা; সমগ্র বিশ্বে ইসলামের প্রচার-প্রসার ও গবেষণা আর প্রকাশনার ক্ষেত্রে এটি সর্ববৃহৎ এক অনন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত।
এ বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই যে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান ও এর জনগণের উপর কোনো ক্ষেত্রেই আদল ও ইনসাফ তথা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেনি। বরং তারা এতদঞ্চলের মানুষের উপর রীতিমতো অবিচার তথা জুলুমের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তারা সর্বক্ষেত্রে খারাপ কাজের নজির স্থাপন করেছিল। ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসুল হজরত মোহাম্মদ (সা.) ঘোষণা করেছেন- ‘মান রাআ মিনকুম মুনকারান ফালয়ুগাইয়িরহু বিয়াদিহি ফাইল্লাম য়াসতাতি ফাবিলিসানিহি ফাইল্লাম য়াসতাতি ফাবিকালবিহি ওয়া যালিকা আজআফুল ইমান’ অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে যে কেউ যখনই কোনো খারাপ বা মন্দ কাজ প্রত্যক্ষ করবে তাৎক্ষণিক সেটি প্রতিহত করার জন্যে শক্তি প্রয়োগ করো। আর শক্তি প্রয়োগে যদি তুমি সামর্থ না হও তবে তোমার ভাষণে-বক্তব্যে বা কথায় সেটির প্রতিবাদ করো। তাও যদি না পার তবে সেই কুকর্ম বন্ধকরণে তুমি তোমার অন্তঃকরণের দ্বারা কোনো একটি পরিকল্পনা বের করো, যাতে করে সেটি বন্ধ হতে পারে। আর এটি হলো ঈমানের একেবারে সর্বনিম্ন স্তর। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের জালেম ও স্বেচ্ছাচারী শাসকগোষ্ঠীর সকল প্রকার অপকর্মের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়ে ঈমানের প্রথম স্তরের পরিচয়ই পেশ করেছিলেন।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের ভাষণেও তিনি তাঁর মূল শক্তি ও সম্পদ হিসেবে যা বিবৃত করেছিলেন তার অন্যতম ছিল সেই ঈমান ও ঈমানী তেজোদীপ্ততা। অন্যদিকে বাঙালিরা ছিল মাজলুম তথা নির্যাতিত। মহানবী (সা.)-এর অপর একটি নির্দেশনা হচ্ছে‒ ‘তোমরা মজলুমের পক্ষ সমর্থন করে তাদের নিপীড়িত আত্মার অভিশাপ থেকে নিজেদের রক্ষা করো’। মানবতাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত লৌহমানব বঙ্গবন্ধু সত্যিকার অর্থেই সারাটি জীবন অত্যাচারিত মানবতার ভাগ্যোন্নয়নে অতিবাহিত করেছেন‒ যা উল্লিখিত বাণীরও এক সফল বাস্তবায়ন।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, উদার ও মহানুভব একজন বিশ্বনেতা। সকল ধর্মের সমান অধিকার তিনি নিশ্চিত করেছিলেন। প্রত্যেকেই যেন তার নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী স্বাধীনভাবে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে পারেন‒ তিনি প্রকৃত অর্থে সেই ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন‒ ‘আমি সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছি।’ প্রকৃতপক্ষে সকল ধর্মমতের মানুষের সহাবস্থান ইসলামেরই মহান শিক্ষা; বঙ্গবন্ধু মদিনার সনদের আলোকে সেই শিক্ষারই বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর মাতৃভূমি প্রিয় বাংলাদেশকে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হিসেবে ঘোষণা করে বলেছেন‒ ‘আমি এদেশে ইসলামের অবমাননা চাই না।’ স্বাধীনতা-উত্তর বঙ্গবন্ধু মুসলিম বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের প্রভুত উন্নতি বিধান করেন। কেননা মুক্তিযুদ্ধকালীন মুসলিম বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ছিল নেতিবাচক। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁর গতিশীল নেতৃত্ব আর প্রত্যুতপন্নমতিত্ব দিয়ে অল্পকালের ব্যবধানে সে সম্পর্ক এমন জায়গায় উপনীত করেন যে, তাদের অনেকেই তখন বাস্তবতা উপলব্ধি করেন এবং পুরো বিষয়ে তারা যে অন্ধকারে ছিলেন ও তাদের ভাবনা যে সঠিক ছিল না তা তারা স্বীকার করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে লাহোরস্থ ইসলামি সম্মেলন সংস্থার শীর্ষ সম্মেলনে যে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন, তাতে বিশ্বমুসলিমের মাঝে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর হয় এবং মুসলিম দেশসমূহের সাথেও সম্পর্কের আরো উন্নতি ঘটে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা যদি মহানবী (সা.) প্রচারিত মানবপ্রেম ও মানুষের মর্যাদার শাশ্বত মূল্যবোধ মানবসমাজে সঞ্চারিত করতে পারি, তাহলে তা থেকে চলমান সমস্যাদির যথোপযুক্ত সমাধানে মুসলিম জনসাধারণ সুস্পষ্ট অবদান রাখতে পারবে। এসব মূল্যবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে শান্তি ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে আমরা একটি নতুন আন্তর্জাতিক ঐতিহ্য গড়ে তুলতে পারি।
’উপরিউক্ত আলোচনার ফলশ্রুতিতে আমরা কাউকে হেয় না করেও বলতে পারি যে, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ ও বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ইসলামের কল্যাণে যেসব কার্যসূচি সম্পন্ন হয়েছে‒ তা স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সত্যিকার অর্থেই অতুলনীয়।