যে দীপ্তশিখা বঙ্গবন্ধু জ্বালিয়ে গেছেন

পারভিন আক্তার
নশ্বর এই পৃথিবীতে নিজ কর্মে অবিনশ্বর হওয়াদের তালিকা খুব বেশি বড় নয়। তাঁদের মধ্যেই এমন একজন শিল্পী যিনি বিশ্ব ক্যানভাসে এঁকেছেন বাংলাদেশের মানচিত্র, বাঙালির অহংকারের সবচেয়ে বড় রত্নপাথর, অসংজ্ঞায়িত ও অবর্ণনীয় সে ব্যক্তিত্বের মূল্যায়নে এ কলম ধরা নিতান্তই কম। তিনি রাজনীতির কবি, ইতিহাসের সুনিপুণ কর্মকার, স্বপ্ন ফোটানোর এক মালী, ভালোবাসার চাষা, জাতিকে এক সুতায় বুনে তোলা নিখুঁত দর্জি, তিনি বাংলার বন্ধু, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি ভাষণ, উচ্চারণই সারগর্ভ, দিকনির্দেশনামূলক হলেও শুধু ৭ মার্চের ভাষণের কারণেই তাঁকে অবলীলায় 'রাজনীতির কবি (পলিটিক্যাল পয়েট)' আখ্যা দেওয়া যায়। যতটা কাব্যিক, ঠিক ততটাই কূটনৈতিক (ডিপ্লোম্যাটিক) সে ভাষণের প্রতিটি বাক্য যেন দেশকে ভালোবাসার এক দুর্লভ পঙ্‌ক্তিমালা, আমাদের চেতনার বীজমন্ত্র। ব্যক্তিক বিশ্নেষণে মনে সব সময় একটি প্রশ্ন উঁকি দেয় বৈকি, কে দিতে পারে এমন উদাত্ত আহ্বান? কে তাঁর সম্প্রসারিত দুই বাহুর আলিঙ্গনে গোটা জাতিকে এক করে দিতে পারে? এ ব্যাপারে কারও দ্বিমত নেই যে, বঙ্গবন্ধুর ভাষণই বাঙালির রক্তে নাচন তৈরি করেছিল। হ্যাঁ, বাঙালি স্বাধীনতাপিয়াসু ছিল ভেতরে ভেতরে সব সময়ই, তবে সেই ইচ্ছাশক্তিকে সাংগঠনিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যমুখী করে তুলেছিলেন বাস্তববাদী চিন্তার সেই মহান মানুষটা। দীর্ঘ সংগ্রামের পর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল পূর্ণ নির্দেশনার প্রতিরূপ। অধিকার বিসর্জন দিয়ে, শৃঙ্খলতা মেনে নিয়ে পেছনে ফেরার উপায় আমাদের ছিল না; আবার সামনে দাঁড়ানোর মতো অস্ত্র, গোলাবারুদ আর প্রশিক্ষণও যথেষ্ট ছিল না। ছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সম্মোহনী ক্ষমতা, যা প্রত্যেক বাঙালিকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে তাদের মনে মুক্তির বীজ প্রোথিত করেছিল, মুষ্টিবদ্ধ করে তুলেছিল স্বাধীনতার স্বাদ নেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে। তাঁর প্রবল বিশ্বাস ছিল, দুর্বার যে আন্দোলন হৃদয় দিয়ে গড়ে তোলা হয় তা বাঙালিকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলবে আর অপশক্তির হার তাতে নিশ্চিত। 'রক্ত যখন দিয়েছি, আরও দিব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব'- নির্ভীক বাঙালির ছায়া পড়েছিল এ উদাত্ত কণ্ঠে। ইতিহাসে এটা রাজনৈতিক ভাষণ হলেও এর উজ্জীবন ক্ষমতা বহুমাত্রিক এবং বিশ্বমাত্রিক। স্থান, কাল, পাত্রভেদে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির সে উচ্চারণ আজ সকল মানুষের বিপ্লবের শৈল্পিক উচ্চারণও বটে। এ কারণেই জাতিগত সীমানার বাইরে বঙ্গবন্ধু আজ বিশ্বমানব, যাঁর কালজয়ী সে উচ্চারণের বিস্তৃতি কাল থেকে কালান্তরে...।

সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি দেশ। বিধ্বস্ত দেশের সঙ্গে স্বজন হারানোর ক্ষত, বেসামাল জাতিকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে উন্নয়নের পথে মাথা তুলে দাঁড়ানোই ছিল তখন বঙ্গবন্ধুর সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সে জন্যই প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি হাতে নিয়েছিলেন যুগোপযোগী সব পরিকল্পনা। স্বল্পতম সময়ে একটি সংবিধান প্রণয়ন, আইন, বিচার ও শাসন বিভাগের সুসমন্বয় সংঘবদ্ধ জাতির যা পূর্বশর্ত। অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতেই কৃষি নির্ভরতায় জোর দিয়েছিলেন সর্বোচ্চ। ভূমি ব্যবস্থাপনার জটিলতা এড়িয়ে কৃষি শস্যক্ষেত্রে উৎপাদনের গতিধারা অব্যাহত রাখতে এলাকাভিত্তিক সমবায় সমিতির ধারণা তাঁরই জ্ঞানপ্রসূত ছিল। উন্নয়নের লক্ষ্যে সে সময় গৃহীত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাই বর্তমান পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সূতিকাগার। শিক্ষা ব্যবস্থায় সুদূরপ্রসারী বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গঠনের মানসে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন যথেষ্ট ইতিবাচক ছিল বলেই হয়তো সময়ের ব্যবধানেও তার যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে এবং এখনও বুদ্ধিজীবীরা তার অংশবিশেষ বাস্তবায়নের দাবিতে মুখর থাকেন। উন্নয়নের প্রশ্নে প্রশাসনিক জটিলতা তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি, স্বাধীনতা-উত্তর বক্তৃতাগুলোতে সেই চাপা কষ্ট এবং ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ স্পষ্ট। আইনের সমতার পাশাপাশি নিরপেক্ষ শ্রেণি বৈষম্যহীন, অর্থনীতিতে সমৃদ্ধিশালী, সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধে জাগ্রত এক জাতি গঠনে তিনি যেখানে ছিলেন সংকল্পবদ্ধ, সেখানে রাজনৈতিক অপশক্তি যারা যুদ্ধকালীন দেশের বিরোধিতা করেছিল তারাই ক্ষমতালোভী হয়ে ওঠে। ব্যক্তিগত ঘৃণ্য লালসা চরিতার্থ করার জন্যই বঙ্গবন্ধুকে প্রকৃত সহযোগিতার পরিবর্তে ব্যর্থ প্রমাণের চেষ্টায় লিপ্ত হয়। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় বঙ্গবন্ধু যে কতটা সার্থক ছিলেন স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরে এসেও তাঁর পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের সময়োপযোগিতা সেটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে।

মৃত্যুঞ্জয়ী শেখ মুজিব। বিশেষ মানুষ মাত্রই অশেষ মানুষ। দীর্ঘায়ু অমরত্বের পূর্বশর্ত ছিল কবে? কাউকে ছোট করতে হলে নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে তার ওপরে নিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই। মৃত্যু তো অমোঘ নিয়তি, দৈহিক অনুপস্থিতিতে তার আদর্শের দিগন্তজোড়া বিস্তৃতি কালান্তরে যে সে মানুষটিকে মৃত্যুহীন করে তুলতে পারে সেটা বোঝার মানসিক সক্ষমতা বোধ করি ষড়যন্ত্রকারীদের ছিল না, নেই। তাই তো বঙ্গবন্ধুর খুনি হয়ে প্রকারান্তরে মহাকালের পাতায় নিজেদের ক্ষুদ্রত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাঙালি আমৃত্যু শোকবিলাসী হবে তার এই শ্রেষ্ঠ সন্তানটির জন্য, তাঁর আদর্শের জয়োৎসবে প্রত্যেক বাঙালি হয়ে উঠবে একেকজন শেখ মুজিবুর রহমান। টুঙ্গিপাড়ার মাটিতে তাঁর দেহ নিঃশেষে মিশে গেলেও বাংলার মাটিতে তিনি যে ভালোবাসার বীজ বুনে গেছেন তা বিকশিত হবেই মহাকাশের সীমানায়।


উত্তর প্রজন্মে মুজিব- মহানায়কের আদর্শ হোক আগামীর নায়কদের আদর্শ। মানুষ, মানবতাকে সবার আগে রেখে লিপিবদ্ধ হোক আজকের শপথ। শৈল্পিক প্রতিরোধে জ্বলে উঠুক দেশের যে কোনো প্রয়োজনে, প্রতিষ্ঠিত হোক অখণ্ড প্রকৃত ইতিহাস চর্চার ন্যায়সংগত অধিকার। স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, অংশগ্রহণের বিরল সুযোগ থেকে বিরত, কিন্তু তার পূর্বপুরুষদের বীরত্বগাথায় তার উত্তরাধিকার সুনিশ্চিত। সে অহংকার মনে ধারণ করা, বাহক হয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে পরিশুদ্ধ ইতিহাস জানার অধিকার তারা রাখে। চিন্তার স্বাধীনতা ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা ভবিষ্যৎ জাতি গঠনের পূর্বশর্ত। চিন্তার স্বাধীনতার বলয়ে মুক্তচিন্তা তখনই সম্ভব যখন চিন্তাগুলো ষড়যন্ত্রকারীদের হিংসাবৃত্তির প্রভাবমুক্ত হয়ে ইতিবাচক মানুষ গঠনে ইতিহাসের গণমুখী চর্চায় রূপ নেবে। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি নির্দেশ, বাণী বিজ্ঞানভিত্তিক চর্চা প্রয়োজন।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন সমন্বিত রাজনীতিবিদ, কোনো একমুখী চিন্তায় তাঁকে মূল্যায়ন করা অনুচিত, অন্যায্য, অর্থহীন। যে সূর্য উদিত হয়েছে অস্তাচল তার অমোঘ নিয়তি। কিন্তু তার প্রখর সূর্যালোক পাতায় ভর করে যে মহিরুহ তৈরি করে তাতে সূর্যের অস্তিত্ব চিরকালের। তেমনি বাঙালির অস্তিত্ব যতদিন, ততদিন বঙ্গবন্ধু অমলিন। তাঁকে, তাঁর আদর্শকে ধারণ করে আমরা সূর্যস্নানের মতো দেশপ্রেমের পবিত্রতায় সিক্ত হই প্রতিনিয়ত। বেঁচে থাকুক তাঁর আদর্শ, দেশপ্রেমিকের নির্মলিন মশালে/শিখায়...।

আইনজীবী

SUMMARY

2805-২.jpg