স্বাধীন দেশে জাতি ও রাষ্ট্রগঠন যেভাবে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু

- শেখ আদনান ফাহাদ  

ভারতবর্ষে ১৮৫৭ সালে সিপাহী-জনতার সম্মিলিতে স্বাধীনতা সংগ্রাম নানা কারণে সফল হয়নি। শেষ দিকে এসে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জনের প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পারেননি। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হলেও একে ঠিক স্বাধীনতা ‘অর্জন’ বলা যায় না। ইয়াসির আরাফাত ফিলিস্তিনের মজলুম মানুষগুলোর জীবনে শান্তি আনতে পারেননি; সাম্রাজ্যবাদী শক্তির শঠতা, কপটতার কাছে হার মেনেছেন। বিশ্বের নানা দেশে, স্থানে অনেক জাতি মুক্তির জন্য লড়াই করছে। কিন্তু সফল হতে পারছেনা। এখানেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের বিশালত্ব নিহিত।

পাকিস্তান আমলের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে সঠিক অবস্থান নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েমের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে চূড়ান্তভাবে জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে শামিল করে রাষ্ট্র কায়েমে সফল হয়ে টুঙ্গিপাড়ার মুজিব হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের বাঙালি জাতির জনক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, স্থানীয় দোসরদের সশস্ত্র যুদ্ধে পরাজিত করে বাঙালি জাতি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এর জন্মগল্পের প্রধান চরিত্র তাই নিঃসন্দেহে বঙ্গবন্ধু।
 
অবিরাম সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি পুরো জাতিকে স্বাধীনতার দিকে আহ্বান করতে পেরেছিলেন। বিশ্ব ইতিহাসে বাংলাদেশ ছাড়া সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র হল এমন একটি দেশ যেটি সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে।বঙ্গবন্ধুর মাপের নেতা বিশ্ব ইতিহাসে খুব বেশী আছে বলে জানা নেই। কিউবার মানবতাবাদী নেতা মরহুম ফিদেল ক্যাস্ট্রো ১৯৭৩ সালে আলজিরিয়ায় অনুষ্ঠিত ‘জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন’ এর সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ পেয়ে, তাঁর ব্যক্তিত্ব দেখে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘‘আমি হিমালয় দেখিনি। তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়ের সমান। এভাবে আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতাই লাভ করলাম।’ কত বড় নেতা আমরা পেয়েছিলাম সেটি আমরা সবাই অনুধাবন করতে পারিনা। কী পেয়ে কী হারালাম, যদি আমরা অনুধাবন করতে পারতাম আর তাঁর আদর্শ জীবনের সবক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করতে পারতাম তাহলে আমরাই হতাম বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ জাতি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর কর্মকাণ্ড, আন্দোলন, সংগ্রাম, ভাষণ-বক্তৃতার মাধ্যমে একটি অনন্য রাজনৈতিক আদর্শের জন্ম দিয়েছেন, যাকে আমরা ‘মুজিববাদ’ বলে অভিহিত করতে পারি। আমরা পুঁজিবাদ কিংবা মার্কসবাদ নিয়ে কথা বলি। বাংলাদেশের জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের জন্য কার্যকর হবে, এমন একটি পরিষ্কার ও স্বতন্ত্র আদর্শের জনক তিনি। আজ এতগুলো বছর পরে, আমাদের ভোগবাদী মানসে অনেকের কাছেই এই আদর্শের অনন্যতা বুঝে উঠা সম্ভব হচ্ছেনা।
 
পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বদেশে ফিরে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক ভাষণেই তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের রূপরেখা বাতলে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দিতে চাই যে, আমাদের দেশ হবে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক দেশ’। এদেশের কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সবাই সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে’।

সহজ তর্জমায় আমরা বলতে পারি, রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন গণতন্ত্র আর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে চেয়েছিলেন সমাজতন্ত্র কায়েম করতে। কার্ল মার্কস ধর্মকে‘আফিম’ বলে বর্ণনা করে ধর্মের কাছে আত্মসমর্পণকে নিরুৎসাহিত করলেও বঙ্গবন্ধু সে পথ অবলম্বন করেননি। বাংলাদেশের সমাজে ধর্মের গভীরতা ও অনিবার্যতা অনুধাবন করে তিনি বিশেষ অর্থে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে রাষ্ট্র ও জাতিগঠন কাজের চার মূলনীতির একটি হিসেবে সংবিধানে সন্নিবেশিত করেছিলেন। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বলতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কী বুঝতেন সেটা জানা দরকার। ১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল তারিখে গনপরিষদের অধিবেশনে বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘ ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে; মুসলমান তার ধর্ম পালন করবে, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ যে যার ধর্ম পালন করবে। কেউ কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না, বাংলার মানুষ ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ চায়না। রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবেনা। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ধর্মকে বাংলার বুকে ব্যবহার করতে দেওয়া যাবেনা। যদি কেউ ব্যবহার করে, তাহলে বাংলার মানুষ তাকে প্রত্যাঘাত করবে, এ আমি বিশ্বাস করি’।
 
গণপরিষদ অধিবেশনের এই ভাষণে সংবিধানের চার মূলনীতির অন্যতম ‘জাতীয়তাবাদ’ এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের আদর্শ পরিষ্কার হয়ে রয়েছে। এই পরিষ্কার আদর্শের ভিত্তিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এবং সে আদর্শের ভিত্তিতে এদেশ চলবে। জাতীয়তাবাদ- বাঙালি জাতীয়তাবাদ-এই বাঙালি জাতীয়তাবাদ চলবে বাংলাদেশে। বাংলার কৃষ্টি, বাংলার ঐতিহ্য, বাংলার আকাশ-বাতাস, বাঙালির রক্ত দিয়ে বাংলার জাতীয়তাবাদ’।

রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে ‘গণতন্ত্র’ আর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে ‘সমাজতন্ত্র’ কীরূপ হবে , সেটাও পরিষ্কার করে বলেছিলেন জাতির জনক। তিনি বলেন, ‘ আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, জনসাধারণের ভোটের অধিকারকে বিশ্বাস করি। আমরা বিশ্বাস করি সমাজতন্ত্রে, যেখানে শোষণহীন সমাজ থাকবে। শোষক-শ্রেণী আর কোনোদিন দেশের মানুষকে শোষণ করতে পারবেনা। এবং সমাজতন্ত্র না হলে সাড়ে সাতকোটি মানুষ ৫৪,০০০ বর্গমাইলের মধ্যে বাঁচতে পারবেনা। সেইজন্য অর্থনীতি হবে সমাজতান্ত্রিক,’।
মানুষের উপর জাতির জনক কী পরিমাণ আস্থা-বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন, তার একটা পরিচয় আমরা গণপরিষদ অধিবেশনে রাখা ভাষণের একটা অংশ থেকে পেতে পারি। তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘ শাসনতন্ত্র দেওয়ার পরে দেশে নির্বাচন হবে, তাতে আওয়ামী লীগকে মানুষ ভোট না দেয়, না দেক, যাঁদের ভোট দিবে, তাঁরাই ক্ষমতায় আসবেন-এতে আপত্তির কিছুই থাকবেনা। তাঁদের সাদরে গ্রহণ করা হবে’।

দলের নেতা-কর্মী ও আপামর জনসাধারণকে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির উপাদান ও চরিত্র অর্থাৎ এ ব্যবস্থায় মালিকানা, পুঁজি ও শ্রমের ধরণ বোঝাতে বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর আগে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের জনসভার ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করা হবে। শোষকদের আর বাংলাদেশে থাকতে দেয়া হবেনা। কোন ভুঁড়িওয়ালা এদেশে সম্পদ লুটতে পারবেনা। গরীব হবে এই রাষ্ট্র এবং এই সম্পদের মালিক, শোষকরা হবেনা’। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির একটা বড় উপাদান হল সমবায়। জনগণকে সমবায়ে উদ্বুদ্ধ করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সেদিন বলেছিলেন, ‘ আপনারা পারস্পরিক সহযোগিতা দিয়ে এগিয়ে আসুন। পাশের লোকেরা যদি ঘরবাড়ি না থাকে আপনারা সকলে মিলে সাহায্য করে তার ঘরবাড়ি করে দেবেন। পয়সা নেই সরকারের, আপনাদের নিজেদের করতে হবে, রক্ত দিয়ে এদেশ গড়তে হবে। মরুভূমিকে নতুন করে সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা করে গড়ে তুলতে হবে’।

১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ বেতার ও টেলিভিশনে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষে মানুষে ব্যক্তিতে বৈষম্য থাকবে না। সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থায় সমতা আনতে হবে। নিম্নতম আয়ও নিম্নতম উৎপাদনের ক্ষেত্রে যে আকাশচুম্বী বৈষম্য এতদিন ধরে বিরাজ ছিল তা দূর করার ব্যবস্থাদি উদ্ভাবনের জন্য আমি একটা বিশেষ কমিটি গঠন করার কথা বিবেচনা করছি’।
 
একটি ‘শোষণ অবিচারমুক্ত’ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করতে বঙ্গবন্ধু সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ব্যাংকসমূহ বিদেশি ব্যাংকের শাখাসমূহ বাদে সাধারণ ও জীবন বীমার কোম্পানিসমূহ বিদেশি বীমা কোম্পানি ও শাখাসমূহ বাদে, সকল পাটকল, সকল বস্ত্র ও সুতাকল, সকল চিনিকল, আভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় নৌযানের বৃহৎ অংশ, ১৫ লাখ টাকা মূল্যের অনূর্ধ্ব সকল পরিত্যাক্ত অনুপস্থিত মালিকানাভুক্ত সম্পত্তি বাংলাদেশ, বিমান ও বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনকে সরকারি হিসেবে স্থাপন করা হয়। সমগ্র বহির্বাণিজ্যকে রাষ্ট্রীয়করণের লক্ষ্য নিয়ে সাময়িকভাবে বহির্বাণিজ্যের বৃহৎ অংশকে তখন রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।

চাষীদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর দরদ ছিল আকাশসম। তিনি বিশ্বাস করতেন, চাষী সমাজ ভালো থাকলে, বাংলাদেশ ভালো থাকবে। তাইতো সে কঠিন সময়েও সুদূরপ্রসারী কল্যাণের কথা ভেবে ২৫ বিঘার কম জমি আছে এমন চাষীদের খাজনা চিরদিনের জন্য মওকুফ করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এর আগেই সমস্ত বকেয়া খাজনা মাফ করে দেয়া হয়। তাকাভি ঋণ বাবদ ১০ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়, ১৬ কোটি টাকার টেস্ট রিলিফ বিতরণ করা হয়, লবণের উপর থেকে কর তুলে নেয়া হয়। সারাবছর ধরে সেচের কাজ চালানো, উন্নতমানের বীজ বপন, সার কীটনাশক ওষুধ, সব চাষীকে পর্যাপ্ত ঋণদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে ঠাকুরগাঁওয়ে এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ আমার বড় বড় কলকারখানা, ব্যক্তিগত সম্পত্তি যা ছিল সেগুলোকে জাতীয়করণ করে সাত কোটি লোকের সম্পত্তি করেছি। যতগুলো চটকল ছিল সব এখন বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের সম্পত্তি। আমি জাতীয়করণ করে বাংলার মানুষকে দিয়েছি। ফসল উৎপাদন করেন, চেষ্টা করেন’।

একটি স্বাবলম্বী অর্থনীতির মালিক হতে হলে যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে সেটিও শক্তভাবে বলে গেছেন জাতির জনক। ১৯৭২ সালের ৫ এপ্রিল বাংলাদেশ বেতারে ‘দেশ আমার মাটি আমার’ অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘বৎসরে ত্রিশ লক্ষ লোক আমার নতুন বাড়ে। আজকে আমাদের পপুলেশন প্ল্যানিং করতে হবে। পপুলেশন কন্ট্রোল করতে হবে। না হলে বিশ বৎসর পরে ১৫ কোটি লোক হয়ে যাবে ২৫ বছর পরে। ৫৪ হাজার স্কয়ার মাইল বাঁচতে পারবেনা। যেই ক্ষমতায় থাকুক বাঁচার উপায় নেই। একটা পপুলেশন কন্ট্রোল আমাকে করতেই হবে।…প্রোডাকশন বাড়াতে হবে।, না হলে মানুষ বাঁচতে পারবেনা এবং বাঁচার জন্য তাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ হতে হবে। বিশৃঙ্খল জাতি কোনদিন বড় হতে পারেনা’।
 
ঠাকুরগাঁও এর ভাষণে পরবর্তী পাঁচ বছর কীভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি সুগঠিত হবে, সে পরিকল্পনা ব্যক্ত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বলেছিলেন, ‘ গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ করা হবে। ৫ বৎসর প্ল্যানে বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামে একটা করে কো-অপারেটিভ হবে, প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে। এই কো-অপারেটিভে জমির মালিকের জমি থাকবে। কিন্তু তার অংশ বেকার প্রত্যেকটা মানুষ। যে মানুষ কাজ করতে পারে, তাকে সেই কো-অপারেটিভের সদস্য হতে হবে এবং বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। আলটিমেটলি ৬৫ হাজার ভিলেজে একটা করে কো-অপারেটিভ করা হবে। তা না হলে দেশকে এগুনো যাবেনা। আপনার জমির ফসল আপনি নিবেন। একটা অংশ যাবে কো-অপারেটিভে, ঐ অংশ গভর্নমেন্টের হবে। দ্বিতীয় অংশে থানায় থানায় একটি করে কাউন্সিল হবে’।

বাংলাদেশের ‘সমাজতন্ত্র’ নিয়ে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৭ জুন রেসকোর্স ময়দানে দেয়া এক ভাষণে মহাশক্তিশালী এক মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ বাংলার বুকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ থাকবে। এ হলো আমার এক নম্বর স্তম্ভ। দ্বিতীয় স্তম্ভ, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। এ সমাজতন্ত্র দুনিয়া থেকে ভাড়া করে আনতে চাইনা। এ সমাজতন্ত্র হবে বাংলার সমাজতন্ত্র। এ সমাজতন্ত্র বাংলার মানুষের সমাজতন্ত্র, তার অর্থ হলো শোষণহীন সমাজ, সম্পদের সুষম বণ্টন। বাংলাদেশে ধনীদের আমি আর ধনসম্পদ বাড়াতে দেবনা। বাংলার কৃষক, মজদুর, বাংলার বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক এদেশে সমাজতন্ত্রের সুবিধা ভোগ করবে’।

সমাজে ধনী-গরীবের বৈষম্য কমাতে জাতির জনক ১০০ বিঘার উপরে কারো জমি থাকলে, তা কেড়ে নিয়ে সমাজের গরীব মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন
ভূমিব্যবস্থা, উৎপাদন পদ্ধতি নিয়ে ১৯৭৩ সালের ৪ জানুয়ারি উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীতে দেয়া এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ ভাই বোনেরা আমার, আমি আপনাদের কৃষক ভাইদের জন্য ২৫ বিঘা জমির খাজনা মাফ করে দিয়েছি। ক্ষমতায় বসার প্রথম দিনে বকেয়া খাজনার সুদসহ মাফ করেছি। ৪ লক্ষ ৬৫ হাজার একর জমি যা খাস মহলের জমি ছিল যেখানে আপনাদের আগে সেলামি দিতে হতো, সেলামি দেওয়া লাগবে না, তাদের মধ্যে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হবে সেলামি বাদে। আর যার ১০০ বিঘার উপর জমি আছে গরীবের মধ্যে বের করে এনে বিলিয়ে দিতে হবে’।

রাজনীতিবিদ, আমলা ও অন্যান্য শিক্ষিত মানুষদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন জাতির পিতা। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, দুর্নীতি রোধ করতে না পারলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তি আসবেনা। ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার শক্ত অবস্থান ব্যক্ত করে বলেছিলেন, বাংলার কৃষক, বাংলার দুঃখী মানুষ এরা কিন্তু অসৎ নয়, ব্লাক মার্কেটিং করে কারা? রাগ করবেন না। আপনারা শিক্ষিত, বুদ্ধিমান, চিন্তাশীল, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় আছেন, আপনারা রাগ করবেন না। ব্লাক মার্কেটিং কারা করে? যাদের পেটের মধ্যে দুই কলম বিদ্যা হয়েছে তারাই ব্লাকমার্কেটিং করে। স্মাগলিং কারা করে? যারা বেশী লেখাপড়া শিখছে তারাই করে। হাইজাকিং কারা করে? যারা বেশি লেখাপড়া শিখছে তারাই করে। ইন্টারন্যাশনাল স্মাগলিং তারাই করে। বিদেশে টাকা রাখে তারাই। আমরা যারা শিক্ষিত, আমরা যারা বুদ্ধিমান, ঔষধের মধ্যে ভেজাল দিয়ে বিষাক্ত করে মানুষকে খাওয়াই। নিশ্চয়ই গ্রামের লোক এসব পারে না, নিশ্চয় আমার কৃষক ভাইরা পারে না। নিশ্চয় আমার শ্রমিক ভাইরা পারে না। পেটের মধ্যে যাদের বুদ্ধি বেশি আছে তারাই ব্লাক মার্কেটিয়ার। আর বিদেশী এজেন্ট কারা হয়।  নিশ্চয়ই আমার কৃষক নয়, নিশ্চয়ই আমার শ্রমিক নয়। আমরা যারা লেখাপড়া শিখি, গাড়িতে চড়ি, বিদেশে যাবার পারি, বিদেশিদের সঙ্গে মিশতে পারি, ভাল স্যুট পড়তে পারি, তারাই বাংলার মানুষের বিরুদ্ধে বিদেশের এজেন্ট হয়। বাংলার মাটিতে জনমত সৃষ্টি করতে হবে- দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর ও শোষকদের বিরুদ্ধে। আমি বিশ্বাস করি তাহলে বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতি উঠে যাবে’।
 
দেশের পুরো শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে জাতির পিতার ভাবনা ছিল যুগান্তকারী। শুধু সনদ-নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা যে সমাজে বেকারত্ব বাড়াবে সেটি স্বাধীনতার পরপরই বলে গিয়েছেন জাতির পিতা। ১৯৭৩ সালের ১১ নভেম্বর ঢাকায় দেওয়া এক ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘ উৎপাদন মাঠে, কলে-কারখানায়, ক্ষেতে, খামারে আপনাদেরই করতে হবে। আর এই যে আমাদের আইএ, বিএ পড়া হয় এটা বন্ধ করে দিয়া টেকনিক্যাল এডুকেশন করতে হবে। সেজন্য আমরা এডুকেশন কমিশন করে দিয়েছি। পে-কমিশনের রিপোর্ট বের হলে দেশকে যে শিক্ষায় সমাজতন্ত্র করা যায় সেই শিক্ষায় বাংলাদেশ করতে হবে। অন্য কোনো শিক্ষা এখানে হতে পারে না’।

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় জাতির পিতার ছিল পরিষ্কার ভাবনা। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর স্পিকার মুহম্মদুল্লাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংবিধান বিল (গৃহীত) এর উপর দেয়া ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা এমন শাসনব্যবস্থা কায়েম করব, যেখানে প্রকাশ্য আদালতে বিচারের ব্যবস্থা থাকবে’।

দেশের স্বাস্থ্যখাত নিয়ে জাতির পিতার দারুণ সব ভাবনা ও পরিকল্পনা ছিল। গ্রামের গরীব মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য তিনি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন শুরু করেছিলেন। একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামে বড় বড় ডাক্তার পাঠিয়ে মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন তিনি। ১৯৭২ সালের ৯ অক্টোবর ঢাকার তৎকালীন পিজি (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি) হাসপাতালে দেওয়া এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ যখন ছুটি দেওয়া হবে, যে বড় ডাক্তাররা আছেন, যারা স্পেশালিষ্ট তারা গ্রামের দিকে কেন যাবেন না। গ্রামে তো শতকরা ৯৫ জন লোক বাস করে। তারাই তো সম্পদ দিয়ে আপনাদের সবকিছু দেখেছে। নতুন শহর দেখেন, আপনাদের দোতলা অফিস দেখেন, যেখানেই যান সব কিছু বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের পয়সায়। তাদের দিকে কেন নজর দিবেন না?’।
 
নার্সদের অতি সম্মানের আসনে বসিয়েছিলেন জাতির পিতা। সেদিন সে ভাষণে, তিনি বলেছিলেন, ‘ আমাদের নার্সরুম, আমাদের সমাজের জন্য এটা আমি বুঝতে পারি না যে, এ সমাজ কী করে বাঁচবে? একটা মেয়ে দেশের খাতিরে নার্সের কাজ করেছে তার সম্মান হবে না। আর ভাল কাপড় ঘুরে বেড়ায় তার সম্মান হবে। চেয়ারটা তাকে দেওয়া হবে। এই জন্য আমাকে নার্সিং শিক্ষার নার্সিং যে কাজগুলো আছে সেগুলো একটা উচ্চপর্যায়ে নিতে হবে এবং এর উপর একটা কোর্স থাকতে হবে। আমি ডাক্তার সাহেবদের সাথে পরামর্শ করেছিলাম যে, ডাক্তার সাহেব আমাকে একটা প্ল্যান দেন। কী করে আমি ওদের গ্র্যাজুয়েট মেয়েদের এখানে আনতে পারি। কত বেতন দিলে তারা এখানে আসতে পারে, আইএ পাশ মেয়েরা আসতে পারে। আসতে হবে সেবার মনোবৃত্তি নিয়ে। এবং তাদের কোর্স হবে, ট্রেনিং হবে এবং তার পর তাদের চাকুরির একটা সিস্টেম থাকবে’।

বাংলাদেশের ফরেন পলিসি কেমন হবে সেটি ১৯৭২ সালেই নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন জাতির পিতা। ১৯৭২ সালের ৯ এপ্রিল ঢাকায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে সভাপতি হিসেবে ভাষণ প্রদানকালে বঙ্গবন্ধু নব্য স্বাধীন বাংলাদেশের সব শ্রেণী পেশার মানুষকে উদ্দেশ্য করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ আমাদের ফরেন পলিসি পরিষ্কার। আমরা কোন যুদ্ধ জোটে যোগদান করতে চাই না এবং করব না। আমরা সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে বাস করতে চাই, আমরা সহাবস্থানে বিশ্বাস করি। আমরা সাম্রাজ্যবাদ, কলোনিয়ালিজম  বিরুদ্ধে সংগ্রামে সবসময় আছি। আমরা দুনিয়ার দুঃখী মানুষ যেখানে সংগ্রাম করবে, তার পক্ষে বাংলাদেশ দাঁড়াবে। কারণ আমরা দুঃখী, আমরা কষ্ট সহ্য করেছি। আমরা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে স্বাধীনতা নিয়েছি। আমরা যেখানে দুনিয়ার মজলুম মানুষ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে আমরা নিশ্চয়ই তার পাশে গিয়ে দাঁড়াব’।

১৯৭২ সালের ৬ মার্চ রাশিয়া সফর শেষে ঢাকা বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু এক ভাষণ প্রদান করেন, সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘দুনিয়ায় শান্তি রক্ষার জন্য বাংলাদেশ-সোভিয়েত রাশিয়া পাশাপাশি কাজ করবে। স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের বিরোধী শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে জাতিকে বারবার সতর্ক করে গেছেন জাতির পিতা। ১৯৭২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় রাষ্ট্রীয় সফরে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেন, ‘ আমেরিকা, আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারলাম না। আর আপনাদের অনুরোধ করছি, আপনারা গণতন্ত্রের কথা বলেন, মুখে মুখে মেহেরবানী করে গণতন্ত্রের কথা না বলে, গণতন্ত্র যাতে চলে সেদিকে একটু খেয়াল রাখুন। দুনিয়ায় সাম্রাজ্যবাদের দিন চলে গেছে। ভারতবর্ষ আর বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদীদের খেলা চলবে না’।

পুলিশের চরিত্র কেমন হবে, সেটিও বলে গেছেন জাতির পিতা। ব্রিটিশ আর পাকিস্তান আমলের অত্যাচারী পুলিশবাহিনী যে স্বাধীন বাংলাদেশে থাকবে না সেটি পরিষ্কার ভাষায় বলেছিলেন তিনি। ১৭ জানুয়ারি, ১৯৭২ সালে প্রদত্ত এক বিবৃতি বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার একটি নয়া-পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এটি হবে গণ-পুলিশ বাহিনী; অতীতের ন্যায় এ বাহিনী ভয়-ভীতি ও নির্যাতন চালানোর হাতিয়ার হবে না।’
 
অর্থনীতি ও রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন এনে একটি স্বনির্ভর বাংলাদেশ নির্মাণের লক্ষ্যে পুরো আমলাতন্ত্রকে বদলে দিতে চেয়েছিলেন জাতির জনক। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মনোভাব বদলানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও মন্ত্রীপরিষদের সদস্যদের সমাবেশে প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘ সরকারি কর্মচারী ভাইয়েরা, আপনাদের জনগণের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করতে হবে এবং জাতীয় স্বার্থকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। এখন থেকে অতীতের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব পরিবর্তন করে নিজেদের জনগণের খাদেম বলে বিবেচনা করতে হবে। আমরা একটা আদর্শের জন্য সংগ্রাম করেছি। আমার সরকারের নীতিই হচ্ছে স্বাধীনতার সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া’।

সরকারি আমালারা যে মানুষের প্রভু নন, সেবক সেটি বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি। সংবিধান বিল (গৃহীত) এর উপর বঙ্গবন্ধু ভাষণ প্রদান করেন ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর। সেখানে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র নিয়ে শক্ত ভাষায় বলেছিলেন, ‘ কেউ কেউ বলেছেন যে, সরকারি কর্মচারীদের অধিকার খর্ব করা হয়েছে। তারা অন্যান্য দেশের শাসনতন্ত্রও পড়ুন। সরকারি কর্মচারীরা একটা আলাদা জাতি নয়। তারা আমাদের বাপ, আমাদের ভাই। তারা কোন ডিফারেন্ট ক্লাস নয়। ইংরেজ আমলে আইসিএস, আইপিএসদের প্রোটেকশন দেওয়া হত। সেই প্রোটেকশন পাকিস্তান আমলেও দেওয়া হত। আমলাতন্ত্রের সেই প্রোটেকশন এ আঘাত করেছি- অন্য জায়গায় আঘাত করিনি। এই ক্লাস রাখতে চাই না। কারণ শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাই, একটি ক্লাসলেস সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করতে চাই। আইনের চক্ষে সাড়ে সাত কোটি মানুষের যে অধিকার, সরকারি কর্মচারিদেরও সে অধিকার। মজদুর, কৃষকদের টাকা দিয়ে সরকারি কর্মচারীদের মাইনে, খাওয়া-পড়ার ব্যবস্থা করা হয়। সুতরাং মজদুর, কৃষকদের যে অধিকার, সরকারি কর্মচারীদের সেই অধিকার থাকবে। এর বেশি অধিকার তারা পেতে পারে না’।
 
নব্য স্বাধীন বাংলাদেশে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা বদলে দিয়ে জাতির পিতা নিজেদের একটা সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র আর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে সমাজতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। এই পুরো কাজে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারত তৎকালীন সংবাদমাধ্যম। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের একাংশের ভূমিকা ছিল উন্নয়নবিরোধী। জাতির পিতাকে দুর্বল করতে যেন বিশেষ যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল তৎকালীন কিছু সংবাদপত্র। বাংলাদেশে হলুদ সাংবাদিকতার শুরু সে সময় থেকেই। ইত্তেফাকের মত পত্রিকায় বাসন্তী নামে এক নারীর গায়ে মাছ ধরার জাল পড়িয়ে সরকার বিরোধী নিউজ করিয়ে মানুষের মনে চরম হতাশা সৃষ্টি করা হয় সে সময়। সংবাদমাধ্যমের ভূমিকার উপর খুব বিরক্ত ছিলেন জাতির পিতা। স্বাধীনতা পেয়ে এক শ্রেণির মিডিয়া মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের কাজকে কঠিন করে তুলেছিল।

১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের বার্ষিক অধিবেশনে জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘‘আমরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। এজন্য আপনাদের কোন কাজে কখনো কোন রকম হস্তক্ষেপ করি নাই। …কিন্তু গণতন্ত্রেও একটা মূলনীতি আছে। সাংবাদিকতারও একটি মূলনীতি আছে। স্বাধীন দেশে যথেচ্ছাচার চলতে দেয়া যায় না। স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার তারই আছে, যে স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষা করতে জানে। বিপ্লবের পরে ছ’মাসের মধ্যে আপনারা যতখানি স্বাধীনতা পেয়েছেন, ততখানি স্বাধীনতা এদেশে এর পূর্বে কেউ পায় নাই’’।

কিন্তু সংবাদমাধ্যমকে দেয়া স্বাধীনতা এক শ্রেণির সংবাদমাধ্যম গঠনমূলক কাজে ব্যবহার না করে রাষ্ট্রবিরোধী নানা ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের কাজে ব্যবহার করে। এর মধ্যে ঘটে যায় ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষ। রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে শেষ চেষ্টা হিসেবে বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক প্লাটফর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন বাকশাল। সংসদীয় ব্যবস্থার সরকার থেকে প্রবর্তন করা হয় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার।

SUMMARY

280-1.jpg