লন্ডনের পথে বঙ্গবন্ধু: বিদায় জানাতে এসে কাঁদলো জনতা

উদিসা ইসলাম
 
১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই অস্ত্রোপচারের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডনের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন। তিনি আসলে ঠিক কখন রওনা হবেন সে বিষয়ে কোনও ঘোষণা দেওয়া হয়নি। তবুও এদিন সকাল থেকে বিমানবন্দরে জনতার ভিড় লেগেছিল। বিকালে বঙ্গবন্ধু যখন বিমানবন্দরে পৌঁছালেন তখন চারিদিক বঙ্গবন্ধু ও তার মুজিববাদ নিয়ে স্লোগানে মুখর। বিমানের সিঁড়িতে উঠে একে একে বিদায় দিতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত বঙ্গবন্ধু বারবার হাত নেড়ে ভরসা দিচ্ছিলেন অশ্রুসজল জনতাকে। ১৯৭২ সালের ২৭ জুলাই প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকার খবরে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
রোগমুক্তির জন্য দেশবাসীর শুভকামনা ও ভালোবাসা সঙ্গে নিয়ে অসুস্থ বঙ্গবন্ধু চিকিৎসার জন্য লন্ডন যাত্রা করেন। সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী, সন্তান, ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও কয়েকজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থতাজনিত কারণে বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্যহানি ঘটে। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। দেশের চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে তার পিত্তকোষে পাথর জমেছে বলে অভিমত প্রকাশ করেন। অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দেন। তাই ২৬ জুলাই তিনি দেশবাসীর সঙ্গে বিচ্ছেদের বেদনা বুকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য যাত্রা করেন। এয়ার ইন্ডিয়ার ভাড়া করা বিশেষ বিমানে তাকে নিয়ে সরাসরি লন্ডনে যায়।

বিকালে ঢাকা বিমানবন্দরে মর্মস্পর্শী দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। বঙ্গবন্ধু ঢাকা ত্যাগের সময় সম্পর্কে আগে থেকে কোনও ঘোষণা না থাকলেও বিমানবন্দরে বিপুল লোক সমাগম হয়। সর্বস্তরের জনতার চোখেমুখে বিচ্ছেদ বেদনা সুস্পষ্ট ছাপ ফুটে উঠে। রাষ্ট্রপ্রধান বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরেন। বিমানের সিঁড়ি সরিয়ে নেওয়ার পরেও দীর্ঘক্ষণ ধরে বঙ্গবন্ধু নানাভাবে বারবার হাত নাড়িয়ে দেশবাসীকে অব্যক্ত অভয়বাণী দিতে থাকেন।


সেদিনের ওই মুহূর্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে দৈনিক বাংলা লিখছে, ‘অশ্রুসজল চোখ। কিন্তু তবুও নেতা জনতার প্রতি হাত আন্দোলিত করে মৃদু হেসেছিলেন। এসময় তার সঙ্গে অনেকেই কেঁদে ফেলেন। প্রায় দশ মিনিট বঙ্গবন্ধু বিমানের দরজার ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন। বিমানের দরজা সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়েছিলেন। দরজা সরিয়ে নেওয়ার আগে মহিলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর কদমবুচি করেন। তারা আড়ালে চোখ মুছতে মুছতে নেমে আসেন।’
কে ছিল না সেদিন

সেদিন সকালে বঙ্গবন্ধু ঢাকা ত্যাগ করার কথা থাকলেও বিশেষ কারণে তা বিলম্বিত হয়। সময় সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা না থাকলেও সকালে বিমানবন্দরে বিপুল সংখ্যক দর্শনার্থী ভিড় করে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যরা ছিলেন। এছাড়া জনসংযোগ অফিসার জনাব আবুল হাশেম, প্রাইভেট সেক্রেটারিসহ বেশ কয়েকজন কর্মচারী ছিলেন। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মন্ত্রিসভার সদস্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা একে একে সাক্ষাৎ করেন।
যাওয়ার আগে বেতারে বাণী

জাতির জনক প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিকিৎসার জন্য যাত্রার শুরুতে জাতির উদ্দেশে এক বাণীতে সব বিরোধ ভুলে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করার জন্য দল-মত জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের প্রতি আহ্বান জানান। বাংলাদেশ বেতার এবং বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার মাধ্যমে তিনি বলেন, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী তিনি চিকিৎসার উদ্দেশে বিদেশ যেতে বাধ্য হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, জনগণের আশীর্বাদ ও আল্লাহর রহমতে শিগগিরই আরোগ্য লাভ করে দেশের মাটিতে ফিরে আসবেন তিনি। তিনি বাণীতে বলেন, আমি যখন বাংলাদেশ গড়ার কাজে হাত দিয়েছি সেসময় চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে হচ্ছে। আমার বিশ্বাস আপনাদের দোয়ায় আল্লাহর রহমতে খুব শিগগিরই আরোগ্য লাভ করে দেশে ফিরে আসবো। বাংলাদেশের মানুষ হচ্ছে আমার প্রাণ, তাদের সুন্দর ও সুখী ভবিষ্যৎ হচ্ছে আমার সাধনা। তাই আমি আমার সমস্ত জীবন আপনাদের সেবায় উৎসর্গ করেছি। আসুন আমরা দল-মত জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে ভেদাভেদ ভুলে বাংলাদেশ গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করি। আপনারা আমাকে দোয়া করবেন।

সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : জুলাই ২৬, ২০২০ 

SUMMARY

2785-২.jpg