এন আই খান
গীতালি দাশগুপ্ত নাজিমুদ্দিন কলেজ থেকে বিএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এম এ প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছেন। খুলনার মানুষ আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ মহসিন সাহেবের বাসা ঢাকার লালমাটিয়ায়। তার তিন মেয়েকে পড়ানোর জন্য আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। গীতালি ২০ নম্বর ফুলার রোডের ড. ওয়াজেদ এর শিক্ষক পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ড. হিরণ্ময় সেনগুপ্ত বাসায় থাকেন। টিউশনির টাকা দিয়ে তার নিজের লেখাপড়া ভালোভাবেই চলছে। সে বঙ্গবন্ধু কেবিনেটের খাদ্যমন্ত্রী ফণীভূষণ মজুমদার এর ছোট ভাই হেমেন্দ্র দাশ গুপ্তর দুই ছেলে চার মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে। বাবা মাদারীপুরের স্কুল শিক্ষক। একদিন মহসিন সাহেবের স্ত্রী রওশন আরা গীতালি কে বললেন তোমার একটা নূতন টিউশনী হয়েছে। বেগম মুজিব তোমাকে তার বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে ফোন করেছিলেন; ছোট ছেলে রাসেল কে পড়াতে হবে। গীতালি মহাসিন সাহেবের স্ত্রী রওশন আরাকে কাকিমা বলে ডাকতেন। গীতালি বললেন "কাকিমা বেগম মুজিব কিভাবে আমাকে জানলেন?" তখন জানালেন উনার ভাই মোর্শেদ বঙ্গবন্ধুর স্ত্রীর কাছে আমার কথা বলেছেন। মোরশেদকে গীতালি মামা বলে ডাকতেন তিনি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাতায়াত করতেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বত্রিশ নম্বর বাড়িটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, মেরামত কাজ চলছে। তাই বঙ্গবনধু সপরিবারে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুগন্ধায় থাকতেন। এদিকে বেগম মুজিব শেখ রাসেলের জন্য একজন উপযুক্ত গৃহশিক্ষিকা খুঁজছেন। একদিন রওশন আরা গীতালিকে বলল তোমাকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রাস্তার ৬৭৭ নম্বর বাসায় যেয়ে বেগম মুজিবের সাথে দেখা করতে হবে।
১৯৭২ সালের আগস্ট মাসের কোন এক সময়ে মিসেস মহাসিন গীতালিকে ধানমন্ডি ৩২ এর ৬৭৭ নম্বর বাসায় নিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর বেগম মুজিব এসে গীতালিকে বললেন তার ছেলে শেখ রাসেলকে প্রতিদিন ১ ঘন্টা পড়াতে পারবেন কিনা। গীতালি তখন একুশ বছরে পা দিয়েছে। মহসিন সাহেবের তিনটি মেয়েকে পাড়াচ্ছেন। সে জানালো যে, অলরেডি তিনজনকে পড়াচ্ছেন। তাছাড়া তার নিজের পড়া তো আছে। বেগম মুজিব আবারও বললেন আধা ঘন্টার জন্য পড়ানো সম্ভব কিনা। সময়ের অভাব হলে ১৫ মিনিট। বেগম মুজিব বললেন মহাসিন সাহেবের মেয়েকে পড়ানোর পর এসে পড়াতে। গীতালি রাতে পড়িয়ে বাসায় ফিরে যাওয়ার অসুবিধার কথা বললো। বেগম মুজিব বললেন যাওয়ার জন্য আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। তখন সে পড়ানোর জন্য রাজি হয়ে গেল।
মহসিন সাহেবের তিন মেয়েকে পড়িয়ে সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাসেলকে পড়ানো শুরু হয়ে গেলো। পড়ানো শেষ হলে ড্রাইভার 'মুন্সি' ফুলার রোডের বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসতো। এমনিভাবে ৮ দিন কেটে গেল; ৯ দিনের মাথায় রাসেল তার বই ছুড়ে ফেলে দিল। বই ছুড়ে ফেলার পর রাসেল বলল আপনি তো রাগ করছেন না। গীতালি বললো তোমার বই তুমি ফেলেছো। আমার বই তো ফেলনি, আমি কেন রাগ করব? তারপর আস্তে আস্তে মায়ার বন্ধনে একে অপরের সাথে জড়িয়ে গেল। রাসেল যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি স্কুলে ভর্তি হয়েছিল তখন গীতালি কে বলতো প্রতিদিন স্কুলে এসে তাকে দেখে যেতে। গীতালি দূর থেকে উঁকি দিয়ে যেত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষক দুর্গাদাস ভট্টাচার্যের স্ত্রী সাবিত্রী ভট্টাচার্য গীতালি কে চিনতেন। তিনি বিষয়টি লক্ষ্য করেছেন ভেবেছেন গীতালি কোন প্রেমিকের সাথে এভাবে ইশারায় কথা বলে, চোখাচোখি করে। একদিন রসিকতা করে বলেই ফেলল "কার সাথে প্রেম করছেন?"। গীতালি তখন তাকে শেখ রাসেলের কথা খুলে বল্লো।
১৯৭৫ এর শোকাবহ ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সাবিত্রী ভট্টাচার্যের সাথে গিতালির দেখা হলে সেই পুরনো দিনের কথা স্মৃতিচারণ করছিলেন। তখনই দু'জনের চোখে পানি এসে গেল।
যাহোক ২৮ দিনের মাথায় বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা হ'ল। তার স্ত্রীকে বললেন কামালের মা তুমি এবার রাসেলের জন্য সঠিক মাসটর ( বঙ্গবন্ধু আদর করে গিতালিকে মাস্টারের বদলে মাসটর বলতেন) জোগাড় করেছো। আমার আর চিন্তা করতে হবে না। তুমি কি ওকে চেন? ও-তো দাদার ভাতিজি। দাদা অর্থাৎ ফণীভূষণ মজুমদার। ও-ই পারবে রাসেলকে পড়াতে
বঙ্গবন্ধু ১৯৬৯সালে ২২ শে ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েই মাদারীপুরে গিয়েছিলেন। তখন কিছুক্ষণ ফণিভূষণের বাড়িতে অবস্থান করে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। এ সময় বঙ্গবন্ধুকে একটি ফুলের মালা দেয়া হয়েছিল। গীতালি সে মালাটি গেঁথেছিল। বঙ্গবন্ধুর এত বছর পরেও সে বিষয়টি মনে ছিলো। তাই বেগম মুজিবকে এই তথ্যটি দিয়ে তাদের পরিচয় দিচ্ছিলেন। গীতালি হতবাক, আনন্দে গদগদ।
এমনি করে দিন গড়াতে গড়াতে ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট এসে গেল। গীতালি সন্ধ্যা সাতটায় ৩২ নম্বর রাস্তার ৬৭৭ নম্বর বাসায় সন্ধ্যা সাতটায় হাজির হলো। রাসেল নাই, বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী ও বাসায় নেই। আব্দুর রহমান রমা গীতালিকে বললো ৭.৩০মি. চলে আসবেন। কিছুক্ষণ পর বঙ্গবন্ধু এসে বেগম মুজিবের সাথে ফোনালাপে বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে গীতালীকে থাকতে বললেন। বললেন মাস্টর তোমার ছাত্র আসছে অপেক্ষা করো। রাসেল সাড়ে সাতটার দিকে চলে আসলো। পড়ানো শেষ হলো নয়টার দিকে শেখ জামাল ও তার নবপরিণীতা স্ত্রী রোজী জামাল এসে হাজির হলো। শেখ রাসেলকে চেয়ার থেকে উঠিয়ে বসে পড়লো, পিছনে তার স্ত্রী রোজী জামাল। শেখ জামাল বলল আমি বিএ পাস করতে চাই। বিএ পাস না করলে আর্মিতে প্রোমশন পাবনা। আমাকে পড়াতে হবে। গীতালি বলল আমিতো বাংলার, বাংলা ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে যেমন ইংরেজি পড়াতে পারবো না। জামাল বলল কোন অসুবিধা নাই তাই পড়াবেন। তারা চলে যাওয়ার পর শেখ রাসেল বলল আমাকে ছাড়া আর কাউকে পড়ানো যাবেনা। বেগম মুজিব বিষয়টি লক্ষ্য করেছেন। বেগম মুজিব গীতালি কে চুপিচুপি দোতলার ছাদে নিয়ে গেলেন। বললেন পড়াতে রাজি হয়ে যাও। রাত পৌনে ১১ টায় বাসায় ফিরে আসা। পরদিন ১৫ই আগস্ট সকাল সবকিছু চুরমার করে দিয়ে গেল। জামাল, রাসেল কাউকে আর পড়ানো হয়নি।
গীতালি বলল তখন বুঝতে পারিনি কত বড় পরিবারের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছিলাম। কিন্তু ওই পরিবারের সাথে আমার কোন ফটো নেই। রাসেল এঘর ওঘর করতো তাই সব ঘরেই তাকে পড়িয়েছিলেন। ছিলো অবাধ যাতায়াত। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত সন্ধ্যার পর সন্ধ্যা বেগম মুজিবের সাথে কথা বলেছি, আছে শুধু স্মৃতি।
আজ ছেলের কাছে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে প্রবাসে কাটাচ্ছি। ১৯৭৫ সালের ১৬ মে শিক্ষা ক্যাডারে বাংলার শিক্ষক হিসাবে কামরুন্নেসা কলেজে যোগদানের মাধ্যমে চাকরিজীবন শুরু। ১৯৮৪ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্তীর সাথে বিয়ে।ঢাকার কামরুনেছা কলেজে ১৮ বছর ও নোয়াখালী সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করার পর ২০০৫ অবসরে গেছি। ২০১২ সালে অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে আস্ট্রেলিয়ায় ছেলের কাছে পাড়ি জমিয়েছি। ২০১২ সালে গণভবনে গিয়ে শেখর কে বলেছি আমি রাসেলকে পড়াতাম সাথে দেখা করতে চাই। সে বিশ্বাস করেনি, তাই সম্ভব না বলে বিদায় দিয়েছে।
গীতালি দাস গুপ্তার সাথে ১৯ অক্টোবর সকাল সাড়ে ১১ টা থেকে ১ ঘন্টা এবং পরদিন টেলিফোনে আলাপের সূত্রে এই লেখা।
- লেখক : কিউরেটর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর।