যেভাবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত বঙ্গবন্ধু

( সম্পাদনা প্রয়োজন)
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে যার নামটি আমাদের প্রায় সকলের মনেই সবার আগে আসে, তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তবে শুধু হাজার বছর কেন, অনেকেই তাকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবেও বিবেচনা করে থাকে।

কিন্তু অনেকেরই হয়তো অজানা, কবে কীভাবে 'সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি'-র আনুষ্ঠানিক খেতাবটি পেয়েছিলেন শেখ মুজিব, এবং এক্ষেত্রে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীরাই বা কারা ছিলেন। তাই চলুন, সেই কাহিনী আজ তুলে ধরা যাক আপনাদের সামনে।

'সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রিটন' স্যার উইনস্টন চার্চিল; Image Source: Imperial War Museums
২০০২ সালে বিবিসিতে প্রচারিত হয় '১০০ গ্রেটেস্ট ব্রিটনস' নামের একটি টেলিভিশন সিরিজ। সেখানে দর্শক জরিপ অনুযায়ী সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ১০০ ব্রিটন কারা, তা নির্ধারণ করা হয়। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রিটন হিসেবে নির্বাচিত হন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার উইনস্টন চার্চিল। এছাড়া পরের দুটি অবস্থানে ছিলেন ইসামবার্ড কিংডম ব্রুনেল এবং ডায়ানা, প্রিন্সেস অভ ওয়েলস।

টেলিভিশন সিরিজটি প্রচার শুরু হওয়ার পর থেকেই বিশ্বব্যাপী তুমুল সাড়া ফেলে দেয়। স্যার উইন্সটন চার্চিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রিটন নির্বাচিত হওয়ার পর আরো এক দফা উন্মাদনা সৃষ্টি হয় সিরিজটিকে ঘিরে। কেউ কেউ খুশিমনে গ্রহণ করে ব্রিটিশ জনগণের এ সিদ্ধান্ত। অনেকে আবার তীব্র সমালোচনাও করে ব্রিটিশদের, বলে তারা নাকি ইতিহাস বিষয়ে একেবারেই অজ্ঞ।

তবে মোদ্দা কথা হলো, বিবিসিতে প্রচারিত এ অনুষ্ঠানটি সফলতার মুখ দেখে। এর মাধ্যমে ব্রিটেনের সাধারণ মানুষের পছন্দ-অপছন্দের প্রতিফলন ঘটে। কোনো কোনো ঐতিহাসিক ব্যক্তিকে তারা তাদের আদর্শ বলে মনে করে, তা-ও পরিষ্কার হয়ে গিয়ে।

তাই এই সিরিজ থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েই বিবিসি বাংলা রেডিও সার্ভিস ঠিক করে যে, তারাও এমন একটি জরিপের আয়োজন করবে, যেখানে শ্রোতাদের নির্বাচনে বের হয়ে আসবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি।

'সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি' নির্বাচনের আয়োজন করে বিবিসি বাংলা; Image Source: BBC
বিবিসি বাংলার এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় ২০০৪ সালে। তখন বাংলাদেশ ও পূর্ব ভারতে (পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম রাজ্য) বাংলাভাষী জনগণ ২৫ কোটির মতো। আর তাদের মধ্যে ১ কোটি ২০ কোটি মানুষ বিবিসি বাংলা রেডিওর শ্রোতা। এই বিপুল সংখ্যক শ্রোতাদেরকে উদ্দেশ করেই বিবিসি বাংলা শুরু করে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ।

২০০৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত 'সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি' শিরোনামে জরিপ পরিচালনা শুরু করে বিবিসি বাংলা। তাদের এ জরিপে অংশ নেয় বাংলাদেশ ও ভারত ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিরা।

জরিপের নিয়ম ছিল- প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীকে তাদের মতে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ পাঁচজন বাঙালির নাম জানাতে হবে এবং সেই পাঁচজনকেও শ্রেষ্ঠত্বের ক্রমানুসারে সাজাতে হবে। অর্থাৎ, কাউকে প্রথম অবস্থানে রাখতে হবে, কাউকে দ্বিতীয়, কাউকে তৃতীয়।

এদিকে বিভিন্ন অবস্থানের জন্য মনোনীতদের প্রাপ্ত পয়েন্টও হবে আলাদা। প্রথম অবস্থানে থাকা ব্যক্তি পাবেন ৫ পয়েন্ট, দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ব্যক্তি ৪ পয়েন্ট, এভাবে পঞ্চম অবস্থানে থাকা ব্যক্তি ১ পয়েন্ট।

নির্ধারিত সময়ে জরিপের মাধ্যমে প্রায় ১৪০ জনের মতো ব্যক্তির নাম পায় বিবিসি বাংলা। তাদের মধ্য থেকে প্রাপ্ত পয়েন্টের ভিত্তিতে শীর্ষ ২০ জনকে নির্ধারণ হয়। এরপর ২৬ মার্চ থেকে প্রতিদিন ২০ জনের মধ্য থেকে ২০তম, ১৯তম, ১৮তম- এভাবে একেকজন শ্রেষ্ঠ বাঙালির নাম প্রকাশ করতে শুরু করে তারা। এ আয়োজনের চূড়ান্ত দিনটি ছিল ১৪ এপ্রিল, পহেলা বৈশাখের (বাংলা নববর্ষ) দিন। এ দিনই বিবিসি বাংলা ঘোষণা করে, বিশ্বব্যাপী অবস্থানরত বাঙালিদের ভোটের ভিত্তিতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

'সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি' নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু; Image Source: Anandabazar Patrika
বঙ্গবন্ধুর এভাবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হওয়া কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনাও অবশ্য ছিল না। কারণ, দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের থেকে তিনি প্রায় দ্বিগুণ ভোট পান। এদিকে কবিগুরুও পান তৃতীয় অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ভোট। একইভাবে বিদ্রোহী কবিও প্রায় দ্বিগুণ ভোট পান চতুর্থ স্থান অর্জনকারী শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হকের চেয়ে।

তবে মনোনীত অন্যদের মধ্যে ব্যবধান আর এতটা বেশি ছিল না। ২০তম অবস্থান অর্জনকারী পর্যন্ত সকলের মধ্যেই প্রাপ্ত পয়েন্টের ব্যবধান ছিল সীমিত। অর্থাৎ শেখ মুজিব, রবি ঠাকুর আর কাজী নজরুল যে অন্যসব বাঙালির চেয়ে যোজন যোজন দূরত্বে এগিয়ে, তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল।

অবশ্য এরপরও বাকিদের মধ্যে দুজন ব্যক্তি ছিলেন বিশেষায়িত। তারা হলেন নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া এবং অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন। বেগম রোকেয়া ছিলেন তালিকার একমাত্র নারী। অপরদিকে অমর্ত্য সেন ছিলেন তালিকার একমাত্র জীবিত ব্যক্তি। এছাড়া ১৫তম অবস্থানের জন্য কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি মনোনীত হননি। এ অবস্থানের জন্য বিবিসি বাংলার শ্রোতারা বেছে নিয়েছিল ভাষা আন্দোলনের শহীদদেরকে।

এ তালিকায় ছিলেন বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের শহীদরাও; Image Source: Bonik Barta
চলুন এক নজরে দেখে নেয়া যাক শীর্ষ ২০ বাঙালির তালিকাটি:

১. শেখ মুজিবুর রহমান (রাজনীতিবিদ)
২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (সাহিত্যিক)
৩. কাজী নজরুল ইসলাম (সাহিত্যিক)
৪. এ কে ফজলুল হক (রাজনীতিবিদ)
৫. সুভাষচন্দ্র বসু (সক্রিয় কর্মী, জাতীয়তাবাদী নেতা)
৬. বেগম রোকেয়া (সমাজ সংস্কারক, সাহিত্যিক) 
৭. জগদীশ চন্দ্র বসু (বিজ্ঞানী)
৮. আবদুল হামিদ খান ভাসানী (রাজনীতিবিদ)
৯. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (শিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক)
১০. রাজা রামমোহন রায় (সমাজসংস্কারক)
১১. সৈয়দ মীর নিসার আলী (বিপ্লবী)
১২. লালন শাহ (মানবতাবাদী, দার্শনিক)
১৩. সত্যজিৎ রায় (চলচ্চিত্র নির্মাতা, সাহিত্যিক)
১৪. অমর্ত্য সেন (অর্থনীতিবিদ)
১৫. ভাষা আন্দোলনের শহীদ (সক্রিয় কর্মী)
১৬. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (শিক্ষাবিদ)
১৭. স্বামী বিবেকানন্দ (ধর্ম প্রচারক)
১৮. অতীশ দীপঙ্কর (ধর্ম প্রচারক)
১৯. জিয়াউর রহমান (মুক্তিযোদ্ধা, সামরিক কর্মকর্তা)
২০. হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (রাজনীতিবিদ)

অন্যদের চেয়ে বড় ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন তারা তিনজন; Image Source: Amader Notun Shomoy
দেখতেই পাচ্ছেন, শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারকদের প্রতিই সাধারণ বাঙালির ভালোলাগার পরিমাণ ছিল সর্বাধিক। এছাড়া এ তালিকায় বিপ্লবী নেতা, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, ধর্ম প্রচারক কিংবা শিক্ষাবিদরাও জায়গা পেয়েছিলেন। এ থেকে বোঝা যায়, কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণী নয়, বরং সাধারণ বাঙালি বেছে নিয়েছিল বিচিত্র শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিত্বকারীদের, যারা দেশ ও জাতির জন্য কাজ করেছেন, এবং বহির্বিশ্বের সেই দেশ ও জাতির মুখ উজ্জ্বলও করেছেন।

জানিয়ে রাখা ভালো, এ জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সিংহভাগই ছিল বাংলাদেশি নাগরিক। এতে অবশ্য অবাক হওয়ারও কিছু নেই। কারণ, ভারতীয় বাঙালিদের চেয়ে বাংলাদেশি বাঙালির সংখ্যা সে সময়ও অপেক্ষাকৃত বেশিই ছিল। তারপরও কিন্তু বাংলাদেশিরা কেবল নিজ ভূখণ্ডের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিদের প্রতিই সমর্থন জানায়নি, যা এ তালিকায় বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশের সহাবস্থান থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায়।

এ জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম বা রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি পক্ষপাতিত্বের প্রবণতাও খুব কম ছিল। সে কারণে এমন দৃষ্টান্তেরও দেখা মিলেছে যে একই লোক মনোনীত করেছে বঙ্গবন্ধু, রবি ঠাকুর এবং গোলাম আজমকে!

শীর্ষ ২০-এর এই তালিকায় ঠাঁই না হলেও, জরিপে অংশগ্রহণকারীদের পছন্দনীয় ব্যক্তিত্ব হওয়ার দৌড়ে অন্যদের চেয়ে বেশ এগিয়ে ছিলেন আরো কয়েকজন ব্যক্তিও। তাদের মধ্যে শুরুতেই আসবে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নাম। এছাড়াও অনেক অংশগ্রহণকারীই বেছে নিয়েছিল কাদের সিদ্দিকী, এমএজি ওসমানী, চিত্তরঞ্জন দাশ এবং তৎকালীন ভারতীয় জাতীয় দলের অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলীকে।

বিবিসির তালিকানুযায়ী 'সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নারী' বেগম রোকেয়া; Image Source: Jugantor
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রিটন হিসেবে স্যার উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে যতটা বিতর্ক হয়েছিল, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকা নিয়ে অবশ্য ততটা বিতর্ক হয়নি। কারণ সবার উপরেই যে থাকবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, এবং পরের দুটি অবস্থানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম, এ বিষয়ে আসলে খুব একটা সন্দেহের অবকাশ কখনোই ছিল না।

তারপরও কি বিবিসি বাংলার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জরিপটিকে পুরোপুরি বিতর্কমুক্ত বলা যাবে? না। ২০২০ সালে বিবিসি বাংলা তাদের ওয়েবসাইটে পুনরায় শীর্ষ ২০-এর তালিকাটি পুনঃপ্রকাশ করলে, সেটি নিয়ে নানাজনে নানা অভিযোগ তোলে। যেমন- কলকাতা থেকে স্বামী বিমলানন্দ নামের এক ব্যক্তি অভিযোগ তোলেন, অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে শতকরা ৯৫ ভাগ বাংলাদেশি এবং তার মধ্যে ৯০ শতাংশ মুসলমান, ফলে এ নির্বাচনে নিরপেক্ষতা নেই।

কিন্তু এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বিবিসি বাংলার সম্পাদক। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অধিকাংশ শ্রোতা বাংলাদেশি ছিল, এ কথা তিনি মেনে নিলেও, সাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গে বলেছেন, ২০ জনের তালিকায় ১০ জন মুসলিম, ৬ জন হিন্দু, ২ জন ব্রাহ্ম সমাজ, একজন বৌদ্ধ আর একজন কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারী নন। এছাড়া তিনি আরো উল্লেখ করেন, ২০ জনের তালিকায় ৮ জনকে বাংলাদেশি বলা যেতে পারে, অন্যদিকে ১০ জন ভারতীয়। এছাড়া অতীশ দীপঙ্কর ও লালন ফকিরকে কোনো নির্দিষ্ট দেশের বাসিন্দা বলা চলে না। তাই এক্ষেত্রেও জাতীয়তাবাদী পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ ভিত্তিহীন।

SUMMARY

2731-২.jpg