বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরই মোশতাকের টার্গেট হন চার নেতা

- সাখাওয়াত আল আমিন

তাদের কাউকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী হওয়ার; কাউকে আবার বলা হয়েছিল উপ-রাষ্ট্রপতি হতে। এমন আরো সব লোভনীয় প্রস্তাব ছিল তাদের জন্য।কিন্তু এসব প্রস্তাবে রাজি না হয়ে তারা অবিচল ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে। শেষ পর্যন্ত নিজেদের জীবন দিয়ে লিখে গেছেন ইতিহাসের নতুন এক অধ্যায়।

’৭৫-এর ১৫ আগস্ট দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যের হাতে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিপারে হত্যার পরও জাতির অাস্থা প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামান।

নানা প্রলোভনে আদর্শচ্যুত করতে না পেরে ভিন্ন পন্থায় নিজেদের উদ্দেশ্য পূরণে চার নেতাকে কারাবন্দি করে খন্দকার মোশতাক সরকার। এরপরও শেষ রক্ষা হবে না জেনে বন্দি অবস্থায়ই ৩ নভেম্বর তাদেরকে নৃশংশভাবে হত্যা করে। ঘৃণ্য প্রতিহিংসার চরিতার্থ করে উল্লাসে মেতে উঠে স্বাধীনতাবিরোধীরা।

ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী
সেই সময়ের ওপর লেখা বিভিন্ন বই, পত্রপত্রিকা এবং ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাতকারে জানা যায়, ১৫ আগস্ট থেকেই নিবেদিতপ্রাণ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে মোশতাক সরকার। আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের একটি বিরাট অংশ বুঝে না বুঝে মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগদানও করে৷ কিন্তু সাহসী ও দেশপ্রেমিক নেতারা বঙ্গবন্ধুর এ হত্যাকাণ্ড কোনভাবেই মেনে নিতে পারেননি৷ তাদেরকে প্রথমে নজরবন্দি করা হয়, পরে আদর্শচ্যুত করতে বিভিন্ন প্রলোভন দেওয়া হয়।

তাদের মধ্যে ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে প্রধানমন্ত্রী এবং এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে মোশতাক সরকারের উপ-রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু তারা দুজনই সেই প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন৷
 
বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহচর এবং মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের বাসভবন ১৫ আগস্ট রাতেই ঘিরে ফেলে সেনাবাহিনী। তার বাসভবনের ছাদে এন্টি এয়ারক্রাফট গান বসানো হয়, নিচতলায় স্থাপন করা হয় কন্ট্রোলরুম। টেলিফোন সংযোগ কেটে দেওয়া হয়।

ক্যাপ্টেন শহীদ নামে একজন অফিসার এসে জানিয়ে দেন,কেউ বাসার বাইরে যেতে পারবে না, বাইরে থেকেও কেউ আসতে পারবে না। রাতে মেজর ডালিম বাসায় এসে তাজউদ্দিনকে বলেন, ‘আপনার নিরাপত্তার জন্যই এ ব্যবস্থা, সব ঠিকঠাক আছে তো?’

এসময় তাজউদ্দিন ধমক দিয়ে বলেন, ‘তুমি নিজের চোখে দেখতে এসেছ আমাকে সত্যি সত্যি বন্দি করা হয়েছে কিনা। সত্যি আমি বন্দি কিনা।’

ওই ঘটনার নিয়ে তাজউদ্দিন আহমেদের মেয়ে সিমিন হোসেন রিমি তার বাবার ভাষ্যে আরো লিখেছেন: আমি আমার এই জীবনে কোনদিন সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করিনি। ১৫ আগস্ট বাসা থেকে বের না হওয়াটাই আমার জীবনের মারাত্মক ভুল ছিল। অর্থাৎ তাজউদ্দিন সেদিন আত্মগোপন না করার জন্য আফসোস করেছেন।


তাজউদ্দিন আহমেদ
বঙ্গবন্ধুর আরেক সহচর ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ১৫ আগস্ট সকালেই সরকারি বাসভবন ছেড়ে আত্মগোপনে চলে যান৷ একজন ব্যক্তিগত স্টাফের বিশ্বাসঘাতকতা এবং কে এম ওবায়দুর রহমানের তৎপরতায় গোপন স্থান থেকে মনসুর আলীকে বঙ্গভবনে মোশতাকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়৷

এ সময় মোশতাক প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করার আহ্বান জানান তাকে৷ সে প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে মনসুর আলী খন্দকার মোশতাককে বলেন, “তুমি শেখ মুজিবকে হত্যা করলে! করতে পারলে?’ আবেগে-কান্নায়-ঘৃণায় এ সময় তার তার কণ্ঠ ধরে আসে৷ এরপর তাকে ২২ আগস্ট ঢাকা জেলে বন্দি করা হয় তাকে।
 
তাজউদ্দিন এবং মনসুর আলীকে গ্রেফতারের পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে তাদের সরকারি বাসভবন থেকে গ্রেফতার করা হয়।

২৩ আগস্ট চার নেতাসহ আওয়ামী লীগের আরও কিছু নেতাকে কারাগারে অন্তরীণ করার পর দিন ২৪ আগস্ট দৈনিক ইত্তেফাকে শিরোনাম হয়, “দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ ২৬ জন গ্রেফতার”।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম
সংবাদের ভেতরে লেখা হয়, ‘‘দুর্নীতি, সমাজবিরোধী তৎপরতা, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিপুল সম্পদ ও সম্পত্তি হস্তগত করার অভিযোগে সামরিক আইনের বিধিমালার আওতায় সাবেক সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব মনসুর আলী, সাবেক উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সাবেক মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ, জনাব কোরবান আলী, আবদুস সামাদ আজাদ এবং কয়েকজন এমপিসহ মোট ২৬ জনকে গতকাল (শনিবার) গ্রেফতার করা হইয়াছে”।

এরপর সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থান পাল্টা অভ্যুত্থানসহ নানা রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে গ্রেফতার করার মাত্র আড়াই মাস পর ওই বছরের ৩ নভেম্বর ঢাকা কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে।
 
রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, বঙ্গবন্ধুর পর ওই চার নেতাই ছিলেন আওয়ামী লীগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তাই ঘাতকদের ধারনা ছিল তাদেরকে হত্যা করতে পারলে আওয়ামী লীগ আর কখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।

এ এইচ এম কামরুজ্জামান
ওই ঘটনা প্রসঙ্গে  পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মুহাম্মদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: আসলে ঘাতকদের উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগকে নেতত্ব শূন্য করা। এই মিশন বাস্তবায়নেই সেদিন জঘন্যভাবে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়।

SUMMARY

273-1.jpg