মো. সাখাওয়াত হোসেন
১৯৭৪ সালের পাকিস্তানের লাহোরে ২৩-২৪ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় ইসলামী সম্মেলনে অংশগ্রহণের বিরোধিতা করেছিলেন ফজিলাতুন নেছা মুজিব। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন- বঙ্গবন্ধু লাহোরের সম্মেলনে অংশগ্রহণ করলে স্বাভাবিকভাবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে রাষ্ট্রীয় সফরের দাওয়াত দিতে হবে। তিনি চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু না গিয়ে দলের সিনিয়র কোন নেতা অথবা মন্ত্রী যেন সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। মন্ত্রীসভার বৈঠকে তাজউদ্দিন আহমদও এমনটি চেয়েছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সৌদি আরবের বাদশাহর বিশেষ নিমন্ত্রণ ও আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্টের প্লেন পাঠানোকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে সম্মেলনের অংশগ্রহণের গুরুত্ব তুলে ধরেন ফজিলাতুন নেছার সামনে।
রেণু আশংকা করেছিলেন ভুট্টো বাংলাদেশে আসলে পাকিস্তানের প্রেতাত্মা হিসেবে দেশীয় দোসরদের জাগরুক করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি সেসময় পাকিস্তানে বাংলাদেশের দূতাবাস না থাকায় বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা নিয়েও চিন্তিত ছিলেন ফজিলাতুন নেছা। যদিও ঐ সফরের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে কিছু সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল কিন্তু তার গুরুত্ব অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর জীবনের থেকে বেশি নয়। ফজিলাতুন নেছা যে আশংকা করেছিলেন সেটিই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সত্যে পরিণত হয়। দূরদর্শিতায় রেণুর প্রজ্ঞা যে কোন তুখোড় রাজনীতিবিদের তুলনায় কোন অংশে কম ছিল না, সেটিই প্রমাণিত হয়। পরবর্তীতে জুলফিকার আলী ভুট্টোর বাংলাদেশ সফরেই কী বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছিল কিনা সেটিও এখন নতুন করে গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ফজিলাতুন নেছা মুজিবের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সম্পর্কে বিশিষ্ট সাংবাদিক এবিএম মূসার লেখনি থেকে জানা যায়, সংবাদপত্র বিলি-বণ্টন নিয়ে হকার্স সমিতি ও বণ্টনের দায়িত্বে নিয়োজিত এজেন্সির মধ্যে বিরোধ দেখা দেয় এবং বিরোধ চরম পর্যায়ে চলে যাওয়ায় নিষ্পত্তির জন্য পুলিশের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়। সে সময় বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ ঢাকার এসপি মাহবুবকে প্রভাবশালী মহল একটি পক্ষকে চাপ দেওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করেন। অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় ধানমন্ডির ৩২ নং বাড়িতে তৎকালীন ইত্তেফাক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও এবিএম মূসা সাক্ষাৎ করে বিষয়টি সম্বন্ধে অবহিত করেন। সবকিছু শোনার পর শেখ মুজিব কিছু বলার পূর্বেই ফজিলাতুন নেছা বলে উঠেন, ‘তোমাকে তো বহুবার বলেছি তোমার এসব নিজস্ব লোকজনই শেষ পর্যন্ত তোমাকে ডোবাবে।’ শেষ পর্যন্ত ঘটনাটি অনেক দূর গড়িয়েছিল এবং শেখ মুজিবুর রহমানকেই এ ঘটনা সামাল দেওয়ার জন্য হেনস্থা পোহাতে হয়েছিল।
সিনিয়র নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতপার্থক্য হলে বা বঙ্গবন্ধুর সাথে যোগাযোগের ঘাটতি হলে অনেক সময় মনোমালিন্য হত। এবং তা সমাধানের জন্য ফজিলাতুন নেছা মুজিব কর্মপন্থা ঠিক করতেন এবং তদনুযায়ী কাজ করে নিজেই সব মীমাংসা করতেন। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী একটা সময় বঙ্গবন্ধু সরকার এবং ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে বিরামহীন প্রচারণা চালাতে লাগলেন। এম এ ওয়াজেদ মিয়া এ বিষয়ে তাঁর শ্বাশুড়ীকে বললেন, “১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মওলানা ভাসানীকে বিপ্লবী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ঐ উপদেষ্টা পরিষদ বিলুপ্ত করায় সম্ভবত মওলানা ভাসানী মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বঙ্গবন্ধুর বিরোধী ভূমিকা অবলম্বন করেছেন।” শ্বাশুড়ী বললেন, ‘অতীতেও দেখেছি যে, তার সেবা ও এটা সেটার প্রয়োজন মেটাতে শেখ সাহেব একটুও গাফিলতি বা অবহেলা করলে মওলানা ভাসানী এরূপ আচরণ করতেন। তোমার শ্বশুর একবার ‘হুজুর’ বলে ভাসানী সাহেবের সঙ্গে দেখা করলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।” রাজনীতির কতটা গভীর পর্যায়ে পৌঁছালে একজন প্রজ্ঞাবান মহিলা এসব সূক্ষ্ম বিষয়ের সহজ উপায় বের করে ফেলতেন, তা বেগম মুজিবের বুদ্ধিমত্তা দেখে অনুমিত হয়।
ঘটনাবহুল ১৯৭১ সালের ২২ মার্চ দুপুরে বঙ্গবন্ধু কারো সঙ্গে কথা না বলে গম্ভীরভাবে খাচ্ছিলেন। ওয়াজেদ মিয়ার ভাষ্যমতে, “এক পর্যায়ে শ্বাশুড়ী বললেন, এতদিন ধরে যে আলাপ আলোচনা করলে তার ফলাফল কী হলো কিছু তো বলছো না। তবে বলে রাখি, তুমি যদি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সমঝোতা কর, তবে একদিকে ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনী তাদের সুবিধামত যেকোন সময়ে তোমাকে হত্যা করবে। অন্যদিকে এ দেশের জনগণ ও তোমার উপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হবে।” এ কথা শুনে বঙ্গবন্ধু রাগান্বিত হয়ে শ্বাশুড়ীকে বলেন আলোচনা এখনো চলছে। এই মুহূর্তে সব কিছু খুলে বলা সম্ভব না। এই পর্যায়ে শ্বাশুড়ী রেগে গিয়ে নিজের খাবারে পানি ঢেলে দ্রুত ওপর তলায় চলে যান। তিনি না খেয়ে সারাদিন শুয়ে থাকলেন, কারো সঙ্গে কথাও বললেন না।” এই ছিল ফজিলাতুন নেছা মুজিবের রাজনৈতিক দৃঢ়তা, রাজনীতিতে তিনি এতটাই পরিপক্ক ছিলেন যে সর্বশেষ খবর রাখতে পছন্দ করতেন সব বিষয়েই। সাংসারিক দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে রাজনৈতিক চেতনা কাজ করত প্রবলভাবে তা সত্যিই অতুলনীয়।
ওয়াজেদ মিয়ার গ্রন্থ হতে উল্লেখিত; মেয়ের জামাইকে উদ্দেশ্য করে ফজিলাতুন নেছা মুজিব বলেন: “বাবা, গত ১৮ জানুয়ারি গভীর রাতে তোমার শ্বশুরকে সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গেছে। গত সপ্তাহ থেকে বহু জায়গায় এবং বহু লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করেও এখন পর্যন্ত তাকে কোথায় নেয়া হয়েছে, তিনি কী অবস্থায় আছেন সে সম্পর্কে কোন কিছুই জানতে পারিনি”। এর কিছুদিন পরে ১৯৬৮ সালের এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে তিনি আরো বলেন; “শেখ সাহেবসহ আরো ৩৪ জন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় জড়িয়ে ঢাকার ক্যান্টনমেন্টে অন্তরীণ রাখা হয়েছে। ক্যান্টনমেন্টের কোথায় কী অবস্থায় রাখা হয়েছে এখন পর্যন্তও কিছু জানতে পারিনি”। এ বইয়ের পাঠ থেকে আরো জানা যায়, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রতিরোধে ছাত্রসংগঠনের মাধ্যমে আন্দোলনকে সুসংগত করার জন্য ওয়াজেদ মিয়া মারফত ছাত্রনেতাদের কাছে বার্তা প্রেরণ করতেন বেগম মুজিব।
রাজনৈতিক পরামর্শ প্রদান ও উৎসাহ দিতে ফজিলাতুন নেছার জুড়ি মেলা ভার। কৈশোর থেকে শুরু করে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত স্বামীর প্রতিটি কাজে মানসিক সহায়তা দিয়েছেন, উৎসাহ যুগিয়েছেন।
শেখ মুজিব তখন ৭ম শ্রেণির ছাত্র, গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। অনুষ্ঠান শেষে দুই নেতার গতিরোধ করেন সাহসী ও নির্ভীক ছাত্র শেখ মুজিব। নেতাদের পথ আগলে রেখে স্কুলের ছাত্রাবাস মেরামতের জন্য ১২শ টাকা আদায় করেন। তখন থেকেই একজন ছাত্রনেতা হিসেবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিশেষ নজর কাড়তে সক্ষম হন তরুণ মুজিব। এ ঘটনার পরে ফজিলাতুন নেছা তার স্বামীকে সাধুবাদ জানান এবং ভবিষ্যতেও সংগঠিত কর্মে তিনি অবলীলায় উৎসাহ ও উত্তরোত্তর ভাল করার তাগিদ দিতেন। কারণ, তিনি জানতেন বাংলার মানুষের নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুক্তির বাতায়ন আনতে আন্দোলন-সংগ্রামের কোন বিকল্প রাস্তা খোলা ছিল না। বাংলার গণমানুষের নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জন্মের সময় শেখ মুজিব কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিরসনে ব্যস্ত থাকায় বাড়িতে আসতে পারেননি। তারপরেও স্বামীর প্রতি তার কোন অভিযোগ অনুযোগ ছিল না। কারণ, তিনি জানতেন তার স্বামী দেশসেবার কাজে নিয়োজিত।
এমনিভাবে, ফজিলাতুন নেছা প্রত্যেকটি কাজে স্বামীকে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিতেন। সন্তান জন্মদানের সময় প্রত্যেক স্বামীর কর্তব্য থাকে স্ত্রীর পাশাপাশি থাকা, স্ত্রীকে সময় দেওয়া। কিন্তু শেখ মুজিব রাজনীতিটাকে এতটাই ভালবাসতেন, দেশের মানুষকে এতই ভালবাসতেন, দেশকে শত্রু মুক্ত করতে নিজের সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন যেখানে পরিবারের ব্যক্তিক চিন্তন, সুযোগ-সুবিধার কথা কখনোই ভাবতেন না। এহেন পরিস্থিতিতে রেণু পরিবারের সামগ্রিক দায়-দায়িত্ব পালন করতেন। ফজিলাতুন নেছা ত্যাগ, নিষ্ঠা এবং সততার যে উদাহরণ তৈরি করেছেন বাঙালির সংগ্রামের জন্য তা সত্যিই অসাধারণ।
মো. সাখাওয়াত হোসেন
চ্যানেল আই অনলাইন ২৩ অক্টোবর, ২০১৯