প্রধানমন্ত্রী হতে আমি সংগ্রাম করি নাই: বঙ্গবন্ধু

উদিসা ইসলাম

বাংলার মানুষ যাতে মানুষের মতো দুনিয়ায় দাঁড়াতে পারে, তার জন্য এবং বাংলার সম্পদ যাতে পশ্চিমারা লুট করে খেতে না পারে, তারই জন্য আমি সংগ্রাম করেছিলাম— প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য সংগ্রাম করি নাই। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৭ জুনের জনসভায় এই মন্তব্য করেন। ঐতিহাসিক ছয় দফা উপলক্ষে তিনি যে ভাষণ দেন, সেই বিষয়ে পরের দিন ৮ জুনের পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে কয়েকদিন পর্যন্ত পত্রিকায় প্রকাশ করতে দেখা যায়। ওই জনসভায় বঙ্গবন্ধু লালবাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করেন।
লাল বাহিনীর অভিবাদন নিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
লাল বাহিনীর অভিবাদন নিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিষয়ে জনগণের উদ্দেশে সেদিনের ভাষণে তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি মনে করেছিলেন, আমাকে প্রধানমন্ত্রী বললেই আমি গলে গদ গদ হয়ে যাবো। আর আমার দাবি ছেড়ে আমি তার সঙ্গে হাত মেলাবো। কিন্তু তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে জানতেন না। আওয়ামী লীগকেও জানতেন না। তার এটাও জানা ছিল না যে, প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য মুজিবুর রহমান রাজনীতি করি নাই।’

১৯৬৬ সালের ৭ জুনের স্মৃতিচারণ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সেই দিন তেজগাঁও, ভিক্টোরিয়া পার্ক, নারায়ণগঞ্জ, মুক্তাগাছা এবং আরও অনেক জায়গায় গুলি করে আমার শত শত ভাইবোনকে হত্যা করা হয়। আইয়ুব খান মনে করেছিলেন, গুলি করে বাঙালিদের দাবিয়ে দেবেন। কিন্তু তিনি তা পারেন নাই। সেই দিনই শুরু হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম।’

বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পরের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে বক্তৃতায় বলেন, ‘জেল থেকে বের হয়ে আসার পর আমি বলেছিলাম, আমার কর্তব্য বোধহয় শেষ হয়ে গেছে। আমার দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমার পতাকা আজ  দুনিয়ার আকাশে ওড়ে। আমার দেশ বাংলাদেশ আজ দুনিয়ার মানচিত্রে স্থান পেয়েছে। আজ  আমি বলতে পারি, আমি বাঙালি। কিন্তু আমাদের গুদামে চাল নাই। পকেটে পয়সা নাই। পোর্ট ভেঙে দিয়েছে। বাস-ট্রাক পুড়িয়ে দিয়েছে। রেলগাড়ি চলে না। রাস্তায় গাড়ি চলতে পারে না। চট্টগ্রাম ও চালনা পোর্টের মুখে সব জাহাজ ডুবিয়ে রেখে দিয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বাঁচাবো কী করে? দস্যুর দল মানুষ হত্যা করে খুশি হয় নাই। আমার সম্পদ ধ্বংস করে লুট করে নিয়ে গেছে।’
গণপরিষদ সদস্য আব্দুল গফুর হত্যা মামলার তদন্তের নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধু
গণপরিষদ সদস্য আব্দুল গফুর হত্যা মামলার তদন্তের নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধু

বরাবরের মতো শ্রমিকদের উদ্দেশে আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভায়েরা, আল্লাহর ওয়াস্তে একটা উৎপাদন করো। আল্লাহর ওয়াস্তে মিল খেয়ে ফেলো না। পয়সা থাকবে না। ব্যাংক থেকে ১৫৭ কোটি টাকা তোমাদের আমি দিয়েছি, শিল্প প্রতিষ্ঠান চালাবার জন্য। অনেক মিল বন্ধ তবু মাইনে দিয়ে চলছি। অনেক মিলে অর্ধেক কাজ হয়। সেখানেও আমি মাইনে দিয়ে চলছি। আমি তাদের ভালোবাসি,এই জন্যই তো আমি বিনা কথায় ২৫ টাকা মাইনে বাড়িয়ে দিয়েছি। তাদের ২/৩ বছর কষ্ট করতে হবে। উৎপাদন করতে হবে। ইনশাল্লাহ, একবার যদি উৎপাদন বেড়ে যায়, তাহলে আর কোনও কষ্ট হবে না।’

এদিকে বঙ্গবন্ধু এই দিনে (৮ জুন) এমসিএ আব্দুল গফুরের হত্যা মামলার তদন্তে নির্দেশ দেন। অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে খুলনায় গণপরিষদ সদস্য আব্দুল গফুরের নিহতের ঘটনায় আশু তদন্তের নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার বিশ্বাস বাংলাদেশের সব শান্তি প্রিয় লোক এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করছেন।’ এই নির্মম বেদনাদায়ক ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের পাশাপাশি তিনি নিহতের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
১৯৭২ সালের ৮ জুনের দৈনিক পূর্বদেশ
১৯৭২ সালের ৮ জুনের দৈনিক পূর্বদেশ

এই দিনে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ নয়াদিল্লি পৌঁছান। সেখানে মৈত্রী ও বাণিজ্য চুক্তি বাস্তবায়ন সম্পর্কে আলোচনা হওয়ার কথা। কূটনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে পত্রিকায় বেশকিছু  প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ জানান, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত নৈতিক এবং বাস্তব সাহায্য-সহযোগিতা দিয়েছিল। তিনি সিঙ্গাপুরে এক সভায় বক্তৃকালে এ তথ্য দেন। এসময় তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। দৈনিক পূর্বদেশের প্রতিবেদনে বলা হয়, সিঙ্গাপুরে প্রকাশিত এক যুক্ত ইশতেহারে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করা হয়। এদিকে এই দিনের সিদ্ধান্ত বিষয়ে পরের দিনের, অর্থাৎ ৯ ‍জুনের দৈনিক পূর্বদেশের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের পাট ও চামড়া কিনতে নেপাল আগ্রহী এবং দুদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক চুক্তির বিস্তর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : জুন ০৮, ২০২০

SUMMARY

2722-২.jpg