।। আমিরুল ইসলাম রাঙা।।
১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাস। বাঙালী জাতির বিজয়ের মাস। ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচন এবং ১৭ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় । জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬৭ আসনে নির্বাচিত হয়ে সমগ্র পাকিস্তান শাসন করার ম্যান্ডেট পায় । অপরদিকে ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পুর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনেও প্রায় সব কয়টি আসনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ নিরাঙ্কুশ সংগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
নির্বাচন পরবর্তী আনন্দে আন্দোলিত গোটা বাঙালী জাতি। পাকিস্তানীদের ২৩ বছর শাসনকালের অবসান হবে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তথা বাঙালী জাতি সমগ্র পাকিস্তান শাসন করবেন। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আনন্দিত পাবনাবাসী। প্রতিদিন আনন্দ মিছিল অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সবার প্রতীক্ষা কখন বঙ্গবন্ধুর হাতে শাসনভার তুলে দিবেন, পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ঠিক এমনি একটি সময়ে ২২ ডিসেম্বর পাবনার রাজনৈতিক অঙ্গনে নেমে এলো বিষাদের ছায়া। বিজয় আনন্দ ক্ষোভ আর বিক্ষোভে পরিনত হলো।
২২ ডিসেম্বর সন্ধ্যা রাতে পাবনা শহরের দক্ষিন রাঘবপুরে নিজ বাড়ীর সামনে খুন হলেন, সাঁথিয়া- বেড়া থেকে নব-নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আহমেদ রফিক। নির্বাচিত হওয়ার পাঁচদিন পর তথাকথিত নক্সালপন্থীরা ছুরিকাঘাত করে এমপিএ আহমেদ রফিককে খুন করে। এমন ঘটনায় পাবনার ছাত্র-জনতা সহ সর্বস্তরের মানুষ ক্ষোভে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
নিহত আহমেদ রফিক ছিলেন পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। পাবনার ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠন বিশেষ করে বিখ্যাত হোসিয়ারী শ্রমিক এবং বিড়ি শ্রমিকদের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। নিঃস্বার্থ ত্যাগী এই রাজনৈতিক নেতাকে পাবনার মানুষ যেমন ভালবাসতেন ঠিক তেমনি ভালবাসতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেকারণেই ১৯৭০ এর নির্বাচনে মাত্র ২৬ বছর বয়সী আহমেদ রফিককে তাঁর নানার এলাকা সাঁথিয়া-বেড়া থেকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। সেই নির্বাচনে আহমেদ রফিককে প্রার্থী করায় পাবনার রাজনৈতিক অঙ্গনের অনেকে হতবাক হয়েছিলেন। অনেকে সেদিন প্রশ্ন তুলেছিলেন যে এলাকার মানুষের সাথে তাঁর কোন সংশ্রব নাই সেখানে তিনি কেমন করে জয়লাভ করবেন? কিন্তু না – হতবাককারীদের অবাক করে বিপুল ভোটে আহমেদ রফিক এমপিএ নির্বাচিত হলেন।
১৯৭০ সালের ২২ ডিসেম্বর আহমেদ রফিক খুন হলেন। হতবাক হলেন পাবনাবাসী – হতবাক হলেন সমগ্র দেশবাসী। শোক আর শোকাহত হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ২৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু পাবনায় আসলেন । প্রথমে বঙ্গবন্ধু গেলেন আহমেদ রফিকের বাসভবনে ( সংযুক্ত ছবি সেখানে তোলা)। সেখানে বঙ্গবন্ধু শোকসন্তপ্ত আহমেদ রফিকের বাবা-মা ,ভাই- বোনদের শান্তনা দেন। শান্তনা দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বার বার অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ছিলেন। এরপর বঙ্গবন্ধু আরিফপুর কবরস্থানে যান। শহীদ আহমেদ রফিকের কবর জিয়ারত করেন। বিকালে পাবনা পুলিশ লাইন মাঠে আহমেদ রফিক হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও শোকসভায় যোগ দেন। শোকসভায় বঙ্গবন্ধু এই নির্মম হত্যাকান্ডের তীব্র নিন্দা করেন। সেদিন বঙ্গবন্ধু লক্ষ জনতার সামনে বলেছিলেন, আমার আহমেদ রফিককে যারা হত্যা করেছে তাদের বিচার ইনশাআল্লাহ এই বাংলার মাটিতে হবে।
১৯৭০ এর ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ এর ডিসেম্বর। এই একবছর সময়কালে রচিত হলো হাজার বছরের ইতিহাস। ৭০ সালের ২২ ডিসেম্বর শহীদ আহমেদ রফিক খুন হবার পর ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ পাকিস্তানী সৈন্যরা আটঘরিয়া-ঈশ্বরদী থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ( এমপিএ) এডভোকেট আমিন উদ্দিনকে হত্যা করে। এর এক সপ্তাহ পর ৬ এপ্রিল পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নব-নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য ( এমএনএ) আমজাদ হোসেন হৃদরোগে মৃত্যুবরন করেন।
১৯৭১ সালে নয়মাসের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো।বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন। ১৯৭২ সালের ২৬ ফ্রেব্রুয়ারী বঙ্গবন্ধু প্রথম পাবনা সফরে আসেন। উনি নগরবাড়ী এসে বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ ( মুজিব বাঁধ) উদ্বোধন করেন। এরপর ১০ মে বঙ্গবন্ধু দুইদিনের সফরে পাবনা এসেছিলেন। জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধু শেষবার পাবনায় আসেন ১৯৭৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী। পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারন সম্পাদক ও সংসদ সদস্য ( এমসিএ) আব্দুর রব বগা মিয়া সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরন করলে নাটোর গনভবনে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষনিকভাবে পাবনায় ছুটে আসেন। মাত্র অল্প সময়ের ব্যবধানে পাবনার রাজনৈতিক অঙ্গনের চার শীর্ষ দিকপালকে বিদায় দিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেও অকালে অসময়ে এই পৃথিবী থেকে চীরবিদায় নিলেন। (সমাপ্ত)
লেখক পরিচিতি –
আমিরুল ইসলাম রাঙা
রাধানগর মজুমদার পাড়া
পাবনা।