বাংলাদেশ চা বোর্ড উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান

সরদার মাহামুদ হাসান রুবেল

১৮০০ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ভারতবর্ষের আসাম ও তৎসংলগ্ন এলাকায় চা চাষ শুরু হয়। তারই ধারাবহিকতায় বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলী নদীর তীরে চা আবাদের জন্য ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে জমি বরাদ্দ হয়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেখানে চা চাষ বিলম্বিত হয়। ১৮৪০ সালে চট্টগ্রাম শহরের বর্তমান চট্টগ্রাম ক্লাব সংলগ্ন এলাকায় একটি চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যা কুন্ডদের বাগান নামে পরিচিত। এই বাগানটিও প্রতিষ্ঠার পরপরই বিলুপ্ত হয়ে যায়। অতঃপর ১৮৫৪ সালে মতান্তররে ১৮৪৭ সালে সিলেট শহরের এয়ারপোর্ট রোডের কাছে মালনীছড়া চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলতঃ মালনীছড়াই বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান।
দেশ স্বাধীনের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশে শুধুমাত্র দুইটি জেলায় চা আবাদ করা হতো, একটি সিলেট জেলায় যা ‘সুরমা ভ্যালী’ নামে পরিচিত ছিল, আর অপরটি চট্টগ্রাম জেলায় যা ‘হালদা ভ্যালী’ নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে বৃহত্তর সিলেটের সুরমা ভ্যালীকে ছয়টি ভ্যালীতে ভাগ করা হয়েছে যথাক্রমে: লস্করপুর ভ্যালী, বালিশিরা ভ্যালী, মনু-দলই ভ্যালী, লংলা ভ্যালী এবং নর্থ সিলেট ভ্যালী। এবং হালদা ভ্যালীকে চট্টগ্রাম ভ্যালী করা হয়েছে৷
১৯৫৭-১৯৫৮ সালে জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। এটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে তিনি প্রথম বাঙালি যিনি চা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন৷ চেয়ারম্যান হওয়ার পর চা বিষয়ক গবেষণাকে তিনি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন এবং তিনি শ্রীমঙ্গলে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন, যার সুফল এদেশের জনগন এখন ভোগ করছে। তাঁর সরাসরি নির্দেশনায় চা এর উপর ব্যাপক গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয় এবং এর ধারাবাহিকতায় এ পর্যন্ত ২০টি অতি উন্নত মানের ফলন এবং গুণসম্পন্ন চা ক্লোন উদ্ভাবন করা হয়েছে যা রোপনের মাধ্যমে চা আবাদীরা ব্যাপক সফলতা পাচ্ছে৷
১৯৭১ সনে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চা বাগানসমূহ প্রায় বিদ্ধস্ত হয়ে যায়। জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই শিল্পকে টেকসই খাতের উপর দাঁড় করানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি চা বাগান মালিকদের মধ্যে ভর্তুকি মূল্যে সার সরবরাহ করেন। চা কারখানাগুলির পূনর্বাসনের জন্য ইন্ডাষ্ট্রিয়াল ব্যাংক অব ইন্ডিয়া থেকে ত্রিশ লক্ষ ভারতীয় মুদ্রা মূল্যের ঋণ নিয়ে চা শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি করেন। বাগান মালিকদের ১০০ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিকানা সংরক্ষণের অনুমতি দেন। শ্রমিকদের ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার দেন৷
বর্তমানে সরকারের বিভিন্ন তৎপরতার কারণে চা শিল্পের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। ১৯৭০ সনে চা উৎপাদনের পরিসংখ্যান ছিল ৩১.৩৮ মিলিয়ন কেজি। ২০১৫ সালে এই উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ৬৭.৩৮ মিলিয়ন কেজি। ২০১৬ সালের প্রথম ভাগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চা উৎপাদন বৃদ্ধির প্রয়ােজনীয় নির্দেশনা দেন। এর ফলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ চা বোর্ডের এবং চা উৎপাদনকার; সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ২০১৬ সালে ৮৫.০৫ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়৷ এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামীতে চা আমদানির প্রয়োজন হবে না বরং রপ্তানির ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে৷
১৯৭০ সনে বাংলাদেশে চা বাগানের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫০ টি, বর্তমানে চা বাগানের সংখ্যা ১৬২টি। এছাড়াও ২০০২ সাল থেকে চা বোর্ডের বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, দিনাজপুর এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানে চা আবাদ শুরু করেছে এবং ব্যাপক সফলতা লাভ করেছে। পঞ্চগড়ে প্রায় ১৭০০ হেক্টর এবং বান্দরবানে ১২২ হেক্টর জমি চা আবাদের আওতায় এসেছে। নতুন প্রকল্প গ্রহনের ফলে আরও ৯০০ হেক্টর জমি ক্ষুদ্রায়তন চা চাষের আওতায় আসবে। এছাড়া বর্তমান সরকার চা শিল্পের উন্নয়নে ‘উন্নয়নের পথনকশা: বাংলাদেশ চা শিল্প’ শিরোনামে একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে যা আগামীতে চা দেশের শিল্পকে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আসিন হতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে৷ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে বঙ্গবন্ধু ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত করেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও যা চলমান ছিল। বর্ণনার সুবিধার্থে তার অবদানকে দুই ভাগে ভাগ করা হলো।
চা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান:
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৪ জুন ১৯৫৭ সাল হতে ২৩ অক্টোবর ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত প্রথম বাঙালি হিসাবে চা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত থেকে বাঙালি জাতিকে সম্মানিত করেন।
তিনি চা বোর্ডের নিজস্ব ভবন নির্মাণের জন্য ১১১-১১৩, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকায় ০.৩৭১২ একর জমি বরাদ্দ গ্রহণ করেন। তাঁর দিকনির্দেশনায় উক্ত বরাদ্দকৃত ভূমিতে চা বোর্ডের প্রধান কার্যালয় ভবন নির্মাণ করা হয়।
তিনি ১৯৫৭ সালে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে টি রিসার্চ স্টেশনের গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করে উচ্চ ফলনশীল জাতের (ক্লোন) চা গাছ উদ্ভাবনের নির্দেশনা প্রদান করেন।
চায়ের উচ্চফলন নিশ্চিত করতে সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে চট্টগ্রামের কর্ণফুলি এবং শ্রীমঙ্গলস্থ ভাড়াউড়া চা বাগানে উচ্চফলনশীল জাতের চারা রোপণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
তিনি “টি অ্যাক্ট-১৯৫০” সংশোধনের মাধ্যমে চা বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ড (সিপিএফ) চালু করেছিলেন যা এখনও চালু রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান:
রাষ্ট্র/ভোটাধিকারবিহীন চা শ্রমিকদের তিনি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নাগরিকত্ব দেন এবং ভোটাধিকার ক্ষমতা প্রদান করেন।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে চা বাগান মালিকদেরকে ১০০ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিকানা সংরক্ষণের অনুমতি প্রদান করেন।
স্বাধীনতার পর “বাংলাদেশ টি ইন্ডাস্ট্রিজ ম্যানেজমেন্ট কমিটি (BTIMC)” গঠন করে মালিকানাবিহীন/পরিত্যাক্ত ৩৯টি চা বাগান পুনর্বাসন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এছাড়াও যুদ্ধে বিদ্ধস্ত ৮টি পরিত্যক্ত বাগান ১৯৭৫ সালের মধ্যে বাগান মালিকদের নিকট পূনরায় হস্তান্তর করেন।
তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ধ্বংসপ্রাপ্ত চা কারখানাগুলো পুনর্বাসনের জন্য ১৯৭২ সালে “ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া” থেকে ৩০ লাখ ভারতীয় মুদ্রা ঋণ গ্রহণ করতঃ চা শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি করেন।
চা শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষায় বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭২-১৯৭৪ সাল পর্যন্ত চা উৎপাদনকারীদের নগদ ভর্তুকি প্রদান করার পাশাপাশি ভর্তুকি মূল্যে সার সরবরাহ করেন। উক্ত সার সরবরাহ এখনো অব্যাহত আছে।
তিনি চা শ্রমিকদের শ্রমকল্যাণ নিশ্চিত করেন; যেমন-বিনামূল্যে বাসস্থান, সুপেয় পানি, বেবি কেয়ার সেন্টার, প্রাথমিক শিক্ষা ইত্যাদি। এছাড়া রেশন সুবিধা চালু করেন যা এখনো অব্যাহত আছে।
তিনি ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ টি রিসার্চ স্টেশনকে পূর্ণাঙ্গ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটে উন্নীত করেন। বর্তমানে তা বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (BTRI) নামে পরিচিত।

SUMMARY

2697-২.jpg