স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ

- মাহবুব রেজা  

এক.
ইতিহাস গবেষকরা পৃথিবীর দেশে দেশে স্বাধীনতার ইতিহাস ও এর পূর্বাপর তুলে ধরে বলেছেন, একটি দেশের,একটি জাতির স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতির প্রয়োজন পড়ে। এক্ষেত্রে বাঙালির ঐতিহ্য ও সংগ্রামের ইতিহাস বিশেষভাবে সমৃদ্ধ ও ঘটনাবহুল।

তারা বলছেন, বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সেই দূর অতীতে না গেলেও নিকট অতীতের কিছু ঘটনা উল্লেখ করা প্রয়োজন। ভারতের হিন্দু-মুসলমান ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে এবং বাংলার অধিকাংশ মুসলমানের সমর্থনে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। পূর্ব পশ্চিমের হাজারো মাইল ব্যবধানে শুধুমাত্র ধর্মীয় বন্ধনে গঠিত এই রাষ্ট্র রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যায় খাটে না।
 
সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই দু’অঞ্চলের অবস্থান এক নয় উল্লেখ করে তারা বলছেন পূর্ব বাংলার জনগণের মাতৃভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু ঘোষণা করার পর পূর্ববাংলায় ছাত্র-জনতা, রাজনীতিবিদ বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলে। এরই পরিণামে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন । একুশের চেতনায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ অসামপ্রদায়িক বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে সফল হয়। একুশের চেতনায় সফল বাঙালি ৫৪সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়, এর পর ’৫৮-এর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন এবং ’৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যায় চূড়ান্ত সাফল্যের দিকে আর সেই চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছানোর অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু।

ইতিহাস আমাদের সাক্ষ্য দেয়, ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১দফা আন্দোলনকে বেগবান করে। পরবর্তীতে ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বিজয় এ দেশের গণমানুষের জন্য এক আশীর্বাদ। বাঙালির এসব বিজয়ের নেপথ্যে এককভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু।জাতীয় শোক দিবস
 
সত্তরের বিজয়ের পরও শোষকরা বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতায় বসতে দেয়নি। টালবাহানা চলতে থাকে একের পর এক। এসময় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পূর্ববাংলা চলতে থাকে। একাত্তরের ৩ মার্চ পাকিস্তানি স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। এরপর ৭ মার্চের লক্ষ লক্ষ মানুষের জনসমুদ্রে বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসের মহানায়ক ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণটি দেন তিনি-এর পরের ইতিহাস তো বিশ্ব জানে। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ পরিণত হলো বাঙালির মুক্তিসনদ। দেশ স্বাধীন হলো। বঙ্গবন্ধুর আজন্ম স্বপ্ন, তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবে প্রতিফলিত হলো।


দুই.
অবশেষে যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি বিজয় ছিনিয়ে আনে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। দেশ স্বাধীনের পর ’৭২ এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশকে পুনর্গঠিত করতে শুরু করার কাজে হাত দেন এবং স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষে একটি অসাধারণ সংবিধান প্রণয়ন করেন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতিসহ পঞ্চ-বার্ষিকী পরিকল্পনাসহ নানা উন্নয়ন কর্মসূচী গ্রহণ করেন। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত শক্তি বঙ্গবন্ধুর এসব পরিকল্পনাকে মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেনি। তারা চেয়েছে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা যেন পিছিয়ে থাকে।

তাই জুদের পর থেকে তারা ষড়যন্ত্রে মেতে ছিল কিভাবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে থামিয়ে দেয়া যায়। এরই ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা বিরোধী ফ্যাসিস্ট শক্তি ১৫আগস্ট ১৯৭৫ স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই অপশক্তি শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই বসে থাকে নি, তারা জেলের অভ্যন্তরে বন্দী থাকা অবস্থায় চার জাতীয় নেতাকেও নির্মমভাবে হত্যা করে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের তৈরি করে। তারপর বাংলাদেশের বুকে নেমে আসে এক দীর্ঘ অন্ধকার। গণতন্ত্র , মানবাধিকার, মানুষের আশা-আকাংখা ভূলুণ্ঠিত হতে থাকে ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে। কেটে যায় অপেক্ষার দীর্ঘ প্রহর।
 
তিন.
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়লাভের পর সরকার গঠন করেন। সেই থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শুরু হলো বাঙালির দ্বিতীয় অগ্রযাত্রা। পিতার যোগ্য কন্যা হিসেবে শেখ হাসিনা ইতিহাসের দায়মুক্তির পথে চলতে শুরু করলেন। দেশের উন্নয়ন অভিযাত্রা, গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করা, মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ও আদর্শের জায়গায় নিয়ে সবাইকে একত্র করে শুরু করলেন এক নতুন অভিযাত্রার।

বাংলাদেশের এই উন্নয়নের অভিযাত্রায় দেশের মানুষ একাত্মতা ঘোষণা করে নেমেছে এক অলিখিত যুদ্ধে- যে যুদ্ধে বাংলাদেশ পৃথিবীর ইতিহাসে রচনা করবে আরেকটি ইতিহাস। যেমন করে বাঙালি একাত্তররে রক্তক্ষয়ী জুদের মাধ্যমে রচনা করেছিল এক যুগান্তকারী ইতিহাস- যে ইতিহাসের মহানায়ক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বর্তমানে তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পিতার মতো বাংলাদেশকে উন্নয়নে, গণতন্ত্রে, মানবিকতায়, নেতৃত্বে পৃথিবীর বুকে একটি সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যাবেন- এমন স্বপ্নে দেশের মানুষ আজ একতাবদ্ধ।

SUMMARY

269-1.jpg