- মো. সাখাওয়াত হোসেন
বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলার স্বাধীনতা পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। একটিকে ছাড়া অন্যটি বড্ডই বেমানান এবং এ বিষয়টি আমরা সর্বদাই অনুভব করে থাকি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতার রক্তিম আভা জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠে। ৩০ লাখ শহীদ এবং ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি আমাদের গর্বের এবং গৌরবের স্বাধীনতাকে। সেই স্বাধীনতা অপূর্ণ ছিল স্বাধীনতার মহানায়ক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালির রাজাধীরাজ বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে।
তাইতো সেদিন বাঙালি জাতি অপেক্ষার প্রহরে ছিল, কখন তাদের নেতা পাকিস্তানিদের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে পদার্পণ করবেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানের অন্ধকার কারাগারে বন্দী ছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তারই রাজনৈতিক সহযোদ্ধারা মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যুদ্ধ পরিচালনার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য বিশ্বব্যাপী জনমত গড়ার লক্ষ্যে কাজ করেন।
দেশ স্বাধীন হল, কিন্তু যার আন্দোলন সংগ্রামের নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতা তার অনুপস্থিতিতে বাঙালি জাতি উচ্ছাসে উদ্ভাসিত হতে পারেনি। মানুষটি কি বেঁচে আছে, না নাই এ হদিসও জানা ছিল না পরিবারের কারো কাছেই, এমনকি দেশের কোন নেতাকর্মীও জানত না বঙ্গবন্ধুর অবস্থান। কেননা, ২৫শে মার্চ রাত্রিতে গ্রেফতারের পরে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত সে মানুষটির কোন খোঁজ খবর জানা ছিল না কারো।
স্বাধীনতা বিজয় লাভের পরে দলে দলে মানুষ ধানমন্ডির ১৮ নং বাড়িতে আসতে থাকে। ফজিলাতুন্নেছা’র দুই ছেলে শেখ কামাল ও শেখ জামাল মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে এসেছেন অথচ বঙ্গবন্ধুর কোন খোঁজ নেই রেণুর নিকট। ফজিলাতুন্নেছা মুজিব অত্যন্ত ধৈর্যশীল এবং বিশ্বাসী মানুষ ছিলেন, বঙ্গবন্ধু সম্বন্ধে সবাইকে সান্তনার বাণী শুনিয়েছিলেন যে, তিনি শীঘ্রই আসবেন। অথচ তিনিও জানতেন না ওনার স্বামী বেঁচে আছে না মেরে ফেলা হয়েছে। পরিবারের এ অস্থির সময়ে দলীয় কর্মী, নেতা, সাংবাদিক, বিদেশী কূটনৈতিক, আত্নীয়স্বজনদের সাথে মতবিনিময় করেছেন ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নিয়ে। অবশেষে ১৯৭২ সালের ৯ই জানুয়ারি বঙ্গললনা, বাঙালির অগ্রযাত্রার যোগ্য সেনানী ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের সাথে তার স্বামী বঙ্গবন্ধুর ফোনালাপ হয়। সে সময় আনন্দে অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর আদরের রেণু। ওপাশ থেকে বঙ্গবন্ধুও নিজে আবেগের তাড়নায় অশ্রুসংবরণ করেছিলেন।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিজয়ের পর পরই পাকিস্তানের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে খুব দ্রুতই। তৎকালিন পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা থেকে সরে পড়তে বাধ্য হয়, ক্ষমতায় আসেন পিপিপি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্রো। ক্ষমতায় আসার পরে পিপিপি প্রধানের বোধদয় হয় শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সামরিক জান্তার আনীত শাস্তি অবৈধ। আন্তর্জাতিক সংস্থা, বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এবং পাকিস্তানের জনগণ ও যৌক্তিকতার মিশেলে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার। বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষ করে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দিন ধার্য করা হয়। অনেকেই বলে থাকেন, বঙ্গবন্ধু কেন লন্ডনে যাত্রাবিরতি দিলেন, সরাসরি কেন ঢাকা আসলেন না। এর সঠিক উত্তর হল: পাকিস্তানের বিমান ভারতের সীমারেখার উপর দিয়ে যাওয়ার সময় ভারতীয় বাহিনীর হাতে বিধ্বস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়, আর বিমান ক্ষতিগ্রস্থ হলে শেখ মুজিবও ক্ষতিগ্রস্থও হবেন। সে কারণেই বঙ্গবন্ধু লন্ডনে যাত্রাবিরতি দিয়ে ভিন্ন বিমানে করে ভারতে আসেন এবং পরে সংক্ষিপ্ত বিরতির পরে প্রিয় স্বদেশ বাংলাদেশে। বাংলাদেশে আসার পর আমাদের বাঙালির স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব পরিপূর্ণতা পায়। বাংলার গরিব দুঃখী মানুষের ভালবাসার প্রতিক, শোষিত মানুষের নয়নমণি বাংলাদেশে আসার সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধারা সম্মিলিতভাবে বিজয় উদযাপন করে থাকে। বাংলার আকাশ বাতাস প্রকৃতিও সেদিন বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানিয়েছিলো।
শেখ মুজিব যেমন বিজয় দিবসে মুক্তি পাননি ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধু পরিবারও ১৬ ডিসেম্বরে মুক্তি পায়নি। ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে পাহারারত সৈন্যরা ১৬ই ডিসেম্বরের পরেও তাদের দায় দায়িত্ব পালন করে অর্থাৎ মুজিব পরিবার তখনো মুক্তি পায়নি পাকিস্তানিদের রাহু থেকে। চারদিকে জয় বাংলা ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বাংলার আকাশে বাতাসে, মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকার রাস্তায় বিজয় উল্লাসে মত্ত। অথচ, ঘরের ভেতর থেকে মুক্ত আলোর ছোঁয়ায় বের হতে পারছেন না বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারা। ফজিলাতুন্নেছা মুজিব দুশ্চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেন কিন্তু কাউকে কিছুই বুঝতে দিতেন না। বাড়ির প্রহরীরা সে সময়ে সারেন্ডার না করায় দুশ্চিন্তা আরো গাঢ় হয়। রাগে ফজিলাতুন্নেছা মুজিব প্রহরীদের ডেকে নিয়ে বলেন ‘তোমাদের নিয়াজী সারেন্ডার করছে, তোমরা করো না কেন?’ প্রতিউত্তরে তারা বলেন, ‘নিয়াজী করুক, আমরা করবো না।’ বাড়ির আশেপাশের লোকজন অর্থাৎ প্রতিবেশিরা হামলার ভয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন, কারণ সবাই আতঙ্কে ছিলেন শেষ সময়ে পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুর পরিবারের উপর মরণকামড় দিতে পারে এবং যার ফলে আশেপাশের মানুষেরাও হতাহত হতে পারে। অনেকেই আবার বুদ্ধিজীবী হত্যার ন্যায় মুজিব পরিবারের উপর হত্যাযজ্ঞের আশঙ্কা করেন।
স্বাধীনতা লাভের দুইদিন পর বঙ্গবন্ধুর পরিবারের খোঁজ পাওয়া যায়। ১৭ ডিসেম্বর মেজর অশোক কুমার তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে দায়িত্ব পালনের নিমিত্তে ধানমন্ডির ১৮ নং বাড়িতে এসে ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের সন্ধান পান। প্রায় ১ ডজন পাকিস্তানি বাহিনীকে মাত্র ৩ জন সদস্যদের নিয়ে সুকৌশলে খুব দ্রুত ফজিলাতুন্নেছা মুজিবদের শত্রুমুক্ত করেন মেজর অশোক। মেজর অশোক কুমার তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে রক্ষা করেন, পাকিস্তানি বাহিনীরা তাদেরকে হত্যার হুমকি দেয়। হুমকিকে উপেক্ষা করে নিরস্ত্র হয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে আলোচনা চালিয়ে যান মেজর সাহেব এবং বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের অক্ষত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। আলোচনার মাধ্যমে পাকিস্তানি সৈন্যদের নিরস্ত্র অবস্থায় বাড়ির ভেতর থেকে বের করে নিয়ে আসেন বুদ্ধিমান মেজর। মেজর তারার টিম মিজোরামের পার্বত্য অঞ্চলে তাদের দায়িত্ব পালনের জন্য চলে যায় কিন্তু থেকে যায় মেজর তারা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের বিশেষ অনুরোধে। তিনি অনুরোধ করেন, বঙ্গবন্ধু আসার পূর্ব পর্যন্ত যেন তিনি তাদের নিরাপত্তা দেন। মেজর তারাও অত্যন্ত নির্ভরতা ও বিশ্বস্ততার সহিত অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছিলেন নিষ্ঠার সহিত।
১৯৭২ সালের ৯ই জানুয়ারি সকাল ৬টা ৩৬ মিনিট সময়টা বিশ্বের সকল বাঙালি ও ব্রিটিশদের ইতিহাসে একটি স্বর্ণোজ্জ্বল দিন। বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় কুয়াশা সিক্ত ভোরে হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। বিমানবন্দরে নির্দিষ্ট গাড়ি অপেক্ষামান ছিল বাঙালির নয়নের মণিকে হোটেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কড়া নিরাপত্তার মধ্যে বাঙালির রাখাল রাজাকে সতর্ক পাহারায় অভিজাত ক্যারিজ হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। এই খবর চাউর হওয়ার পরে প্রবাসী বাঙালিরা দলে দলে ভিড় জমাতে থাকে হোটেলটির সামনে। মুজিব ভক্তদের প্রচন্ড ভীড় লক্ষ্য করা যায় কিছুক্ষণের মধ্যে। তৎকালিন বৃটেন সরকার সমগ্র বাঙালির হৃদয়ের ধন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যথাযোগ্য মর্যাদায় গ্রহণ করেন বীরের বেশে। লন্ডনে শেখ মুজিবের প্রেস কনফারেন্সের বক্তব্যের কিছু অংশ রেডিওতে প্রচারের পূর্বে বিবিসি নিউজের ঘোষক আবেগময় বাণীতে বলেছিলেন “বিশ্বের সকল বাংলা ভাষাভাষী লোকদের সান্তনার জন্য শেখ মুজিবের কণ্ঠস্বর।”
সেদিন রেডিওতে জাতির জনকের কণ্ঠস্বর শুনে স্বাধীন বাংলাদেশে ধানমন্ডির ১৮ নং বাড়িতে কেউই চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি। সেদিন রাতেই বঙ্গবন্ধুর সাথে টেলিফোন ধরিয়ে দেওয়া হয় ধানমন্ডির ১৮ নং বাড়িতে। টেলিফোন সংযোগ পাওয়ার পরে বঙ্গবন্ধুর প্রথম প্রশ্ন ছিল “তোরা বেঁচে আছিস?” ছেলেমেয়েরা একের পর এক কথা বলছে। এক পর্যায়ে প্রিয়তমা স্ত্রী ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সাথে কথোপকথন হয় বঙ্গবন্ধুর। রেণু টেলিফোন ধরার সাথে সাথে বাঙালির রাজাধীরাজ বিশাল হৃদয়ের অধিকারী শেখ মুজিব নিজেকে খানিকটা সামলিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।
তবে অসীম ধৈর্যের অধিকারী, অসাধারণ মনোবলের অধিকারী, প্রেরণাময়ী ফজিলাতুন্নেছা মুজিব নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিলেন, “বোকার মত কাঁদতে নেই। তুমি তো কেবলমাত্র বঙ্গবন্ধু নও, শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধের মহানায়কই নও, তুমি তো নিজেই একটি দেশ। দেশ তো কাঁদতে পারেনা। জান, আমার এখনও ভয় হয়, তোমাকে আদৌ আমরা ফিরে পাবো কিনা?” এই ছিলেন আমাদের ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বাঙালির রত্ন। নিজে খুব কষ্টে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময়, থাকার বাসা পাননি, কিন্তু স্বামীর কাছে নিজের কষ্টের কথা একবারও না বলে বরঞ্চ স্বামীকে সাহস ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু এমন একজন সহনশীল ও মমতাময়ী নারীকে পেয়েছিলেন বিধায় রাজনীতিটাকে নিজের ধ্যান জ্ঞান ও পেশা হিসেবে নিতে পেরেছিলেন। সমস্ত পিছুটানের দায়দায়িত্ব নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদরের রেণু।