হায়দার মোহাম্মদ জিতু
জীবনের উল্টো পিঠে যেমন নিশ্চিত মৃত্যু শায়িত ঠিক তেমনি শান্তির অপর পিঠে সংগ্রাম, সংঘর্ষ এবং লড়াই নিহিত। নিরীক্ষা দৃষ্টিতে, পৃথিবীতে সংঘর্ষ আছে বলেই শান্তির দামামায় এই অবিরাম ছুটে চলা। তবে জীবন বাস্তবতায় পৃথিবীর তাবৎ অঞ্চল জুড়েই শাশ্বত শান্তির জন্যে লড়াই করতে হয়। এ হিসেবে বাঙালির শান্তির লড়াই ক্ষেত্রবিন্দু ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ।
তবে এই রক্তাক্ত যাত্রা ৪৭ এ দেশ বিভাগের অংশ থেকেই শুরু হয়েছিল। আর এই দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় একক প্রথাবিরোধী পুরুষ হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণে ইতিহাস বলে একক বঙ্গবন্ধু ছাড়া তার সমকক্ষ বা তাঁর থেকে এগিয়ে অনেকেই বিক্রিবাট্টা এবং সমঝোতার অলিগলি ঘুরেছেন। কোনও একজন তো বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরও ভিন্ন রাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য হওয়ার আগ্রহে লুঙ্গি কাছা দিয়ে দৌড়ও শুরু করেছিলেন! তবে তাকে বা তাদের খুব দেশি দোষারোপ করারও কিছু নেই। কারণ ধারাবাহিক শোষণ এবং অন্যের অনুগ্রহ পাত্র হয়ে জীবন পরিচালনাই ছিল এই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ বাস্তবতার ফলাফল। সেই বাস্তবতাকেই তারা শুধু যাপনের প্রথা হিসেবে নিয়েছিলেন মাত্র।
উল্টোদিকে শেখ মুজিব ছিলেন পরাধীনতার প্রথা বিরোধী স্পর্ধা। যিনি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চই ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারে সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। কিন্তু এই শাশ্বত শান্তির লড়াইয়ে শেখ মুজিবকে জীবনের পুরো সময়টাতেই কাটাতে হয়েছে জেল-জুলুমের নিপীড়নে। তবে অনুপ্রেরণা বিষয় হলো, এই সময়টাইই বঙ্গবন্ধু ৫৬ হাজার বর্গমাইলের গণ্ডি পেরিয়ে দিনে দিনে হয়ে উঠেছিলেন আরও পরিণত এবং বৈশ্বিক।
এ প্রসঙ্গে, বঙ্গবন্ধুর জীবন অর্জন নিয়ে কেউ কেউ শুধু ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ অর্জনকে বোঝেন। এটা তাদের শেখ মুজিব সম্পর্কে মানসিক উচ্চতা, দৃষ্টিসীমানা ও কারিশমা সম্পর্কে জানার অজ্ঞতা। তাঁর নেতৃত্বে চলমান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কালপর্বেই রচিত হয়েছিল ভারত-সোভিয়েত শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা-চুক্তি ১৯৭১ এবং বাংলাদেশ-ভারত শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা-চুক্তি ১৯৭২ এবং পাগলা পাকিস্তান বাংলাদেশ ছেড়ে ফিরে গিয়েছিল নিজের গারদে। অর্থাৎ তাঁকে এই অঞ্চলের আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠার পথপ্রদর্শক বললেও ভুল হবে না নিশ্চিত।
বঙ্গবন্ধু বৈশ্বিক পরিস্থিতিতেও সকল শোষিত মানুষের পক্ষে লড়াই করার প্রতীক। বিশ্ব দরবারের প্লাটফর্ম জাতিসংঘে দাঁড়িয়েও তিনি জানিয়েছেন, বিশ্ব আজ দুই শিবিরে বিভক্ত শোষক এবং শোষিত। তিনি শোষিত মানুষের পক্ষে। সেই ভাষণ পরবর্তী কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো শেখ মুজিবকে বলেছিলেন ক্রমেই তাঁর দিকে ধেয়ে আসছে পালা পালা শত্রুর বিষবান। তবুও প্রলয়ের আগুন ছড়ানো নিশান তখনও থামেনি বরং আছড়ে পড়েছে আরও সশব্দে। পাড় ভাঙা স্রোতে মাতম তুলেছিলেন শোষক শিবিরে।
চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোর শান্তি সম্মেলনেও বঙ্গবন্ধু বলেনছিলেন, ‘পৃথিবীর বৃহত্তম শক্তি যে অর্থ ব্যয় করে মানুষ মারার অস্ত্র তৈরি করছে, সেই অর্থ গরিব দেশগুলোকে সাহায্য দিলে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে।’ অর্থাৎ বিশ্বের সকল শোষিত মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠছিলেন শেখ মুজিব।
শেখ মুজিবের এই অটল অগ্রযাত্রার ফলস্বরূপ ১৯৭৩ সালের ২৩ মে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের উত্তর প্লাজায় উন্মুক্ত চত্বরে সুসজ্জিত প্যান্ডেলে বিশ্ব শান্তি পরিষদ আয়োজিত অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের উপস্থিতিতে বিশ্ব শান্তি পরিষদের তৎকালীন মহাসচিব রমেশ চন্দ্র বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক প্রদান করে। যদিও ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর সান্তিয়াগোতেই পৃথিবীর ১৪০টি দেশের শান্তি পরিষদের ২০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে আগেই এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল।
প্রাচ্যের যেকোনও বিষয়ে স্বীকৃতি বা সম্মান প্রদর্শনে পাশ্চাত্যের অনাগ্রহতা বা দেখেও ঘুমিয়ে থাকার কৌশল বেশ পুরনো। যদিও তৎকালীন সময়েই তারা বঙ্গবন্ধুর একক বিশ্ব নেতৃত্বের কাছে সেই স্বীকৃতি প্রদান করেছিলেন। তবে এতে তাদের উদারতা বা দাক্ষিণ্যের যোগসূত্র নেই। বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির পাঁচ বছর পরে একটি শান্তিপূর্ণ পৃথিবী নির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে ফ্রান্সের বিজ্ঞানী দম্পত্তি জুলিও কুরি’র শান্তি পদকের যে উদ্দেশ্য বঙ্গবন্ধুর সেটা প্রাপ্তির মাধ্যমে তা আরেকবার পরিণয় পেয়েছে মাত্র।
বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে শান্তি অবতরণের জন্যে এধরণের আলোচনা, সমালোচনা, পুরষ্কার যতদিন বিরাজ করবে বুঝতে হবে ততদিনই এখানে সংঘর্ষ-সংগ্রাম এবং অভিনয় অব্যহত আছে। কারণ অসুখ আছে বলেই ওষুধ নির্মাণের প্রয়োজন পরে। কাজেই এই ধরনের বিষয়বস্তু এড়িয়ে মানবিক পৃথিবী নির্মাণই হবে ভবিষ্যৎ স্বপ্ন-বাস্তবতার সমন্বিত ফলাফল। আর এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুই হয়ে উঠতে পারেন এক আদর্শিক উদাহরণ।
লেখক: প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
haiderjitu.du@gmail.com
সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন, প্রকাশিত : মে ২৩, ২০২০